জাতীয়

‘পুতুল’ থেকে খালেদা জিয়া

বেগম খালেদা জিয়া একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও বেনজির ভুট্টোর পর মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপির চেয়ারপার্সন ও দলনেত্রী তিনি।

তাঁর বাবা ইস্কান্দর মজুমদার এবং মা বেগম তৈয়বা মজুমদার। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। তিনি ১৯১৯ সালে ফেনী থেকে ভারতের জলপাইগুড়ি গিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে জলপাইগুড়িতে বিয়ে করেন। সেখানে ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন খালেদা জিয়া। চাঁদের টুকরোর মতো আলোকউজ্জ্বল দ্যুতি ছড়ানো পুতুলের মতো দেখতে সেই চন্দ্র শিশুর ডাক নাম রাখা হয় ‘পুতুল’। পুরো নাম ছিল খালেদা খানম পুতুল।

বিয়ের আগে পরিবারের কাছে পুতুল নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। আদর করে তাঁকে এই নামেই ডাকতেন স্বজনরা। তিন বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ভাইয়েরা সবার ছোট। তাঁর পিতামহ হাজী সালামত আলী এবং মাতামহ জলপাইগুড়ির তোয়াবুর রহমান।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর জলপাইগুড়ি থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে তার পরিবার। তবে তাঁর আদি পৈতৃকনিবাস ফেনী জেলার ফুলগাজী উপজেলার শ্রীপুর গ্রামের মজুমদার বাড়ি।

পরিবারের স্থায়ী বসবাসের সূত্র ধরে খালেদা জিয়া দিনাজপুর শহরে বেড়ে ওঠেন। পাঁচ বছর বয়সে দিনাজপুরের মিশন স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এরপর দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। 

ম্যাট্রিকুলেশন পাসের বছর পুতুলের বিয়ে হয় ‘কমল’ নামের এক হাসি খুশি তরুণের সাথে। পুতুলের বয়স তখন ১৭ বছর বয়স। জিয়াউর রহমানের ডাক নাম কমল। তিনি ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন। ডিএফআই এর অফিসার হিসেবে তখন দিনাজপুরে কর্মরত ছিলেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। 

স্বামীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়ার আগে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়াশোনা করেন খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করার পর থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে বা সাধারণভাবে ‘খালেদা জিয়া’ নামে পরিচিতি লাভ করেন তিনি। মূলত সেদিন থেকেই ‘পুতুল’ হয়ে যান ‘খালেদা জিয়া’।

১৯৬৯ সালের মার্চ পর্যন্ত করাচিতে স্বামীর সাথে ছিলেন। এরপর ঢাকায় চলে আসেন। কিছুদিন জয়দেবপুর থাকার পর চট্টগ্রামে স্বামীর কর্মক্ষেত্র স্থানান্তরিত হলে তার সঙ্গে ষোলশহর অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন খালেদা জিয়া। 

মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভকালে খালেদা জিয়া কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৬ মে নৌপথে ঢাকায় চলে আসেন। বড় বোন খুরশিদ জাহানের বাসায় ১৭ জুন পর্যন্ত থাকেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে দুই সন্তানসহ গৃহবন্দী ছিলেন। 

১৯৭৭ সালে তাঁর স্বামী জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর, খালেদা জিয়া ফার্স্ট লেডি হিসেবে জাতীয়ভাবে পরিচিত হন। এই সময়ে তিনি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন এবং একজন সাধারণ গৃহিণী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলে তাঁর জীবনে চরম ব্যক্তিগত শোক নেমে আসে। এই হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

পরে দলের নেতা-কর্মীদের আগ্রহ ও ভালোবাসায় তিনি গৃহবধূর অবস্থান ছেড়ে রাজনীতিতে নাম লেখান। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। একই বছর ৭ নভেম্বর তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে প্রথম সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন, যা তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করে।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ১৯৮৩ সালে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের লক্ষ্যে সাতদলীয় জোট গঠন হয়। তিনি এরশাদের স্বৈরশাসনের অবসানের জন্য পরিচালিত নয় বছরের দীর্ঘ সংগ্রামে আপসহীন নেত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এই সময়ে তিনি বারবার গৃহবন্দী ও কারাবরণ করেন। তবে স্বৈরাচারের সাথে কোনো আপস করেননি।

তাঁর এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদের পতন ঘটে। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করলে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বেই রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির পরিবর্তে দেশে পুনরায় সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৯৬-এর স্বল্পস্থায়ী সরকারেও তিনি দায়িত্বপালন করেন, যেখানে অধিকাংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনটি বর্জন করে। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দলগুলোর যুগপৎ আন্দোলনে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। ২০০১ সালে তার দল পুনরায় ক্ষমতায় আসে এবং তিনি ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯১-১৯৯৬, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬-মার্চ ১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ এই তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

২০১১ সালের ২৪ মে নিউ জার্সি স্টেট সিনেটে ‘ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি’ পদক প্রদান করা হয় তাকে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট সিনেট কর্তৃক কোনো বিদেশিকে এ ধরনের সম্মান প্রদানের ঘটনা এটাই ছিল প্রথম। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই তাকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ সম্মাননা দেয় কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন- সিএইচআরআইও নামের একটি সংগঠন। 

তিনি গৃহের চৌকাঠ পেরিয়ে রাজনৈতিক মঞ্চে এসে দাঁড়ানো এমন এক মহিয়সী যাঁর ‘পুতুল’ নাম মুছে গিয়ে ‘খালেদা জিয়া’ নামে আপসহীন এক নেত্রীর পরিচয় মূর্ত হয়ে ওঠে। এই রূপান্তর ব্যক্তিগত জীবন থেকে বৃহত্তর জাতীয় দায়িত্বে উত্তরণের এক জীবন্ত উদাহরণ। যেখানে একজন সাধারণ গৃহবধূ সময়ের প্রয়োজনে বাংলাদেশের কোটি মানুষের নেত্রী হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন ইতিহাসের অংশ।