বি এম ফারুক, যশোর : ঐতিহাসিক যশোর রোড। এই রোড ঘিরে আছে অনেক গল্প-গান। মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষ জীবন বাঁচাতে এই পথ দিয়েই ভারতে আশ্রয় নেন। ব্রিটিশ রাজের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো ‘যশোর রোড’। যশোর রোড নিয়ে গান গেয়েছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক। বিখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ লিখেছিলেন ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড।’September on Jessore Road কবিতাটির কয়েকটি লাইন এরকম:
Millions of souls nineteenseventyone
homeless on Jessore road under grey sun
A million are dead, the million who can
Walk toward Calcutta from East Pakistan
Taxi September along Jessore Road
Oxcart skeletons drag charcoal load
past watery fields thru rain flood ruts
Dung cakes on treetrunks, plastic-roof huts
Wet processions Families walk
Stunted boys big heads don`t talk
Look bony skulls & silent round eyes
Starving black angels in human disguise
অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল যার মধ্যে একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুনীলের বাড়িতেই উঠেছিলেন। তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। তাই সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তার সাথে সুনীলও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন। আর সেই অভিজ্ঞতা থেকেই গিন্সবার্গ এই কবিতাটি লিখেছিলেন। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে এই দীর্ঘ কবিতাকে সুর দিয়ে গানে রূপ দিয়েছিলেন তিনি। তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যান্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় এই গান গেয়ে কনসার্ট করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন গিন্সবার্গ।‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি পড়লে বর্বর পাকিস্তানিদের নির্মম নৃশংস গণহত্যার চিত্র যেনো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চোখ ভিজে ওঠে এবং মন মুহূর্তেই চলে যায় সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের একাত্তরের রণাঙ্গণে। ১৫২ লাইনের লেখা মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে কালজয়ী কবিতাটির পঙক্তিমালাগুলো এখনও জীবন্ত। এটিকে শুধু কবিতা নয়, বলা যায় ‘অশ্রুঝরা অমর মহাকাব্য’ ।এই বিখ্যাত কবিতাটি বাংলায় ভাষান্তর করেন খান মোহাম্মদ ফারাবী, যেটি পড়লে চেখে পানি আটকে রাখা যায় না। দুই বাংলার জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী মৌসুমি ভৌমিক অত্যন্ত আগ্রহ ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই বাংলা কবিতার ভাবানুবাদ করেন এবং সুরারোপ করে গানাকারে নিয়ে আসেন। মৌসুমি ভৌমিকের কণ্ঠে এই গানটি শুনলে হৃদয় ছুঁয়ে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।শত শত চোখ আকাশটা দেখেশত শত শত মানুষের দলযশোর রোডের দু-ধারে বসতবাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল..মৌসুমি ভৌমিকের গাওয়া এ গানটির ভিডিও লিঙ্ক :
এই যশোর রোডের শুরুর ইতিহাসটা আরেকটু অন্যরকম। সে গল্পটি এ রকম- সত্যিকারের গল্প হচ্ছে, যশোরের জমিদার কালী পোদ্দারের মা গঙ্গা স্নানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু কালী পোদ্দার কৃপণ জমিদার। একারণে বজরার মাঝি কালীর মাকে বজরায় উঠতে দেয়নি। মাঝি বলেছে, ‘তোমাকে নিলে কড়ি পাওয়া যাবেনা।’ মা মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে এ কথা কালী পোদ্দারকে জানান। এ’কথায় কালী আবেগ তাড়িত হন। তিনি মা গঙ্গা স্নানে যাবেন বলে সড়ক নির্মাণের ব্রত গ্রহণ করেন। তিনি ১৮৪০ সালে যশোর শহরের বকচর থেকে ভারতের নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু করেন। হাজার হাজার শ্রমিক রাত-দিন কাজ করে ১৮৪২ সালে সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ করেন। সে সময় সড়ক নির্মাণে দুই লাখ ৫৮ হাজার কড়ি ব্যয় হয়েছিল। এরপর মা ছায়ায় ছায়ায় গঙ্গা স্নানে যাবেন এজন্য রাস্তার দুই ধারে কালী বাবু বিদেশ থেকে এনে অতি বর্ধনশীল রেইন্ট্রি বৃক্ষের চারা রোপণ করেন। সেই বৃক্ষগুলো যশোর-বেনাপোল রোডকে এখনো ছায়া দিচ্ছে। যশোর থেকে কলকাতা কালী বাবুর এই রাস্তার নাম ‘যশোররোড’। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী যশোর রোড তৎকালীন পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃসড়ক ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর সড়কটির ব্যবহার কিছুটা হ্রাস পায়। তবে দু’দশের লোক ও পণ্য চলাচলে তখনও এটি ছিল প্রধান সড়ক। ৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর এটি কার্যত ‘কানা গলিতে’ পরিণত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সড়কটি পুনরায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বৃষ্টি আর কাদাপানি উপেক্ষা করে সেদিন লাখ লাখ মানুষ এই পথ ধরেই অজানার উদ্দেশে ঘর ছেড়েছিলেন। পেছনে যুদ্ধ ও মৃত্যু এবং সম্মুখে অসীম অনিশ্চয়তার মাঝে নিজ দেশ ছেড়ে এসব মানুষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমিয়েছিলেন।তারা পিছনে ফেলে গিয়েছিলেন প্রিয়জনের লাশ। তাদের অনেকেই আর দেশে ফেরেননি। পথেই সর্বস্ব খুইয়ে তারা হারিয়ে গেছেন ইতিহাসের অতলে। যারা দেশে ফিরেছেন তারা দুর্বিষহ দিনগুলোর স্মৃতি আজো বয়ে বেড়াচ্ছেন কালের সাক্ষি হয়ে।৭১’ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাক সেনাদের ভয়ে যখন লাখ লাখ মানুষ যশোর রোড দিয়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়ের আশায় ছুটছিলেন, তখন যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার শাহাবুদ্দিন মাস্টারও পথে নেমেছিলেন নিজেকে বাঁচানোর আশায়। সে সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘যশোর রোড ধরে যেতে যেতে দেখি, এক জায়গায় এক বৃদ্ধ দম্পতি বসে আছেন। বৃষ্টি-কাঁদা ভেঙে তারা আর এগুতে পারছেন না। পাশেই একটি রিকশা পড়ে ছিল। তার কোন চালক ছিল না। ওই রিকশায় বৃদ্ধ দম্পতিকে তুলে কিছুদুর এগিয়ে দেই।’ তিনি বলেন, ‘যেতে যেতে পথে আরো অনেক হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখেছি। এক নারীর শিশু সন্তানটি মারা গেছে। কিন্তু দাফন করার কোন সুযোগ নেই। অগত্যা শিশুটির লাশ পাতায় মুড়িয়ে এক জঙ্গলের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়।’১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর এই সড়ক দিয়ে প্রথম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম শত্রুমুক্ত যশোর শহরে আসেন কলকাতা থেকে। তাঁরা যশোর টাউন হল মাঠে জনসভা করেন। এটিই বাংলাদেশ সরকারের প্রথম বিজয় সমাবেশ। এরপর এই পথে মুক্তিযোদ্ধা, মিত্র বাহিনী বাংলাদেশের বিজয় পতাকা উড়িয়ে ছুটে এসেছে। পরবর্তী সময়ে সেই পতাকা সগর্বে সারা বাংলাদেশে উড়েছে। একারণে যশোর রোডটি এক ঐতিহাসিক মাত্রা পেয়েছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই রোডের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।কালী পোদ্দারের সেই যশোর রোড আজ নেই, বাংলাদেশ অংশে যা আছে তা যশোর-বেনাপোল সড়ক। কালীগঞ্জ হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত দীর্ঘ ৭০ কিলোমিটার এই রাস্তার দু’ধারে শত শত সাইনবোর্ডে আজ শোভা পাচ্ছে ‘বেনাপোল রোড’। কিন্তু বেনাপোল সীমান্ত পেরুলেই ভারতের পেট্রাপোল থেকে শুরু করে কলকাতার গঙ্গা তীরের কালীঘাট মন্দির পর্যন্ত রাস্তাটি আজও যশোর রোড নামে ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আছে।
রাইজিংবিডি/যশোর/১ সেপ্টেম্বর ২০১৬/ফারুক/শাহ মতিন টিপু