মনিরুল হক ফিরোজ : ‘কেবল সেবা নয়, মানুষকে দাও তোমার হৃদয়। হৃদয়হীন সেবা নয়, তারা চায় তোমার অন্তরের স্পর্শ’—এরকম নিছক একটি বাণীই বলে যাননি, আমৃত্যু আর্তমানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সারাবিশ্বের মানুষের হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন মহীয়সী মাদার তেরেসা। সমাজের যারা বিভিন্ন দিক থেকে অবহেলিত, মাদার তেরেসা তাদেরই বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।
মানুষের মাঝে তিনি খুঁজে নিয়েছিলেন ঈশ্বরকে, তার কাছে ছিল না কোনো জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ, মানবসেবাকেই ধর্ম হিসেবে নিয়েছিলেন মাদার তেরেসা।
মাদার তেরেসার আসল নাম আগনেস গঞ্জা বয়াজু। মেসিডোনিয়ার স্কোপি শহরে ১৯১০ সালের ২৬ আগস্ট একটি ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম মাদার তেরেসার। জন্মশহর স্কোপিতে প্রাথমিক লেখাপড়া সম্পন্ন করেন তিনি। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
১৯১৯ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে মাদার তেরেসা পিতৃহারা হন। আকস্মিক এ বিপর্যয়ের ফলে তেরেসার মা ভীষণ মুষড়ে পড়েন। জীবনের এ সংগ্রাম থেকে দারিদ্র্য আর প্রতিকূলতাকে সাহস ও উদ্দীপনার সঙ্গে গ্রহণ করার তৎপরতা আবিষ্কার করেন মাদার তেরেসা। পিতার মৃত্যুর পর মা তাকে রোমান ক্যাথলিক আদর্শে লালন-পালন করেন।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিনি সন্যাসব্রত গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন তেরেসা। ১৯২৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর গৃহত্যাগ করে ‘সিস্টার্স অব লরেটো’ সংস্থায় যোগ দেন সিস্টার হিসেবে। মা আর দিদিদের সঙ্গে মাদার তেরেসার আর কোনোদিন দেখা হয়নি।
তৎকালীন সময়ে ভারতে বাংলায় ধর্মীয় কাজ করতেন যুগোস্লাভিয়া ধর্মযাজকরা। তাদের সিদ্ধান্ত ছিল, লরেটা সিস্টারদের মধ্যে যারা আইরিশ সম্প্রদায়ভুক্ত তারা যাবেন ভারতবর্ষের মতো এলাকায় কাজ করতে। মাদার তেরেসা তাই তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ শুরু করতে চাইলেন। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের দার্জিলিংয়ে ১৯২৮ সালে সন্ন্যাসিনী হওয়ার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন তিনি। ১৯২৯ সালের ৬ জানুয়ারি কলকাতা পৌঁছলেন। ১৯৩১ সালের ২৪ মে সর্বপ্রথম দারিদ্র্য, বার্ধক্য ও সংযমের সাময়িক সংকল্প গ্রহণ করেন তেরেসা। লরেটো কনভেন্ট স্কুলে শুরু হলো তার শিক্ষিকা জীবন। পাশাপাশি তিনি একটি হাসপাতালেও কাজ করতেন। সেখানেই সর্বপ্রথম দুঃখ ও দারিদ্র্যের সঙ্গে তাকে সংগ্রাম করতে হয়, যা ছিল তার কল্পনারও বাইরে। শিক্ষিকা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভালো এবং সফল। ১৯৩৭ সালের ১৪মে সিস্টার তেরেসা তার জীবনের গতি পরিবর্তনের চিন্তা করে সন্ন্যাসিনীর জীবন বেছে নেন।
দুস্থ মানুষকে সাহায্য করার কাজটি যেন তার কাছে নেশার মতো হয়ে গেল। আর্তমানবতার সেবা করার জন্যই যেন তার জন্ম হয়েছে। আজীবন এটাই তিনি করতে চান। এরপর সত্যি সত্যি তিনি সম্পূর্ণভাবে মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করার সংকল্পে লরেটো স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন।
তিনি যখন লরেটো স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিলেন, তখন তার হাতে ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। এ রকম নিঃস্ব অবস্থাতেই তিনি স্কুলের সাজানো ফুলের বাগান, স্নিগ্ধ পরিবেশ, সুখময় নিশ্চিন্ত জীবন ফেলে এসে আশ্রয় নিলেন শিয়ালদহ রেলস্টেশন-সংলগ্ন এক পুরোনো ভাঙাবাড়িতে। কলকাতার অলিগলি আর বস্তিতে ঘুরে বেড়াতে থাকেন, উদ্দেশ্য অসহায় মানুষেদের সেবা করা।
এরপর মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা করেন ‘মিশনারিজ অব চ্যারিট’। যার শাখা বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে।
১৯৫২ সালে এই চ্যারিটির অধীনেই গড়ে উঠে ‘নির্মল হৃদয়’, কুষ্ঠ রোগীদের জন্য ‘শান্তি নগর’। ১৯৫৫ সালে স্থাপন মাদার তেরেসা স্থাপন করেন ‘নির্মল শিশুভবন’। ১৯৬৩ সালে গড়ে তোলা হয় ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’-এর ব্রাদার শাখা। মাত্র ১২ জন সদস্য নিয়ে যে চ্যারিটির যাত্রা শুরু হয়েছিল সময়ের ব্যবধানে তা কয়েক হাজারে পৌঁছায়। তারা সবাই বিভিন্ন দেশের প্রায় ৪৫০টি সেবা কেন্দ্রে মানবসেবার কাজ করে যাচ্ছিল।
ভারতের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশের দু:স্থ মানুষদের সেবা করার জন্য ভারতের বাইরে প্রথমবারের মতো ১৯৬৫ সালে ভেনিজুয়েলায় মিশনারি অব চ্যারিটির শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৮ সালে রোম, তানজানিয়া এবং অস্ট্রিয়াতে শাখা খোলা হয়। ১৯৭০-এর দশকে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েক ডজন দেশে শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।
মানবতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মাদার তেরেসা ঘুরে বেড়িয়ে ছিলেন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। সব বাঁধা পেরিয়ে গড়ে তোলেন মানবতার বিরল দৃষ্টান্ত। সবচেয়ে যারা গরিব, সবচেয়ে করুণ যাদের জীবন- তাদের সেবা করাই ছিল মাদার তেরেসার ব্রত। ১৯৪৮ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনি ভারতের নাগরিকত্ব লাভ করেন। আমৃত্যু পর্যন্ত তিনি অসহায় মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর কলকাতার মাদার হাউসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহাত্মা নারী।
তিনি জীবনে বিভিন্ন সরকার ও প্রতিষ্ঠান থেকে বহু পুরস্কার পেলেও এ নিয়ে তার কোনো গর্ব ছিল না বরং তিনি পুরস্কার হাতে নিয়ে বিব্রত কণ্ঠে বলতেন, ‘আমি অতি ক্ষুদ্র। আমার শক্তি আমার কর্মবাহিনী আর জনগণের ভালোবাসা। এ পুরস্কার তো তাদের প্রাপ্য।’
মাদার তেরেসা প্রথম পুরস্কার পান ১৯৬২ সালে। ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করে। পরে দুস্থ মানবতার সেবায় আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতিস্বরূপ মাদার তেরেসা ১৯৭৯ সালে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ১৯৭১ সালে পোপ জন শান্তি পুরস্কার, ১৯৭২ সালে জওহরলাল নেহরু, ১৯৮০ সালে ভারতরত্ন, ১৯৮৫ সালে প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম, ১৯৯৪ সালে কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল সহ বিভিন্ন দেশের অসংখ্য পুরস্কার ও সাম্মানিক উপাধিতে ভূষিত হন। কলকাতার স্বর্গীয় টেরিজা হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে মাদার তেরেসাকে।
জাতিসংঘ মাদার তেরেসার গড়া মিশনারি অব চ্যারিটি সংগঠনটিকে সম্মাননা জানাতে প্রচলন করেছিল, সেরেস মেডেল। এ মেডেলের এক পিঠে ছিল ভিক্ষাপাত্র হাতে অপুষ্টিতে ভোগা একটি শিশুর মূর্তি আর অন্য পিঠে মাদার তেরেসার ছবি।
মাদার তেরেসার সবচেয়ে বড় অর্জন বলা যায়, তার দেখিয়ে দেওয়া আদর্শকে। তার আদর্শের মৃত্যু হয়নি। তার আদর্শ নিয়ে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ‘মিশনারিজ অব চ্যারিটি’ এর লাখো সিস্টার মানবসেবায় নিয়োজিত আছেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ আগস্ট ২০১৫/ফিরোজ