নেতা হতে হলে নাকি জনগণের বন্ধু হতে হয়। আমাদের দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির উপরে। সেই হিসেবে আমাদের দেশের প্রতিটি রজনীতিক নেতার বন্ধুর সংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। খুবই ভালো কথা, কিন্তু প্যাচটা লাগিয়েছেন ডগলাস জেরল্ড। এই মহাত্মা বলেছেন, আদর্শবান লোকের বন্ধুর সংখ্যা কম থাকে।
জ্ঞানী মানুষের বাণী অগ্রাহ্য করি কী করে? আবার যে গ্রাহ্য করব তাতেও স্বস্তি মেলে না। মরজ্বালা! তাহলে কী আমরা ধরে নেব আমাদের দেশের রাজনীতিকরা আদর্শবান নন? প্রশ্নটা সহজ উত্তরও জানা।
ফেসবুকের এ জামানায় মাউসে ক্লিক করলেই টপাটপ বন্ধু মিলে যায়। বাটপার বন্ধু, বেঈমান বন্ধু, আঁতেল বন্ধু, বাচাল বন্ধু, হিংসুটে বন্ধু, ন্যাংটা কালের বন্ধু, পোংটা বন্ধু, ব্যবসায়ী বন্ধু, বখাটে বন্ধুদের ভিড়ে আরেক নতুন বন্ধু হলো ‘অনলাইন ফ্রেন্ড’। অর্থাৎ বাড়ছে বন্ধুর রকমফের। সে তুলনায় বাড়ছে না প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা। অথচ বিপদেই যে প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় এ কথা শুধু শেক্সপিয়র বলবেন কেন, আমাদের পাড়ার শেকানুল উদ্দিন পিয়ারও সুযোগ পেলেই সে কথা বলেন। কিন্তু এতো বন্ধুর ভিড়ে প্রকৃত বন্ধু চেনার উপায়টা কী? উপায়টা বাতলে দিয়েছেন এক সেনা কমান্ডার।
রাত ভোর হলেই দলটা পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ ক্ষেত্রে রওনা হবে। কমান্ডার ইন চিফ শেষবারের মতো সৈনিকদের পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার উদ্দেশে বললেন, সেখানে তোমাদের প্রতিটি পদে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে মুক্তি বিচ্ছুরা খুবই বিপজ্জনক!
শুনে এক সৈনিক হাত উঠিয়ে জানতে চাইল, স্যার বিচ্ছু যদি কামড় দেয় তাহলে আমরা কী করব? সৈনিকটি ভেবেছিল মুক্তি বিচ্ছু সম্ভবত নতুন প্রজাতির বিচ্ছু, যা পূর্ব পাকিস্তানে দেখা যায়। যাই হোক, প্রশ্ন শুনে কমান্ডার বললেন, বিচ্ছু কামড় দিলে তৎক্ষনাৎ চুষে ক্ষতস্থান থেকে রক্ত বের করে ফেলবে।
কিন্তু আমার পশ্চাদ্দেশে বিচ্ছু কামড় দিলে কী করব? সেখানে তো আমার মুখ পৌঁছাবে না।
ডোন্ট ওরি। সেখানে তোমাদের খেদমতের জন্য রাজাকার, আলবদর বাহিনী তৈরি থাকবে। তারা সাহায্য করবে- কমান্ডার আশ্বস্ত করলেন।
তাদের আমরা চিনব কীভাবে?- সৈনিকটি বলল।
খুব সহজ। এ অবস্থায় তোমার চিমসানো, কালো, ময়লা পশ্চাদ্দেশ যে চুষে দিতে রাজি হবে সেই হলো আলবদর, রাজাকার- আমাদের প্রিয় বন্ধু।
এখন কথা হলো, সবাই তো সবার বন্ধু হতে পারে না। ডাক্তারের বেস্ট ফ্রেন্ড হতে পারে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক, ট্রাফিক পুলিশের বন্ধু ট্রাক ড্রাইভার, পুলিশের বন্ধু চোরাকারবারী, আইনজীবীর বন্ধু মামলাবাজ, আর মাতালের বন্ধু হবে মাতাল- এ তো জানা কথা। এমনি কী আর লোকে বলে, রতনে রতন চেনে, শূকর চেনে কচু।
মাতাল ঠিকই পথের সাথীকে চিনে নিতে ভুল করে না। এবং এরপর দুজনের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এর তুলনা হয় না। এই দুই বন্ধুর তখন অনেক কিছুই মিলে যায়। এই যেমন এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলছে, দোস্ত, আমি আসলে দিনে দুবারের বেশি খেতে পারি না।
শুনে বন্ধু তো বাক্যহারা। বলে কী! মাত্র দুবার? সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে জানতে চায়, কখন কখন?
এই যখন তেষ্টা পায় তখন, আর যখন পায় না তখন।
ও তাই বল, বন্ধু এবার আশ্বস্ত হয়ে বলে, আমারও আসলে প্রতিদিন খাওয়া হয় না।
তাই নাকি! তা কবে কবে চলে?
যেদিন বৃষ্টি হয় সেদিন একটু খাই, আর যেদিন হয় না সেদিন খাই।
বন্ধু শব্দটির অর্থ একেক জনের কাছে একেক রকম মনে হতে পারে। যে তরুণ ওয়ান ওয়ে রোডের মতো একটানা দেড় বছর প্রেম করার পর অবশেষে একদিন মেয়েটির মুখ থেকে শোনে, এসব তুমি কী বলছ ছদরুল! আমি তো তোমাকে এতদিন শুধু বন্ধু ভেবেই এসেছি। সেই তরুণের কাছে ‘বন্ধু’ শব্দটি চিরতার পানির মতো মনে হতে পারে।
অন্যদিকে যার জীবনে সাফল্যের পেছনে রয়েছে বন্ধুর বিরাট অবদান অথবা দুঃসময়ে জীবনে একজন বিজ্ঞ বন্ধু এসেছিল আশীর্বাদ হয়ে তার কাছে ‘বন্ধু’ শব্দটি গোলাপের খোশবাই ছড়াবে এটাই স্বাভাবিক। সিনেমায় এমন বন্ধু প্রায়ই দেখা যায়। দুই বন্ধুর হরিহর আত্মা। আন্ডারওয়্যার থেকে আনলিমিটেড ড্রিম- তারা সবকিছুই শেয়ার করে। কিন্তু ঘটনাক্রমে দেখা যায় তাদের প্রেমিকা একজনই। সাসপেন্সের মুড়িঘণ্ট!
সব জানার পর এক বন্ধু বলছে, না না বন্ধু, মলি তোর।
অন্যজন বলছে, এ হয় না, মলি তোর ছিল তোরই থাকবে।
চরম ক্লাইমেক্স। বন্ধুর জন্য বন্ধুর এই ত্যাগ দেখে বেচারা প্রেমিকা তো থ! অথচ ত্যাগের তখনও অনেক বাকি। ত্যাগের জোশে শেষ দৃশ্যে দেখা গেল এক বন্ধু দেহত্যাগই করে ফেলল। বন্ধু মানেই তো দুই দেহে এক আত্মা। ধন্য ধন্য রব উঠল চতুর্দিকে। দর্শক সিনেমা হলের চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলতে লগল, দ্যাখছ এরেই কয় স্যাক্রিফাইস! নায়িকা দুই দোস্তের আত্মাডা পাইল ঠিকই, খালি দেহডাই পাইল না।
এমন বন্ধু ভাগ্য সকলের হয় না। আর এ কারণেই কেউ বন্ধুর হাত ধরে সাফল্য ধরে, কেউ ধরে গাঁজা। অবাধ্য সন্তানকে নিয়ে বাবা-মার তাই দুশ্চিন্তার শেষ নাই। ছেলে কাজী নজরুলের প্রেমের কবিতা পড়ছিল। বাবা সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
কী পড়ছ?
প্রেমের কবিতা।
কে লিখেছে?
নজরুল।
খবরদার! ভবিষ্যতে এ ধরনের বখাটে ছেলের সঙ্গে কখনও মিশবে না। বাবা ছেলের বন্ধুবহর দেখে শঙ্কিত হয়ে সাবধান করে দিলেন।
এই বাবা জানেন না, মহামতি এরিস্টটল অনেক আগেই বলে গেছেন, যে সবার বন্ধু হয়, সে আসলে কারোরই বন্ধু নয়। তাহলে উপায়? সে উপায়ও বলে দিয়ে গেছেন আরেক মহাত্মা ইমাম জাফর আল সাদিক। তিনি বলেছেন, পাঁচ প্রকার লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার কোনো প্রয়োজন নেই। এক মিথ্যেবাদী। অর্থাৎ যে বন্ধু উত্তরায় থেকে মোবাইলে আরেক বন্ধুকে বলবে, দোছ, আমি মহাখালী, কসম কাইটা কইতাছি- দশ মিনিট খাড়া, আসতেছি।
দুই বেকুব। এই কিছিমের বন্ধুরা অনেকটা ডোন্ট মাইন্ড স্বভাবের হয়। এরা বন্ধুর প্রেমিকের কাছে চিঠি পৌঁছে দিতে গিয়ে ভুল করে প্রেমিকের মায়ের হাতে চিঠি দিয়ে আসে। এবং এসেই বলে, দোছ বাদশার হোটেলে কতদিন হালুয়া দিয়া বিরিয়ানি খাই না। আইজ না করতে পারবি না।
তিন চিমসা। পকেটের মানিব্যাগ বের করার সময় হলেই এরা আতকা উদাসীন হয়ে যায়। খসানোর উদ্দেশে এদের ধরে-বেঁধে হোটেলে নিয়ে বসালে এরা বলে, এক বছর ধরে যখন বলছিস, তখন বল কী খাবি? ঠান্ডা না গরম?
আপনি যদি তখন বলেন, যা গরম পড়ছে ঠান্ডাই খাওয়া। তখন সে হ্যাবি ভাব নিয়ে মামুকে ডাকবে, ভালো করে টেবিলটা মোছাবে, তারপর ডান হাতে তুড়ি বাজিয়ে উচ্চস্বরে বলবে, মামু এই টেবিলে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দ্যাও।
চার ভীতুর ডিম। এদের দিয়ে অন্যের আম গাছে ঢিল দেওয়া থেকে শুরু করে স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখা কোনোটাই হবে না। কারণ সে ধরা পরলে অন্য বন্ধুদের বিপদের শেষ নেই।
পাঁচ নম্বর হলো দুষ্ট পাপী। এরা হলো সুসময়ের বন্ধু। অথচ কী আশ্চর্য! আমাদের দেশের রাজনীতিকদের চারপাশে যারা বৃত্তাকারে ঘিরে থাকেন তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই অল্পবিস্তর এই গুণগুলো আছে। এখন আপনি যদি তাকে বলেন, এ ধরনের লোক আপনার বন্ধু হয় কী করে?
তিনি তখন একটুও বিব্রত না হয়ে জর্জ বার্নার্ড শ’র মতো বলবেন, আমি আমার বিশ্বস্ত বন্ধুকে যেমন ভালোবাসি, তেমনি শক্তিশালি শত্রুকেও ভালোবাসি। কারণ এরা দুজনেই আমার উন্নতির মূলে (আখের গোছানোর তালে) সমানভাবে কাজ করে।
এখন কথা হলো বন্ধুদের মধ্যে থেকে শত্রুতা নির্মূলের কী কেনো উপায় নেই?
উপায় আছে। উপায় বাতলে দিয়েছেন স্বয়ং আব্রাহাম লিংকন। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে একবার তার এক উপদেষ্টা জিজ্ঞেস করলেন, প্রেসিডেন্ট আপনি শত্রুদের প্রতি সদয় হন কেন? আমার মতে শত্রুকে খতম করে দেওয়াই উচিত।
লিংকন বললেন, আমিও তাই করি। বন্ধুত্ব হয়ে গেলেই শত্রুতা খতম হয়ে যায়।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ আগস্ট ২০১৫/তাপস রায়