সাতসতেরো

গ্রিক পুরাণের রূপের রানি

শাহিদুল ইসলাম : নিজ সন্তানদের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণীর পাওয়ায় গ্রিক দেবতা ক্রোনাস ভয় পেয়ে তার যেসব সন্তানকে জন্মের পরপরই আস্ত গিলে ফেলেন, হেরা তাদের মধ্যে একজন।

 

হেরার জন্মস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। অনেকগুলো স্থানের নাম উঠে এসেছে। এগুলোর মধ্যে ‘আরগোস’ এবং ‘সামোস’ নগরীর নাম সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হয়, কেননা এই দুই স্থানেই দেবী হেরার নামে উপাসনার সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মন্দির অর্থাৎ নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায়।

 

হেরা হচ্ছেন গ্রিক মিথলজির বিবাহ এবং পরিবারের দেবী। রোমানদের কাছে তিনি জুনো হিসেবে পরিচিত। গ্রিক মিথলজির বর্ণনা মতে, হেরার ইচ্ছা এবং আশীর্বাদেই নারী-পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে উঠে বলে বিশ্বাস করা হয়। তাকে একই সঙ্গে নক্ষত্রখচিত আকাশ এবং স্বর্গের দেবী বলেও অভিহিত করা হয়।

 

মিথলজির বিভিন্ন বর্ণনায় দেবী হেরাকে মাথায় চোখ-ধাঁধানো মুকুট পরিহিত রূপসি নারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আবার বিভিন্ন শিল্পীদের চিত্রকর্মে মাঝে মধ্যে দেবী হেরাকে সিংহ, কোকিল, চিল ইত্যাদি প্রাণীর মাধ্যমে উপস্থাপন করতে দেখা গেছে। হেরা ছিলেন দেবতা জিউসের বোন এবং সেই সঙ্গে স্ত্রী। সেই হিসেবে হেরা ছিলেন অলিম্পাসের দেবতাদের রানি।

 

 

প্রায় ৩০০ বছরের প্রেমের পরে জিউস এবং হেরার বিয়ে হলেও তাদের দাম্পত্য জীবন মোটেই সুখের ছিল না। সারা জীবন হেরাকে যন্ত্রনার ভেতর দিয়ে কাটাতে হয়- তার স্বামী জিউসের বহুগামিতার অভ্যাসের জন্যে। বিয়ের আগে জিউস ও হেরা ৩০০ বছর প্রেম করেন। সেই সময়েও জিউসের শয্যাসঙ্গী হন মেটিস, থেমিস, ডিমিটার, নেমোসাইন এবং লেটোর মতো দেবীরা।

   

জিউস এবং হেরার সংসারে জন্ম নেয় হেফিস্টাস, হিবি, এইলিইথিয়া, ইনিয়ো। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অ্যারোস। অ‍্যারোস গ্রিক রূপকথার যুদ্ধের দেবতা। বলা হয়ে থাকে, টাইটান মহাযুদ্ধের পূর্বেই অ্যারোসের জন্ম হয় এবং তিনি অলিম্পিয়ানদের পক্ষ হয়ে টাইটানদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেন।

 

গ্রিক পুরাণের বর্ণনায় দেখা যায়, দেবী হেরা তার জীবনের প্রায় পুরোটাজুড়েই তার স্বামী জিউসের এসব অবৈধ সন্তানদের সঙ্গে শত্রুতা এবং তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে কাটান।দেবী হেরা যে শুধু তার সতীন এবং সৎ সন্তানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করেই কাটান, তা নয়। অনেক দেবতা, বীর এবং অসহায় মানুষকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেও শক্তিশালী দেবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

 

যখন দেবতাদের যুদ্ধের কারণে প্যান্ডারাইডাসরা তাদের পিতামাতা হারিয়ে অনাথ হয়ে পড়ে, তখন হেরা সেই অনাথ কন্যাসন্তানদের উপহার হিসেবে নিজের অসামান্য বুদ্ধি এবং অপার সৌন্দর্য দান করেন। হেরার কৃপাতেই প্যান্ডারাইডাসরা গ্রিক বীর জ্যাসন পেলিয়াসকে হত্যা করে তাদের সোনালি পশম উদ্ধারের অভিযানে সফল হন। আর উদ্ধার করেন তার বন্দি মাতাকে।

 

প্রকৃতপক্ষে দেবী হেরা ছিলেন একইসঙ্গে ভালো এবং মন্দের এক জটিল মিশ্রণ। যখন তিনি ভালো তখন তার মতো উপকারী দেবী আর কোথাও পাওয়া মুশকিল। আর যখন তিনি খারাপ তখন তার ভয়াবহ কুটিল রূপ দেখে সবাইকেই চমকে যেতে হয়। অর্থাৎ তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত সবার কাছে ভালো, যতক্ষণ না কেউ তার সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত না হচ্ছে।

 

তবে তার কাছ থেকে সবচেয়ে বড় দয়া পায় সম্ভবত গ্রিকরা। আর তার বিপক্ষে গিয়ে সর্বনাশ হয় ট্রয়বাসীদের। ট্রয়ের যুদ্ধে হেরার করুণা পেয়ে গ্রিকরা ট্রয় নগরীকে পৃথিবী থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

 

মোদ্দা কথা, জিউসের পরে গ্রিক পুরাণে দেবী হেরাকেই দেখা যায় সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকায়। তিনি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অলিম্পিয়ানদের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ জন্যেই তাকে ডাকা হতো দেবতাদের রানি হিসেবে।

   

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ অক্টোবর ২০১৬/শাহিদুল ইসলাম/রাসেল পারভেজ