বাঙালির জীবনে চাঁদের অবদান একেবারে কম নয়। ল্যাংটা কালে ‘আয় আয় চাঁদ মামা’ থেকে শুরু করে বুড়ো বয়সে রোগে কাতর হয়ে দু’চোখে চাঁদ-তারা দেখতে দেখতে চিকিৎসার জন্য চাঁদ মার্কা রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত ঐ চাঁদই শেষ ভরসা। ভরসার এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ আরো আছে। মায়ের কোলে খোকার কান্না কিছুতেই থামছে না। ছেলে ভুলানো এ-কথা সে-কথা কোনো কিছুতেই মন ভুলছে না যাদুসোনার। অবশেষে কান্না থামাতে মা কোলে করে খোকাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এসে সোজা চাঁদের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ঐ দ্যাখ চাঁদের বুড়ি!
ব্যাস্ চাঁদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খোকার কান্না প্রায় থেমেই গেল। এই সুযোগে মা শুরু করলেন চাঁদের বুড়ির গল্প। এবার মায়ের কোলে খোকার ফোকলা হাসি দেখে কে!
চাঁদ দেখে কেউ হাসেন, আবার কেউ কাদেন। রোজার চাঁদ দেখে যে ব্যবসায়ী খুশীতে বগল বাজান সেই ব্যবসায়ীই আবার উনত্রিশ রোজা শেষে আকাশে ঈদের চাঁদ দেখে মনে মনে বলেন, একদিন পর উঠলে কী এমন ক্ষতি ছিল বাপু!
ত্রিশ রোজা মানেই একদিন বেশি বিক্রি। আর বেশি বিক্রী মানে বেশি লাভ। চাঁদাবাজরাও তক্কে তক্কে থাকে আকাশে ঈদের চাঁদ ওঠার। ওটা তাদের উপলক্ষ। ইদানিং শিখণ্ডিদেরও তাই দেখছি। টাস টাস দুহাতে তালি বাজিয়ে ঠিক আপনার সামনেই চাঁদমুখটা বাড়িয়ে দিয়ে বলবে, অই দ্যাহোস না চান উঠছে। দিবি না ক্যা? দে দে। এমতাবস্থায় দিলে ভালো, না দিলে কতটা মন্দ হবে ইজ্জতটা বেরিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বুঝতে পারবেন না। তারাও চাঁদের অপেক্ষায় থাকে। ওদিকে গায়ে সরিষার তেল মেখে সিঁদ কাটতে যায় যে সিঁদেল চোর, পূর্ণিমার চাঁদ তার কাছে পোড়া রুটি। পৃথিবীর তাবত মানুষ পূর্ণিমা দেখে যতোই বিমোহিত হোক সে বেচারা পেশার খাতিরে অমাবস্যার পূজারি। তবে চাঁদমুখের পূজারি যে সবাই এটা মুখ না খুলেই বলা যায়। অথচ তাদের অনেকেই জানেন না পুরো চাঁদটাই নাকি পাহাড়, উপত্যকা আর বেসাইজ ছোট-বড় গহ্বরে ভরা।
আমাদের জগাদা’র কথা বলি। জগাদা বৌদির প্রেমে পড়েছিলেন বৌদির চাঁদমুখ দেখে। চন্দ্রিমা উদ্যানে চাঁদনি বৌদির সাথে যেদিন তার প্রথম ডেটিং সেদিনই কেস ফিটিং করে দিয়েছিলাম আমরা। হাতেনাতে কট খেয়ে জগাদা জেলির মতো গলে গেলেন। চাঁদনি বৌদিও তথৈবচ! তো তো করছিলেন; আমরা ঠোঁটে আঙুল চেপে বলেছিলাম- থাক থাক যা বোঝার বুঝে গেছি। আর কিচ্ছু বলতে হবে না। তিনি তারপরও লাজুক কণ্ঠে বলেছিলেন-বিচ্ছু!
সেদিন চান মিয়ার প্যাকেট বিরিয়ানীতে শেষ রক্ষা হয়েছিল জগাদার। শুনেছি বিয়ের পর জগাদা মধুচন্দ্রিমা যাপন করতে বৌদিকে নিয়ে আফ্রিকার চাঁদ দেশে গিয়েছিলেন। সেই থেকে জগাদা চাঁদের ভক্ত। একদিন তো আমদের বলেই ফেললেন, জানিস পূর্ণিমার চাঁদ আমার খুউব পছন্দ! আমরা চোখ বড় বড় করে জানতে চাইলাম, কেন?
জগাদা বললেন, চাঁদের অবদান একবার ভেবে দেখ, দিনে সূর্য আলো দেয়। কিন্তু রাতে চাঁদের আলোই তো আমাদের ভরসা। হা ঈশ্বর! জগাদাকে কে বোঝাবে চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই। জগাদা অবশ্য এটা বুঝলেন বিয়ের দুই বছর পর।
পারিবারিক অভাব-অভিযোগ, ক্যাসেট প্লেয়ারের মত সারাদিন বৌয়ের ঘ্যানর-ঘ্যানর শুনতে-শুনতে চিন্তায়-চিন্তায় জগাদার মাথায় চাঁদের মতো যখন ‘চাঁদি’ উঠল তখন জগাদা সেই চাঁদিতে হাত বোলাতে বোলতে একদিন বলেই ফেললেন, যমরাজের অর্ধচন্দ্রে জীবনের চাঁদ এখন ডুবে গেলেই বাঁচি!
চাঁদের সঙ্গে জোয়ার-ভাটার সম্পর্ক আছে, তাই বলে জীবন-মৃত্যুরও সম্পর্ক আছে এটা জানা ছিল না। জানলাম পড়াশোনা শেষ করার পর। নদীতে কত জোয়ার আসে যায় কিন্তু চাকরির ইন্টারভিউয়ের কার্ড আর আসে না। শেষ পর্যন্ত অস্তিত্ব বাঁচাতে চাঁদাবাজী শুরু করবো কিনা এমন যখন ভাবছি, ঠিক তখনই একদিন আমাকে চমকে দিয়ে কার্ড এলো। কোম্পানির নাম মুনলাইট করপোরেশন লিমিটেড। এখানেও ঐ চাঁদ! যাই হোক ইন্টারভিউ কার্ড হাতে পেয়ে আমার আনন্দ দেখে কে! কারণ আমি তো জানি অনুৎপাদনশীল খাতে সময় ব্যয় করা ভ্রাম্যমান বেকারের কাছে ইন্টারভিউ কার্ড আর অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়ার আনন্দ প্রায় একই। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। চাকরি লাভ অর্থাৎ আকাশের চাঁদ আর হাতে পাওয়া হলো না। একদিন তো ও রেগেমেগে বলেই ফেলল, তুমি ব্যবসা শুরু করো। তোমার দ্বারা আর চাকরি হবে না। কারণ তোমার তো মামা নেই। শুনে আমি হেসে বললাম, মামা নেই কে বলল? মামা আমারও আছে।
কে?
কেন, চাঁদমামা। আমি বলি, চাঁদমামাই হলো পৃথিবীর একমাত্র ইন্টারন্যাশনাল মামা।
ইন্টারন্যাশনাল হোক অথবা ন্যাশনাল-চাঁদেরও যে রকমফের আছে কবির কবিতায় তার প্রমাণ মেলে। তাইতো কারো কছে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি, কারো কাছে বাধ ভাঙ্গা হাসি। কেউ বলেন ছোকরা চাঁদ, কেউ বলেন মেঠো চাঁদ; মাঠে কৃষকের হাতে কাস্তের মতো বাঁকা। কেউ সাহিত্যে চাঁদকে ফালি ফালি করে কাটেন, কেউ আবার কাব্যে পঞ্চমীর চাঁদে মরিবার সাধ ব্যক্ত করেন। তবে যে যাই বলুক না কেন ঈদের চাঁদের সঙ্গে কোনো চাঁদের তুলনা হয় না। আগে তো মানুষ দল বেঁধে ঈদের চাঁদ দেখতো। এখন দলাদলি বেড়েছে তাই কোন্দলের ভয়েই সম্ভবত দল বেঁধে হৈ-হুল্লোড় করে মানুষ আর ঈদের চাঁদ দেখে না। তবে ঈদের চাঁদ উঠেছে কিনা মোবাইলে কিংবা অনলাইনে সে খোঁজটা অন্তত রাখে। সেখানেও হ্যাপা কম নয়।
বাবা হাঁক দিয়ে বলছে ছেলেকে, চাঁদ দেখেছিস?
ছেলে বলছে, গুগলমামা তো এখনও কিছু দেখাচ্ছে না!
মায়ের ওদিকে প্রেসারের পারদ চড়ছে-এ নামে তো তার কোনো ভাই নেই!
প্রেমিকা ইনবক্সে লিখছে-চাঁদ দেখেছ?
প্রেমিক গদগদ। সে দ্রুত ফিরতি মেসেজ দিচ্ছে-চুইটি, তুমিই তো আমার চাঁদ।
প্রেমিকা রেগে টং। হু চুইটি?
সরি, সরি, সুইটি আসলে আমি আ আ আ... বেচারা প্রেমিকের আর লেখা হয় না প্রেমের চিঠি সে কাগজেই হোক আর মোবাইলের স্ক্রিনেই হোক বানান ভুল ধরতে নেই।
গত ঈদের ঘটনা। সন্ধ্যার আড্ডা শেষে আকাশে চাঁদ দেখা যায়নি এই মর্মে নিশ্চিত হয়ে আমরা যখন ‘না জয়যুক্ত হয়েছে’ ‘না জয়যুক্ত হয়েছে’ ঘোষণা দিয়ে বাড়ির পথ ধরব ভাবছি ঠিক তখনই ধড়ফরিয়ে হান্নান এসে জানাল, চাঁদ দেখা গেছে!
আমরা বলি, ধুর!
হান্নান বলে, হুর হট হট! তোরা জানিসই না।
আমরা ঘিরে ধরি, কই?
ও ফিরে তাকায়, ওই যে ওই!
আমরা গোল গোল চোখ নিয়ে ওদিকে তাকাই। রাতের কালো, নিয়ন আলোয় আর কতটুকুই বা দূর হবে। সেই আলোয় কয়েক বাড়ি পর ছাদের ওপর ছন্দাকে হাঁটতে দেখি। পাশ থেকে ভেসে আসে গান। ওই হান্নানই গায় ঠিক আমার কাঁধের ওপর আঙুলের ডুগডুগি বাজিয়ে- হায়রে হায়রে চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি।