নিজস্ব প্রতিবেদকঢাকা, ১৫ নভেম্বর: নব+অন্ন=নবান্ন। নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দে বাংলার কৃষকরা যে উৎসব করে থাকে তাই নবান্ন উৎসব। প্রায় ৪০ হাজার বছরের পুরনো এ উৎসব বাঙালির ঘরে ঘরে সমাদরে পালিত হয়ে আসছে। পঞ্জিকার পাতা ঘুরে এল আজ সেই দিন। পহেলা অগ্রহায়ণ, শুক্রবার, ১৪২০ বঙ্গাব্দ। আজ দেশজুড়ে উদযাপিত হল নবান্ন উৎসব।হেমন্ত যে এসেছে তা গ্রাম বাংলার গৃহবধূর উঠোনভরা সোনালী ধান দেখলেই বোঝা যায়। তবে নগর বাংলায় এর দেখা মিলবে না। তাই হয়তো অনেকেই জানেন আজ নবান্ন এসে সুবাতাসের দোলা দিচ্ছে তার জানালার পর্দায়। তবে কেউ জানুক আর না-ই জানুক হেমন্তের শিহরণে দুলছে বাংলাদেশ। এ খবর পাখি জানে, গাছ জানে, উড়ু উড়ু মেঘও জানে। জানে ঐতিহ্যপ্রেমী মানুষও। কালের যাত্রায় নবান্ন উৎসব পেয়েছে নগর জীবনের ছোঁয়া। নতুন ধানের ক্ষির, পায়েস এখন আর বিলি হয় না। সে জায়গায় যুক্ত হয়েছে নবান্ন আরতি। নাগরিক জীবনে গান, কবিতা, নৃত্যে ঐতিহ্যবাহী এ উৎসবকে স্মরণ করা হয় মাত্র।সেই প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় প্রতিবছর আয়োজন করা হয় নৃত্য, সঙ্গীত, আবৃত্তি, নবান্ন কথন, শোভাযাত্রা, বাউলগান, আদিবাসী পরিবেশনা, বাউল-বাঁশি পরিবেশনা ইত্যাদি। শুক্রবার এবারও এসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে নবান উৎসব উদযাপন করেছে ঢাকার সংস্কৃতিপ্রেমীরা।এ আয়োজনে নতুন মাত্রা দেয় পিঠা, মুড়ি-মুড়কি। ‘এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে’ স্লোগানে জাতীয় নবান্নোৎসব ১৪২০ উদযাপন পর্ষদ নবান্ন উৎসবের আয়োজন করে। সকাল ৭টা ১ মিনিটে বাঁশি, দোতারা ও তবলাসহ দেশীয় যন্ত্র-সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় এ উৎসব। উৎসবের উদ্বোধন করেন প্রবীণ সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। নবান্ন কথনে অংশ নেন পর্ষদের চেয়ারম্যান লায়না হাসান ও আহ্বায়ক শাহরিয়ার সালাম। সকাল ৯টায় নবান্নের শোভাযাত্রা শুরু হয়। শোভাযাত্রাটি চারুকলা থেকে শুরু হয়ে টিএসসি ঘুরে আবার চারুকলায় এসে শেষ হয়। উৎসব শোভাযাত্রায় বিভিন্ন সংগঠন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। পরে বকুলতলায় নবান্নের সঙ্গীত, বাউলগান, জারি-সারি গানসহ বিভিন্ন সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন করা হয়। আয়োজন করা হয় ছোটদের ছবি আঁকা ও তা প্রদর্শীর। এছাড়া উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে পরিবেশন করা হয় মুড়ি-মুড়কিসহ বিচিত্র ধরনের পিঠা। উৎসব উপলক্ষে পর্ষদের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয় একটি স্মারক সংকলন, পোস্টার ও শুভেচ্ছাপত্র। এসবের মধ্য দিয়ে নবান্নের ঐতিহ্য তুলে ধরা হয়। উৎসবের উদ্বোধন শেষে কামাল লোহানী বলেন, নবান্ন উৎসব বাংলার প্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী উৎসব। এ উৎসবের মাধ্যমে আমরা ফিরে যাই গ্রাম ও শহরের মেলবন্ধনে। এ উৎসব বাঙালির মাঝে মেলবন্ধন তৈরি করে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, শহর ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির আগ্রাসনে প্রিয় এ উৎসবকে আমরা ভুলতে বসেছি। তারপরও কিছু মানুষ এ উৎসবকে বাঁচিয়ে রেখে মনে করিয়ে দেয় আমাদের ঐতিহ্যের কথা। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন এ উৎসবকে বাঙালি ভুলবে না। আয়োজকরা বলেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বাঁচিয়ে রাখতে ১৯৭০ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন প্রথম নবান্ন উৎসবের আয়োজন করেন। উৎসবে তিনি চিত্র প্রদর্শনীরও আয়োজন করেন।অনেক কৃষকের বাড়িতে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব পালিত হচ্ছে। সারাবছর ঘাম ঝরিয়ে কৃষক এ দিনে সোনালি ফসল ঘরে তোলে। প্রায় ৪০ হাজার বছরের পুরনো এ উৎসব। সেই উৎসবের নাম মাটির সঙ্গে চির বন্ধনযুক্ত নবান্ন উৎসব। ঐতিহ্যবাহী ও মাটির সঙ্গে চিরবন্ধনযুক্ত উৎসব নবান্ন। হেমন্তের শুরুতে এ উৎসব উদযাপিত হয়। এ উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত নতুন ফসল। এ দিনে নতুন ধানের খই, মুড়ি-মুড়কি হরেক রকম পিঠা, পায়েসের আয়োজন করা হয় কৃষকের ঘরে। নতুন ধান ঘরে তোলার আনন্দে সারারাত চলে গানের আসর। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে পর্ষদ গত ১৪ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। ঐতিহ্যের কথা বিবেচনা করে দিনটিতে সরকারি ছুটি ও জাতীয় দিবস ঘোষণার দাবি জানান তারা।
রাইজিংবিডি / রাপা / এলএ