সাতসতেরো

বন্যার সতর্কতা এখনই

রিশিত খান : প্রতিদিনই বন্যা পরিস্থিতি অবনতি ঘটছে। ইতিমধ্যে দেশের নয়টি জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বাড়তে শুরু করেছে। নদী তীরবর্তী এলাকাগুলোতে ইতিমধ্যে বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করেছে। এর ফলে এসব এলাকার কয়েক হাজার লোক বাড়িঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। প্রতিদিনই পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। আগামী কয়েকদিন বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটতে পারে বলে জানানো হয়েছে। দুর্গত এলাকায় স্বাভাবিকভাবেই বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

 

বন্যার পানিতে ডুবে গেছে শত শত একর ফসলি জমি। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় অনেক এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ায় অনেক এলাকায় শ্রমিকদের কাজ-কর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই এসব অতি দরিদ্র শ্রেণির মানুষের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। দুর্গত কয়েকটি এলাকায় সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য ত্রাণ বিতরণ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ওইসব এলাকায় ১০ হাজার মেট্রিক টন চাল এবং সাড়ে ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় এই ত্রাণ নিতান্তই কম। 

 

বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। টর্নেডো, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বর্ষণ-বন্যা বাঙালির জীবনের সঙ্গে আষ্টে পৃষ্ঠে বেধে আছে। এদেশে প্রতিবছর কম বেশি বন্যা হয়। বিশ্বের প্রধান দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোর একটি হলো বাংলাদেশ। গত দেড় যুগে আসিয়ান ও সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। চলতি শতকের ১২টি ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ের ৯টিই হয়েছে এই দেশে। তা ছাড়া জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখী, বন্যা এবং ভূমিকম্পের মতো পৌনঃপুনিক উপদ্রব তো আছেই।

 

এ বছর বন্যায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশেষজ্ঞ মহল। এবার আষাঢ়ের শুরুতেই প্রবল বর্ষণে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে উত্তরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। সেই সঙ্গে ব্যাপক আকারে নদী ভাঙনে ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, আবাদি জমি ও ঘর-বাড়িসহ বিস্তীর্ণ জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় প্রায় ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার মানুষ হয়েছে গৃহহারা। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ফসলের।

 

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জসহ ১১টি জেলার বন্যাকবলিত এলাকায় লাখ লাখ হেক্টর ফসলি জমি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। পাশাপাশি করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, পদ্মাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর ভাঙনও শুরু হয়েছে।

 

গত প্রায় ১০ বছর দেশে বড় রকমের কোনো বন্যা হয়নি। তবে বর্ষণ মৌসুমের শুরু থেকেই ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এবার বড় ধরনের না হলেও মাঝারি আকারের বন্যা হতে পারে।

 

অনেক দিন যাবতই বর্ষণ এবং বন্যা পরিস্থিতির অবনতি তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থান উপমহাদেশের একটি বৃহৎ নদী ব্যবস্থার ভাটি এলাকায়, সুতরাং বন্যায় ঝুঁকি এখানে প্রতিবছরই থাকে। তাই ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য প্রয়োজন হলো আবহাওয়া, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধির ওপর নজর রাখা। বন্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগাম প্রস্তুতি ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা এখনই ভাবতে হবে।

 

ষড়ঋতুর এই দেশে বর্ষার হাত ধরেই বন্যা আসে। আষাঢ় শ্রাবণ দুমাস বর্ষাকাল। দুমাসের অবিশ্রান্ত বর্ষণ আর উত্তরের পাহাড়ি ঢল- এ দুয়ের যোগফলই হচ্ছে ভাটি অঞ্চলের এই দেশটির প্লাবন। নিয়ম অনুযায়ী এটি ভাদ্র মাসে হওয়ার কথা।

 

আবহমান কাল ধরে তাই হয়ে আসছে। নিয়মের ব্যত্যয় যে একেবারে হয়নি তাও নয়। ৪০/৫০ বছর আগেও দেখে গেছে নিয়ম ভঙ্গ করে ভাদ্র ছেড়ে আশ্বিনে গিয়ে বন্যা হয়েছে কিংবা কখনও মধ্য শ্রাবণেই সারাদেশ সয়লাব। কিন্তু এমন ব্যতিক্রম ঘটেছে কদাচিত। সাম্প্রতিককালে এই অনিয়মেই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। দুই এক বছর বাদে প্রায়ই আষাঢ়-শ্রাবণে বন্যা হচ্ছে। আবার ভাদ্রেও শেষেও হচ্ছে। বছরে তিনবার বন্যার রেকর্ডও রয়েছে এই জনপদে।

 

কেন এমন হয়? একথা সবার জানা যে, নানা কারণে প্রকৃতি ও পরিবেশ এমন বিরূপ আচরণ করে। দেখা যায় দিনের পর দিন বৃষ্টি নেই, দেশব্যাপী মহাখরা, মাটি ফেটে চৌচির। আবার দেখা যায়, বৃষ্টি যখন এলো তো একেবারে লাগাম ছাড়া। কখনও দেখা যায়, আমাদের কালবৈশাখীর আদলে ঝড় উঠেছে চৈত্রেই, আবার জ্যৈষ্ঠ মাসেই শ্রাবণের মতো অঝোরে বৃষ্টি নামছে।

 

একইভাবে দেখা যায়, আমাদের নদ-নদীর উৎসস্থল উজান দেশের পাহাড়ে আগেভাগেই বরফ গলছে, ধস নামছে এবং পাহাড়ি ঢল হয়ে অসময়ে দেশের নদ-নদী উপচে পড়ছে। উজান দেশে বাঁধ দিয়ে আমাদের একটি প্রধান নদী পদ্মাকে মৃতপ্রায় করে ফেলা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও অন্যান্য নদীতেও উজান থেকে পলি এসে তা প্রায় ভরাট করে ফেলছে। পূর্বের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম পানিতেও নদ-নদী উপচে ভয়ংকর বন্যা দেখা দিচ্ছে দেশজুড়ে। ধ্বংস করছে ঘরবাড়ি, গবাদিপশু। ক্ষতি হয় হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ।

 

প্রকৃতির খেয়ালের ওপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যা ঘটার তাই ঘটছে। তবু বিজ্ঞানের এই অগ্রগতির যুগে মানুষের ওপর প্রকৃতির আক্রমণ যাতে আমাদের বিপন্ন করে না তোলে তার ব্যবস্থা গড়ে তোলাই আধুনিক মানুষের কর্তব্য। ভূমিকম্পনপ্রবণ জাপান সমস্যার সমাধান করেছে কাঠের বাড়ি তৈরি করে। সাইক্লোনপ্রবণ ফিলিপাইন আগাম সংকেত ও সময়ে নিরাপদ অঞ্চলের মানুষকে সরাবার ব্যবস্থা করে ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুকে কমাতে পেরেছে। 

 

প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে বিজ্ঞান অবশ্যই কার্যকর। স্যাটেলাইট মারফত আমরা আসন্ন দুর্যোগের সংবাদ অনেক আগেই পেতে পারি। ভূমিকম্পের পূর্ব সংকেত পাওয়া যায় না, ঝড়-তুফানের পূর্বাভাস পাওয়া সম্ভব নয়- নয় বন্যারও। আমরা যে অঞ্চলে বসবাস করি সেই ভৌগোলিক অবস্থানে সামুদ্রিক নিম্নচাপঘটিত আবহওয়ার দস্যুপনার বাৎসরিক ঘটনা কোনো বছর বেশি, কোনো বছর কম, আবার কোনো বছর সাংঘাতিক। বিজ্ঞান আমাদের সতর্ক করলেও আমাদের প্রশাসন বিজ্ঞানকে পাত্তা দিতে চায় না। ঘূর্নিঝড়ে গ্রামকে গ্রাম বিধ্বস্ত হয়ে যাক ঘোর অন্ধকারে, ঘোর দুর্যোগে মানুষ বিপন্ন হোক- হয়ে যাক বছরের পর বছর, তাতে শাসকদের কিছু যায় আসে না। কারণ একটি সহজ দৃষ্টিভঙ্গি আছে আমাদের শাসক মহলে। গ্রাম মানে গ্রাম। ফলে গ্রামের প্রতি শাসক শ্রেণি বা শহরের মানুষেরও দৃষ্টি কম।

 

সঠিক এবং কার্যকর উদ্যোগ নিলে বন্যা করায়ত্ত অসম্ভব নয়। উজানের পানি নেমে আসা বন্ধ করতে পারলে, সেই সঙ্গে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোর পানির ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, গতিপথ সহজ করতে পারলে হয়তো প্রতি বছরের বন্যার আশঙ্কা, ভয়াবহ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি বহুলাংশে হ্রাস করা যেতে পারে। নদ-নদীগুলোর গভীরতা হ্রাস শুধু বন্যাই কারণ হয় না, শুষ্ক মৌসুমে নদ-নদীর পানি শূন্যতাও বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রকৃত ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ওপর প্রভাব ফেলে।

 

প্রতিবছর বন্যায় বাংলাদেশের যে আর্থিক ক্ষতি হয়, মানুষের দুঃখ-দুর্ভোগ যেভাবে বৃদ্ধি পায় তা থেকে রেহাই পেতে হলে অন্তত নদ-নদীগুলোর গভীরতা বৃদ্ধি, নাব্যতা, প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ আবশ্যক। দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই যে, প্রতিবেশী দেশ ভারত কর্তৃক নির্মিত ফারাক্কাসহ বিভিন্ন বাঁধ সমস্যার স্থায়ী সমাধান ও বন্যার কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি মাত্র উপায় হচ্ছে ড্রেজিং ব্যবস্থা।

 

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ড্রেজিং ব্যবস্থা জোরদার করা না হলে আগামী ২০/২৫ বছরের মধ্যে দেশের সব নদ-নদী বিপদজ্জনকভাবে নাব্যতা হারাবে। এক হিসাব মতে, ইতিমধ্যেই প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার নদ-নদীর বেশির ভাগ ভরাট হয়ে গেছে। জানা যায়, দেশের বার্ষিক ড্রেজিং চাহিদা প্রায় ৫১৮ লাখ ঘনমিটার। ড্রেজিং ক্যাপাসিটির আশু বৃদ্ধি না ঘটালে অচিরেই  নদীগুলো যে মরে যাবে তা বলাই বাহুল্য। তার মানেই দেশে প্রতিবছর অতি বন্যা দেখা দেওয়া।

 

বর্তমানে দেশে বন্যার প্রকোপ বেড়ে যাবার যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ও বন্যাপ্রবণ এলাকার জনগণের এখনই পর্যাপ্ত সতর্কতা ও প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, বিশেষ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের উচিত হবে এখন থেকেই এ ব্যাপারে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা, যাতে প্রয়োজন মুহূর্তে আনুষঙ্গিক করণীয় নির্ধারণে কোনো রকম সমস্যার পড়তে না হয়।

 

বন্যা পরিস্থিতির গতি প্রকৃতি নিয়ে এখনও নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। অনেক নদীতে এখনও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত  আছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। ফলে দুর্গত মানুষের সংখ্যা যেমন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি বাড়ছে দুর্ভোগের মাত্রাও। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও ওষুধের  সবচেয়ে সংকট তো আছেই, সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে দুর্গত এলাকাগুলোয় এখন কোনো কাজকর্ম হচ্ছে না। ফলে প্রকটতর হচ্ছে অর্থাভাবও। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কোনো কাজকর্ম পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

 

আমাদের দুর্ভাগ্য, বন্যার ক্ষয়ক্ষতিকে সর্বনি¤œ পর্যায়ে রাখার জন্য আমাদের কোনো সময়ই মাথাব্যথা নেই। বন্যাত্রাণ পুনর্বাসনের সব সময়ই বিলম্ব ঘটে এবং ত্রাণসহ প্রায় ক্ষেত্রে অপ্রতুল থাকার অভিযোগই শুনতে হয়। অন্যদিকে ডায়রিয়া, আমাশয় বা বন্যাজনিত নানা রোগ গাফিলতির দরুন ফি বছর বহুক্ষেত্রেই মহামারি আকার ধারণ করে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ও দুর্ভোগ ডেকে আনে।

 

স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্গত মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার,  বিশুদ্ধ পানি ও জরুরি ওষুধ সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। কাজের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ নিতে হবে।

 

বন্যার সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার কারণে অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তা ছাড়া বিভিন্ন স্থানে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলোও রক্ষণাবেক্ষণ জোরদার করা উচিত। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতি থাকবে এটাই প্রত্যাশিত।

 

লেখক : জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যমকর্মী

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুলাই ২০১৬/রিশিত/মুশফিক