মো: মোশাররফ হোসেন মনিরকুমিল্লা, ১২ নভেম্বর: কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে সে বিষয়টিতে প্রধান দু’দল একমত হতে না পারলেও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। আর তাই মাঠ গোছাতে এখন মরিয়া নির্বাচনী মনোনয়নের দৌড়ে এগিয়ে থাকা প্রার্থীরা।
কুমিল্লার দাউদকান্দি সদর ও মেঘনা উপজেলা নিয়ে গঠিত কুমিল্লা-১। স্বাধীনতা পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে বিএনপি ছাড়া কোন দলই ধারাবাহিকভাবে আসনটি ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রফেসর ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে আসনটি বিএনপির ঘরে থাকলেও ২০০৮এর নির্বাচনে তা ছিনিয়ে নেয় আওয়ামীলীগ। সেবার নির্বাচনে বিজয়ী হন মেজর জেনারেল (অবঃ) সুবিদ আলী ভূইয়া।
১৯৭৩ সালে এ আসনটিতে তৎকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোস্তাক বিজয়ী হন। ১৯৭৯ সালে জাসদ থেকে আব্দুর রশিদ ইঞ্জিনিয়ার সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করলে ১৯৮১ সালে দাউদকান্দির উপনির্বাচনে এমপি হন বিএনপি থেকে আব্দুল আলী মুন্সী।
১৯৮৬ সালে স্বতন্ত্র ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এমপি নির্বাচিত হন আব্দুর রশিদ ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৯১,১৯৯৬,ও ২০০১ সালে বিএনপির ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিজয়ী হন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মেজর জেনারেল (অবঃ) সুবিদ আলী ভূইয়া এমপি নির্বাচিত হন।
আসন্ন দশম জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান দুই দলে হেভিওয়েট প্রার্থীরা সক্রিয় থাকলেও প্রার্থী মনোনয়নের চেষ্টায় মাঠে রয়েছেন একাধিক নতুন প্রার্থী। আর তাই নির্বাচনী হাওয়া বইছে জেলার পশ্চিম-উত্তর অংশের প্রথম আসনটিতে।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দৌড়ে একাধিক থাকলেও বিএনপির প্রার্থী হিসেবে এখন পর্যন্ত স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড.খন্দকার মোশাররফ হেসেন এর নামই শোনা যাচ্ছে তৃণমুলের আড্ডায়।
বিদ্যুৎ জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও বর্তমান সাংসদ মেজর জেনারেল (অবঃ) সুবিদ আলী ভূইয়া ছাড়াও নির্বাচনের প্রচারণায় আওয়ামী লীগের ব্যানারে আরও যাদের নাম শোনা যাচ্ছে তারা হলেন- বঙ্গমাতা পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা বিশিষ্ট শিল্পপতি হাসান জামিল ছাত্তার, কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল আওয়াল সরকার, আওয়ামী লীগ নেতা ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোটের ডেপুটি এটর্নি জেনারেল এ্যাড.শফিউল বশর ভান্ডারী,
জাতীয় পার্টি থেকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনীত জাতীয় ছাত্রসমাজ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুলতান জিসানউদ্দিন প্রধান ও জাতীয় ছাত্র সমাজ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আবু যায়েদ আল মাহমুদ মাখন সরকার।
১৯৭৩ সালের পর ২০০৮ এর নির্বাচনে আসনটিতে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। দীর্ঘদিন পর মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভুঁইয়ার নেতৃত্বে আসনটি ফিরে পাওয়ায় দল তাকেই মনোনয়ন দিবে বলে আশাবাদী তিনি। তবে স্থানীয় কিছু নেতাদের দুর্ণীতি, অনিয়ম এবং দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের বঞ্চনার ক্ষোভ নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছে তৃণমুলের নেতাকর্মীরা। তাছাড়া বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা কর্মীর খুনের ঘটনা দলের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে হারানো আসন পুনরুদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে কাজ করছে বিএনপি নেতা কর্মীরা। তাদের অভিযোগ বর্তমান আওয়ামী লীগ সাংসদ তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে ড. মোশাররফ হোসেনের মতো জাতীয় নেতাকে নিজ এলাকায় সভা সমাবেশ করতে বারবার বাধা প্রদান করেছে। যেখানেই মোশাররফ হোসেনের সভা সেখানেই ১৪৪ ধারা জারী করে বিরোধী শক্তিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই আগামী নির্বাচনে জনগন ড. মোশাররফ হোসেনকেই নির্বাচিত করবে।
উক্ত নির্বাচনী এলাকায় ভোটার সংখ্যা দাউদকান্দি সদর ২, ৩১, ৩০৬ ও মেঘনা উপজেলায় ৭৬, ৯২৬ এবার মোট ভোটার সংখ্যা-৩০৮২৩২। দাউদকান্দি ও মেঘনা উপজেলায় স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থীর সংখ্যা ১১টি ও বিএনপির ১৩ টি।
তবে প্রার্থী যেই হোক কুমিল্লা-১ আসনের লড়াইটা যে দ্বিমুখি হবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। শেষ পর্যন্তজনতার রায় কার পক্ষে যায় তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে বেশ কিছু সময়।
এদিকে, জেলার প্রাণকেন্দ্র কুমিল্লা-৬ আসন। আদর্শ সদর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ১৮টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এ আসন। কুমিল্লার ১১টি আসনের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ আসনটি।
নির্বাচনের দিন-তারিখ এখনও চূড়ান্ত না হলেও আওয়ামী লীগ-বিএনপি থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ আসনে কে মনোনয়ন পাচ্ছেন এ নিয়ে চলছে বিশেষ-হিসাব-নিকাশ। সবার দৃষ্টি এখন এ আসনকে ঘিরে। গলির ছোট্ট চা স্টল থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত সর্বত্র একই আলোচনা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দল এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দল থেকে কে মনোনয়ন পাচ্ছেন? এ আসনে প্রধান দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা কম থাকলেও দলীয় কোন্দল অনেক বেশি।
দলীয় নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থেকে ১৯৭৩ সালের পর গত নির্বাচনে আসনটি বিএনপি থেকে পুনরুদ্ধার করে আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয় লাভ করেন হাজী আকম বাহাউদ্দিন বাহার।
জানা যায়, চরম দলীয় কোন্দলের কারণে আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া দুই দলের প্রার্থীর জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেবে। নবম সংসদ নির্বাচনে দলীয় কোন্দল ও সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাজী আকম বাহাউদ্দিন বাহারকে বিজয়ী করেন দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী। অন্যদিকে দলের নীরব কোন্দলের শিকার হন বিএনপির বিজিত প্রার্থী হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন।
দীর্ঘদিন থেকেই কুমিল্লা আওয়ামী লীগে চলছে অন্তর্কোন্দল। নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা হাজী বাহারকে কুমিল্লা সদর আসনে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার মধ্য দিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ আফজল খানের সঙ্গে বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে। তখন কুমিল্লার আলেখারচরে নির্বাচনী পথসভায় দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনা আফজল খান ও হাজী বাহারকে হাত ধরে মিলিয়ে দেন।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের তত্কালীন সভাপতি অধ্যাপক খোরশেদ আলমের পর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে হাজী বাহার আওয়ামী লীগ থেকে সদর আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর থেকে বর্তমানে আফজল-বাহার অনেকটা বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়েছেন। দলীয় অনুষ্ঠানও করছেন পৃথকভাবে। তাই আসন্ন সংসদ নির্বাচনে আফজল-বাহার উভয়ই দল থেকে মনোনয়ন চাইবেন বলে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এরই মধ্যে মাঠে উভয় নেতাই প্রচার-প্রচারণা অব্যাহত রেখেছেন। ‘মনোনয়ন পাবেন, সবুজ সংকেত পেয়েছেন’ এমনই আশাবাদ উভয়েরই।
অপরদিকে দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির একক প্রার্থী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিন রশিদ ইয়াছিন। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় নির্বাচনে লে. কর্নেল (অব.) আকবর হোসেনের জয়ের মধ্য দিয়ে কুমিল্লা সদর আসনটিতে বিএনপির যাত্রা শুরু হয়। ’৮৬ এবং ’৮৮ সালের দুটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়ায় জাতীয় পার্টির প্রার্থী আনসার আহমেদ আসনটিতে এমপি নির্বাচিত হন।
তারপর ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী আকবর হোসেনের টানা বিজয়ের পথ ধরে কুমিল্লা সদর আসন বিএনপির ঘাঁটিতে পরিণত হয়। আকবর হোসেনের মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া ঘাঁটিতে দলীয় অন্তর্কোন্দলের কারণে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারেননি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন। একইভাবে দলীয় কোন্দলের কারণে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে বর্তমান সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু গ্রুপের সিনিয়র নেতা ফজলুল হক ফজলু আওয়ামী লীগের প্রার্থী অধ্যক্ষ আবদুর রউফের কাছে মাত্র ৪৭ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন।
দলের কমিটি নিয়ে মতবিরোধের জের ধরে হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াসিন ও সিটি মেয়র মনিরুল হক সাক্কু একই মঞ্চে কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেন না। দলীয় কোনো অনুষ্ঠান থাকলে দলের কান্দিরপাড় অফিসটি পালাক্রমে ব্যবহার করা হয়। হরতাল-অবরোধের সময় কর্মসূচিও পৃথক স্থানে পালন করা হয়। উভয় গ্রুপের নেতাকর্মীদের মাঝে পাল্টাপাল্টি মামলাও রয়েছে। তাই দলীয় বেশ কয়েক নেতাকর্মী মনে করছেন সিটি মেয়র সাক্কু আগামী নির্বাচনে হাজী ইয়াছিনের বিপক্ষে অবস্থান নেবেন।
তবে বিএনপির আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে এখনও অনিশ্চয়তা থাকলেও দলের একক প্রার্থী হিসেবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিন।
রাইজিংবিডি / এলএ