জাতীয়

অস্ত্র বোঝাই সোয়াত জাহাজ ও সেনা বাহিনীর নির্বিচার গুলি

শাহ মতিন টিপু : ১৯৭১-এর ২৪ মার্চ ছিল লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ২৩তম দিবস। গতকাল বাংলার প্রতিঘরে ঘরে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সমগ্র বাঙালী জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ।

 

আজ পাকিস্তান সেনাবাহিনী রংপুর, সৈয়দপুর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে জনতার বিক্ষুব্ধ মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। সৈয়দপুরে সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে ১৫ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তারা রংপুরে সান্ধ্য আইন জারি করে।

 

সৈয়দপুরের ঘটনার পর পরই মিরপুরে অবাঙালীরা বাঙালীদের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ চালায়।

 

বিনা উস্কানিতে নিরস্ত্র জনসাধারণের ওপর সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ জানিয়ে ধানমন্ডির ৩২নং বাসভবনে সমবেত বিক্ষুব্ধ জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সৈয়দপুর, রংপুর, চট্টগ্রাম ও জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর কার্যকলাপে আমি শোকাহত। বঙ্গবন্ধু হুঙ্কার ছেড়ে বলেন, জোর করে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলে তার ফল ভাল হবে না।

 

আজ বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার মধ্যে কোন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়ার উপদেষ্টামন্ডলীর মধ্যে প্রায় দু’ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা হয়েছে। বৈঠকের পর তাজউদ্দীন আহমেদ অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে ইচ্ছুক নয়।

 

আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমান বোঝাই করে বিপুল পরিমাণে সৈন্য আর অস্ত্র আনা হয়। এরই অংশ হিসেবে অস্ত্রের সবচেয়ে বড় চালানটি আসে এমভি সোয়াত নামক জাহাজে।

 

চট্টগ্রাম বন্দরের ১৭ নং জেটিতে নোঙ্গর করা অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াত থেকে পাক সেনারা অস্ত্র খালাস করতে গেলে প্রথমে শ্রমিকরা অস্ত্র খালাসে অস্বীকৃত হয় এবং বাধা প্রদান করে। এতে সেনাবাহিনী গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই ১৪ জন শ্রমিক নিহত হয়।

 

এরপর সেনা সদস্যরা কিছু অস্ত্র খালাস করে প্রায় ১২টি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে তাদের পথরোধ করে। এ সময় সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে কমপক্ষে ২৫০ শ্রমিক নিহত হয়।

 

চট্টগ্রাম জেটির ভয়াবহ সেই গণহত্যা সম্পর্কে মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া লেখেন, ২৪ মার্চ, ১৯৭১; বেলা দেড়টায় কর্নেল সিগরীর হুকুমে ইবিআরসি থেকে ৬০ জন বাঙালি সৈন্যকে ২০ নম্বর বেলুচ রেজিমেন্টের একটা কোম্পানির সঙ্গে চট্টগ্রাম পোর্টে পাঠানো হয়।

 

একটা বদমতলবে বাঙালি সৈন্যদের বিনা অস্ত্রে পোর্টে পাঠানো হয়েছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যদের পাঠানো হয়েছিল অস্ত্রসজ্জিত করে। চট্টগ্রাম পোর্টের ১৭ নম্বর জেটিতে পোঁছানোর পর বেলুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা ওই জেটির চতুর্দিক ঘিরে রাখে। আর বাঙালি সৈন্যদের নিয়োগ করা হয় সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাস করার জন্য। বেলুচ রেজিমেন্টের জওয়ানদের সঙ্গে কমান্ডার ছিলেন এক পাঞ্জাবি মেজর। আর বাঙালি সৈন্যদের সঙ্গে ছিলেন নায়েব সুবেদার নূরল ইসলাম ও নায়েব সুবেদার গোলাম সাত্তার।

 

সোয়াত জাহাজ কিছুদিন আগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এসে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে। বেসামরিক লোকেরা জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাস করতে বাধা দেয়। তাই ওই বাধা সরাতে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা জনতার ওপর গুলি ছোড়ে। এতে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে জাহাজের কাছ থেকে সরে যায়। সোয়াত জাহাজটি ছিল অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদে বোঝাই। বিশেষ করে ২৫ পাউন্ডার গানের গোলা ছিল সবচেয়ে বেশি।

 

বেলুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা যখন জেটির চতুর্দিকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মজবুত করার জন্য ব্যস্ত, তখন বাঙালি সৈন্যরা সোয়াত থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ খালাসের কাজে ঘামে ভিজে একাকার। জেটিতে যাওয়ার পর বাঙালি সৈন্যদের প্রথম খাবার দেয়া হয় ২৫ তারিখের বিকালে অর্থাৎ পুরো একটা দিন পর। তাও সে খাবার জোটে মাত্র দশজন সৈন্যের ভাগ্যে। এ রকম অভুক্ত অবস্থায় যখন বাঙালি সৈন্যরা মাল খালাসে ব্যস্ত, তখন ব্রিগেডিয়ার আনসারী ও কর্নেল সিগরী বারবার জেটিতে গিয়ে তদারক করেন। এর আগে আমরা কখনও দেখিনি কিংবা শুনিনি যে, জাহাজের মাল খালাসের সময় কোনো ব্রিগেডিয়ার স্বয়ং এ ধরনের কাজ করেন। বাঙালি সৈন্যরা যখন অনাহার আর ক্লান্তিতে দিশাহারা, তখন ব্রিগেডিয়ার আনসারী ও কর্নেল সিগরী বারবার তাগিদ দিচ্ছেন দ্রুত মাল খালাসের জন্য।সেদিন চট্টগ্রামের এ ঘটনায় সারাদেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। স্রোতের মতো মিছিল রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে সমবেত হয়।বিকেলে  কাপ্তানবাজার থেকে আসা এক নারী জানান, মিলিটারিরা কাল রাতে তার দুই ছেলেকে গুলি করে মেরেছে। বঙ্গবন্ধু গর্জে উঠে তৎক্ষণাৎ তাজউদ্দীন আহমেদকে নির্দেশ দিলেন প্রেসিডেন্ট ভবনে টেলিফোন করতে। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যালাপ শেষে বললেন, ‘প্লিজ, স্টপ দিস কিলিং।’ রাত ৮টায় ভুট্টোর প্রধান সহচর গোলাম মোস্তফা খার ভুট্টোর সর্বশেষ একটি বার্তা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন এবং বঙ্গবন্ধু এর চূড়ান্ত জবাব দেন। ভুট্টোর এ প্রস্তাবে পুরনো ফর্মুলাই পেশ করা হয়েছিল। অর্থাৎ কেন্দ্রে পিপলস্ পার্টির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি তথা কোয়ালিশন সরকার গঠন। সারাদিনের বিভিন্ন ঘটনায় বঙ্গবন্ধু চড়া মেজাজে থাকলেও বেশ সংযত ও দৃঢ় কণ্ঠে গোলাম মোস্তফাকে বলেন, ‘দিস ইজ নট এন্ড উইল নেভার এ্যাক্সেপটেবল টু আস। প্লিজ টেল ইওর লিডার কিলিং দ্য পিপল বাই দ্য আর্মি ইজ নট এ গুড থিং এ্যান্ড আই হ্যাভ নাথিং মোর।’ মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে ভুট্টোর দূতকে মতামত জানিয়ে তিনি বিদায় দেন।

     

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ মার্চ ২০১৫/টিপু/রুহুল