শাহীন গোলদার, সাতক্ষীরা : বিশ্ব ক্রিকেটে এই মুহূর্তে সবচেয়ে আলোচিত ক্রিকেটারের নাম বাংলাদেশ দলের বোলার মুস্তাফিজুর রহমান। ভারতের বিপক্ষে অসাধারণ পারফর্ম করে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি।
ওয়ানডেতে অভিষেক হওয়া এই বোলার দুই ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ১১টি উইকেট পেয়ে রেকর্ড বুকে নাম লিখিয়েছেন। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে এখন উজ্জ্বল এক নক্ষত্র মুস্তাফিজুর রহমান নামের এই সাতক্ষীরা এক্সপ্রেস।
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া গ্রামের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান। বরেয়া জিলানী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। অনুর্ধ্ব-১৬, ১৮ ও ১৯ দলে সাতক্ষীরা জেলা দলের খেলোয়াড় ছিলেন তিনি।
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার তারালি ইউনিয়নের ব্যবসায়ী বাবা আলহাজ্ব আবুল কাশেম গাজী ও মা মাহমুদা খাতুনের কনিষ্ঠ ছেলে মুস্তাফিজুর। ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৫ সালে জন্ম। চার ভাই ও দুই বোনের সংসারে বেড়ে ওঠা মুস্তাফিজুর রহমানের। তার বড় ভাই মাহফুজার রহমান গ্রামীণফোনের টেরিটরি অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। মেজ ও সেজ ভাই ঘের ব্যবসায়ী।
তার ক্রিকেট খেলায় আসার পিছনে সেজ ভাই মোখলেসুর রহমানের অবদান অনেক। ক্রিকেট পরিবারে জন্ম নেওয়া মোস্তাফিজুরকে তাই তাকাতে হয়নি পিছনে ফিরে। তার বড় ভাই এক সময় ক্রিকেট খেলতেন। মেজ ভাই জাকির হোসেনও কম যান না, সেজ ভাই এখনো খেলেন।
মুস্তাফিজুরের সেজ ভাই মোখলেছুর রহমান লাল্টু জানান, তার উঠে আসার ইতিহাস। এই তো বছর পাঁচেক আগের কথা। সাতক্ষীরায় অনুর্ধ-১৪ ক্রিকেটে বাছাই পর্বে সবার নজর কাড়ে মুস্তাফিজুর।
এরপর জেলা পর্যায়ে অনুর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট খেলায় সাতক্ষীরার হয়ে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। পড়াশোনায় অতটা মন তার কখনোই ছিল না। স্কুল ফাঁকি দিয়ে সে ক্রিকেট খেলতে যেত। বাসায় তো বলেই দিয়েছিলো, আমার দ্বারা ওসব হবে না। তোমরা আর জোর করো না। এরপর থেকে ক্রিকেটই তার ধ্যানজ্ঞান। বরেয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নেট প্রাকটিস করত সে।
সাতক্ষীরা গণমুখী সংঘের কোচ আলতাফই প্রথম ধরতে পেরেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমানের ভেতরের ধারটা। হিরে চিনে নিয়ে ঘষামাজার কাজটি তিনি শুরু করে দেন। জেলা পর্যায়ে এসে মুস্তাফিজকে আরো পরিণত করে তুলতে পরিশ্রম করেন সাতক্ষীরার জেলা কোচ মুফাসিনুল ইসলাম তপু।
মুস্তাফিজুরের তিন ভাই। ডান থেকে- বড় ভাই মাহফুজার রহমান, মেজ ভাই জাকির হোসেন ও সেজ ভাই মোখলেছুর রহমান (ছবি : শাহীন)সকলের পরিশ্রমের প্রতিদান দিতে পেরেছেন মুস্তাফিজ। পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ম্যাচে তার পারফরম্যান্সই বলছে সে কথা। জেলা পর্যায়ের পর খুব বেশি দিন তাকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ডাক পেয়ে যান খুলনার বিভাগীয় দলে। বছর তিনেক আগে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ফাস্ট বোলিং ক্যাম্পে ট্রায়াল দিতে এসে কোচ আর ছাড়েননি এই প্রতিভাকে। নিয়মিতই অনুর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। বল করতেন জাতীয় দলের নেটেও। তবে সম্ভবনার দ্যুতি ছড়িয়েছেন গত বছর অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। ঝুলিতে ভরেছিলেন ৯ উইকেট। হয়েছিলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী।
গত বছরের মে মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাংলাদেশ ‘এ’ দলেও স্থান পেয়েছিলেন মুস্তাফিজ। রীতিমতো চমক ছিলেন তিনি। মুস্তাফিজ প্রথম শ্রেণিতে খেলা শুরু করেন গত বছরের এপ্রিল থেকে। মাত্র ছয় মাস আগে অভিষেক হয়েছে ঘরোয়া এক দিনের ম্যাচে।
অভিষেক ম্যাচের চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স তাই ‘নতুন দিনের বাংলাদেশ’ দলে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করবে বলেই পূর্বাভাস দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বলা যায় নতুন বিস্ময় হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেটে আবির্ভূত হলেন এই তরুণ পেসার।
বাঁহাতি পেসারের যে ঘাটতি অনুভব করছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল- তা হয়তো পূরণ করতে সক্ষম হবে মুস্তাফিজুর। তা ছাড়া মুস্তাফিজুরের স্বপ্ন পূরণে আনন্দে আত্মহারা হয়েছেন তার বাবা-মাসহ গোটা জেলাবাসী।
বিভিন্ন সময়ে মুস্তাফিজুরের পাওয়া ক্রেস্ট ও অন্যান্য পুরস্কার (ছবি : শাহীন)মুস্তাফিজুরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘দলে টিকে থাকতে হলে ভালো পারফরমেন্স করতে হবে। না হলে দলে থাকা যাবে না। পরের ম্যাচগুলোতে খেলার সুযোগ পেলে আরো ভালো কিছু করার চেষ্টা করব।’
মুস্তাফিজুরের বাবা আবুল কাশেম আবেগ জড়িত কণ্ঠে জানান, তার ছেলে যে জাতীয় টিমে খেলছে এটি তার জন্য বিরাট গর্বের বিষয়। ছেলে ও বাংলাদেশ দলের জন্য তিনি সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করেছেন।
মুস্তাফিজুর রহমানের ক্রিকেট কোচ আলতাফ হোসেন জানান, সৌম্য এবং মুস্তাফিজুর রহমান এ দুজনই তার শিষ্য। দুজনই যে এক সঙ্গে জাতীয় দলে খেলছে এর চেয়ে আনন্দের কিছু হতে পারে না- বলেন তিনি।
মুস্তাফিজুরের আরেক কোচ মুফাসিনুল ইসলাম তপু বলেন, ‘মুস্তাফিজুর রহমান প্রথমে ব্যাটসম্যান হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বোলিং স্টাইল দেখে আমি তাকে বোলার হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। সে আজ জাতীয় দলের আলোচিত বোলার, এটি আমার জন্য গর্বের।’
রাইজিংবিডি/সাতক্ষীরা/২২ জুন ২০১৫/সনি/নওশের