বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ব্যালিস্টিক মিসাইল : যে কারণে ভীত পুরো বিশ্ব

এস এম গল্প ইকবাল : পুরো বিশ্বের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল (ইন্টারকন্টিনেন্টেল ব্যালিস্টিক মিসাইল, সংক্ষেপে আইসিবিএম)। আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম কি? কিভাবে কাজ করে? পুরো বিশ্ব কেন এই ক্ষেপণাস্ত্রকে ভয় পায়? চলুন জেনে নেওয়া যাক। আইসিবিএম হচ্ছে, রকেট চালিত পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র যা অন্য মহাদেশে সঠিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে মুহূর্তেই পুরো শহর ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। এটিকে ঠেকানোর উপায় নেই। সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া এই ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালানোয় নতুন করে তা আলোচনায় এসেছে। কয়েক বছর ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর উত্তর কোরিয়া গত ৪ জুলাই তাদের প্রথম আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র সফলভাবে উৎক্ষেপণ করে। যা বিশ্ব উদ্বেগের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে পারমাণবিক সংঘর্ষের সম্ভাবনার উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। আইসিবিএম ক্ষেপণাস্ত্রটি পারমাণবিক ওয়ারহেড বা রাসায়নিক অস্ত্র ছুঁড়ে যা অন্য মহাদেশে পৌঁছাতে সক্ষম। অন্যান্য সামরিক মিসাইলের তুলায় আইসিবিএমে থাকে দীর্ঘ রেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সপার্টের বিশেষজ্ঞ জন পাইকের একটি আর্টিকেল থেকে (আইসিবিএম নিয়ে ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস-এ তার লেখা) জানা যায়, আইসিবিএম ৫,৫০০ কি.মি (৩,৪২০ মাইল) এরও বেশি দূরে যেতে পারে। ১৯৯৮ সালে পাইক লিখেন, আইসিবিএম বিশ্ব মাথাব্যথার হওয়ার কারণ হচ্ছে, এটি একটি দেশকে আঞ্চলিক ভাবে ভেঙে ফেলে এবং এর প্রভাব বিশ্বকে সম্ভাব্য সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যায়। সংঘর্ষের উৎপত্তির কারণ ছাড়াও একটি দেশ আইসিবিএমের ভয় প্রদর্শন করে পুরো বিশ্বকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলতে পারে। সব আইসিবিএম-ই বৃহৎ রকেট যাদের শীর্ষে থাকে পেলোড। তবে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও মহাশূন্যে মানুষ নিয়ে যাওয়া রকেটের তুলনায় এগুলো ছোট। কিন্তু গঠনগত দিক থেকে তারা খুব একটা ব্যতিক্রম নয়। অধিকাংশ আইসিবিএম পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ করে না। তারা উপরে উঠে, উপবৃত্তাকার পথে চলে। একটি আইসিবিএম কয়েক হাজার মাইল দূর থেকেই লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করতে পারে এবং পুরো শহরকে ধূলিস্যাৎ করার ক্ষমতা রাখে। গত ৪ জুলাই, উত্তর কোরিয়া তাদের প্রথম আইসিবিএম হোয়াসং-১৪ জাপান সাগরে নিক্ষেপ করে। কোনো কিছুকে আঘাত না করে পরীক্ষামূলকভাবে এটি উৎক্ষেপিত হয়। যদি এটিকে আরো সম্মুখদিকে নির্দেশনা দেওয়া হতো তাহলে আরো অনেক দূর যেতে পারত। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, উত্তর কোরিয়ার নতুন আইসিবিএম ৪,১৬০ মাইল যেতে পারবে, যা কানাডার পশ্চিমাঞ্চলীয় ও আলাস্কার অধিকাংশ অংশের নাগাল পাবে। আইসিবিএম যেভাবে কাজ করে কিছু আইসিবিএমে কঠিন পদার্থের জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। অন্যগুলোতে ব্যবহার করা হয় তরল জ্বালানি অথবা উভয়ের সমন্বয়। কিন্তু লক্ষ্য একটাই- যথেষ্ট ভার বহন করা ও লক্ষ্যবস্তুতে যত দ্রুত সম্ভব বোমা ছুঁড়ে মারা। যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর রয়েছে মিনিটম্যান-৩ ক্ষেপণাস্ত্রের অস্ত্রাগার। ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস-এর তথ্যানুসারে, মিনিটম্যান-৩ ঘণ্টায় প্রায় ১৫,০০০ মাইল গতিতে ছুটতে পারে। এটি প্রায় ৩০ মিনিটে ৬,০০০ মাইল দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুকে শত ফুট ওপর থেকে সঠিকভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। এরকম গতিতে পৌঁছানো ও নির্ভুলভাবে আঘাতের জন্য এসব আইসিবিএমে সাধারণত তিনটি (কখনো কখনো চারটি) পৃথক রকেট মোটর ব্যবহার করা হয়, যাদেরকে স্টেজেস বলে। কারণ বড় একটি রকেট মোটর তৈরির চেয়ে ছোট একাধিক মটর তৈরি করা সহজতর। নিচের প্রথম স্টেজ রকেটকে বলা হয় বুস্টার। বুস্টার হচ্ছে, রকেটের সবচেয়ে বড় অংশ। এরা বেশ ভার বহন করতে পারে (আইসিবিএমের ওজন কয়েকটি স্কুল বাসের ওজনের সমান, কারণ অনেক বেশি পরিমাণ রকেট জ্বালানি বহন করতে হয়)। বুস্টারের জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে এগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় স্টেজ রকেট জ্বলতে শুরু করে। রকেট মোটরের প্রত্যেক স্টেজের প্রক্রিয়া একই। পাইকের মতে, উড্ডয়নকালে গতিপথে অব্যাহত থাকার জন্য আইসিবিএমে কিছু কৌশল খাটানো হয়, যদিও বেশিরভাগ সমন্বয় সাধন করা হয় বুস্টিংয়ের সময়। ফ্লাইট কম্পিউটার রকেটের চলার পথ নিয়ন্ত্রণ করে ও চাকার ঘুর্ণন ধাক্কা দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রকে গতিপথে টেনে নিয়ে যায়। কিছু আইসিবিএমে ক্যামেরা ব্যবহার করা হয় যেন মেঘের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় নক্ষত্রপুঞ্জে চোখ রেখে গবেষণার তথ্যও পাওয়া যায়। পাশাপাশি ক্যামেরা ফ্লাইট কম্পিউটারে তথ্য পাঠায় ক্ষেপণাস্ত্রের পথ ঠিক রাখতে। উড্ডয়নের প্রত্যেক ধাপে ক্ষেপণাস্ত্র ও তার পেলোড খুব দ্রুত গতিতে এগোয়। শেষ স্টেজ পোড়া শেষ হলে পেলোডে যা অবশিষ্ট থাকে তা হল- পারমাণবিক ওয়ারহেড, রাসায়নিক অস্ত্র বা জৈব অস্ত্র যা দিয়ে ধ্বংস সাধন করা হয়। মিনিটম্যান-৩ একই সময়ে তিনটি পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে, কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি অনুযায়ী একটি ওয়ারহেড বহন করা হয়। আরো উন্নত আইসিবিএম তিনটিরও বেশি ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। ২০০৫ সালে আমেরিকার সৈন্যবাহিনী পিসকিপার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে মিশনে যায়। এটি ১০টি ওয়ারহেডে সজ্জিত হতে পারতো, যাদের প্রত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ওয়ারহেড দেখতে প্রায় কোণাকৃতি। এরা যখন বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে তীব্রগতিতে ছুটে চলে, তখন উৎপন্ন প্রচণ্ড তাপকে যেন প্রতিরোধ করতে পারে এমন ডিজাইন করা হয়। বায়ুমণ্ডল বিচরণ শেষে ওয়ারহেড লক্ষ্যবস্তুতে না পৌঁছা পর্যন্ত নিচের দিকে নামতে থাকে। পাইক বলেন, কিছু ওয়ারহেডে প্যারাশুট থাকে যাতে অবতরণ ধীর হয় ও নির্ভুলভাবে রাসায়নিক বা জৈব উপাদান ফেলতে পারে। পারমাণবিক ওয়ারহেড লক্ষ্যবস্তুতে (যেমন- বিশাল মিলিটারি কমপ্লেক্স বা শহর কিংবা ভূগর্ভস্থ বাংকার বা ক্ষেপণাস্ত্রের মজুদস্থল) পৌঁছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিস্ফোরিত হয়। কিছু ওয়ারহেড অনেক ওপরে বিস্ফোরিত হয়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস (ইএমপি) সৃষ্টি করে একটি দেশের সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে অকেজো করে দিতে পারে। আইসিবিএমকে কি প্রতিরোধ করা যায়? আইসিবিএম তাদের কার্যকলাপের জন্য ভীতিকর। উৎক্ষেপণের পর এদের ধ্বংসলীলা থামানো কঠিন। তারা দ্রুতগতিতে লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধাবিত হয় যার ফলে এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা রীতিমতো পণ্ডশ্রমে পরিণত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার করে যা নিক্ষেপের পর থামানো বা প্রতিরোধ করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্র অনেক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে তাদের প্রযুক্তিকে উন্নত করেছে যা আইসিবিএমকে প্রতিরোধ ও ধ্বংস করতে পারে। মে ২০১৭-তে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ সংস্থা সফলভাবে আইসিবিএম প্রতিরোধ পরীক্ষা সম্পন্ন করে। এটি প্রশান্ত মহাসাগরে একটি নকল আইসিবিএমকে অকার্যকর করে। অনেক বিশেষজ্ঞ ধারণা করেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইসিবিএম প্রতিরোধ পরীক্ষা প্রমাণ করে না যে তারা উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক আক্রমণকে ঠেকাতে পারবে। তথ্যসূত্র : ইনসাইডার রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুলাই ২০১৭/ফিরোজ