দিলারা হোসেন : আজ বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত রাগীদের প্রতি করণীয় ও রোগ নিরূপণে সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রতি বছরের জানুয়ারি মাসের শেষ রোববার বিশ্বব্যাপী ১০০টিরও বেশি দেশে বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস পালন করা হয়।
কুষ্ঠ মানবসভ্যতার একটি প্রাচীনতম রোগ। প্রায় চার হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে এ রোগের। অদ্যবধি কুষ্ঠ পৃথিবীব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে বিরাজ করছে। কুষ্ঠ জীবাণুঘটিত রোগ। এই রোগের টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এটি নির্মূল ও প্রতিরোধের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আক্রান্ত দেশসমূহ একযোগে কাজ করছে। ভয়, কুসংস্কার এবং লজ্জার কারণে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তরা এটিকে প্রকাশ করতে চান না বা চিকিৎসা গ্রহণে কুণ্ঠাবোধ করে থাকেন।
বলা হয়ে থাকে সমাজ কুষ্ঠ রোগীকে ভয় পায় আবার কুষ্ঠ আক্রান্তরা সমাজকে ভয় পায়।
অধিক জনসংখ্যা এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ রোগটি ছড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৮০টি দেশে এ রোগের বিস্তার রয়েছে। ভারত, নেপাল, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, সোমালিয়া, লাইবেরিয়া ইত্যাদি দেশে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশে প্রতি দশ হাজার জনে ০.৬ জন এ রোগে আক্রান্ত এবং প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, সিলেট, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বগুড়া ও ঢাকা জেলায় এর প্রাদুর্ভাব রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিভিন্ন এনজিও সমন্বিতভাবে কাজ করে চলেছে রোগটি নির্মূলের জন্য।
‘কুসংস্কারই’ কুষ্ঠ চিকিৎসা ও প্রতিরোধে মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করে। অথচ সময়মতো ও সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে এটি একটি পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ। প্রচলিত কুসংস্কারগুলোর একটি হচ্ছে ‘পাপিষ্ঠ ব্যক্তি বা তাদের বংশধরগণ’ এ রোগে আক্রান্ত হয়। বাস্তবে মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি নামে একটি জীবাণু এ রোগের জন্য দায়ী।
১৮৭৩ সালে নরওয়ের বিজ্ঞানী ডা. আরমান হ্যানসেন এ রোগের জীবাণু আবিষ্কার করেন বলে এটি হ্যানসেন ডিজিস নামে পরিচিত। ১৮৭৩ সালে কুষ্ঠ জীবাণু আবিষ্কারের ফলে এ রোগের কারণ সম্পর্কে মানুষ নিশ্চিত হয়। কিন্তু ১৯৬০ সাল পর্যন্ত কুষ্ঠ রোগের কার্যকর চিকিৎসা মানুষের আয়ত্বের বাইরেই থেকে যায়। ১৯৬০ সালে মার্কিন চিকিৎসা বিজ্ঞানী জন শেফার্ড ইঁদুরের দেহে কুষ্ঠ রোগের জীবাণুর বংশবিস্তার আবিষ্কারের কারণে কুষ্ঠ রোগের কার্যকর ওষুধ আবিষ্কার করা সম্ভবপর হয়েছে। বর্তমানে কুষ্ঠ চিকিৎসায় ব্যবহৃত অত্যন্ত কার্যকর মাল্টি ড্রাগ থেরাপি এ আবিষ্কারেরই ফল, যা ১৯৮২ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে।
কুষ্ঠ রোগে মূলত প্রান্তিক স্নায়ু আক্রান্ত হয় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চামড়ার মাধ্যমে এ রোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। জীবাণু সাধারণত ত্বক এবং ত্বকের নিকটবর্তী স্নায়ুকলাকে আক্রান্ত করে। আক্রান্ত স্থান অপেক্ষাকৃত বিবর্ণ হয়ে থাকে। স্নায়ু আক্রান্ত হলে স্থানটি অবশ হয়ে থাকে। কুষ্ঠ হলে হাত, পা বিকলাঙ্গ হতে পারে। চোখ নাড়ানোর ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। ত্বক শুষ্ক ও রুক্ষ হয়ে যায়। অনুভূতি কমে যাওয়ার কারণে আগুনে পোড়া বা অন্যান্য দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সব বয়সীরাই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে নারীদের চেয়ে পুরুষরা এ রোগে আক্রান্ত হয় বেশি।
রোগী ও সমাজকে সচেতন করার মাধ্যমে অনেকাংশেই এ রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। আমাদের দেশে বিনামূল্যে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের কারণে অনেকেই আক্রান্ত হওয়ার পরও চিকিৎসা কেন্দ্রে যেতে চায় না। এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য। সময়মতো ওষুধ গ্রহণ করলে কোনো জটিলতা হয় না। তবে জটিলতার কারণে শল্য চিকিৎসা ও ফিজিওথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে।
কুষ্ঠ জীবাণুঘটিত রোগ। এটি অভিশাপের ফল নয়। এজন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা সৃষ্টি করা।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ জানুয়ারি ২০১৬/দিলারা/টিপু