শিল্প ও সাহিত্য

জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং অস্তিত্ববাদ

 

দস্তয়ভস্কির ছোট্ট উপন্যাস ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’(১৮৬৪)-এ দেখতে পাই এক অজ্ঞাতনামা লোক সমাজে নিজেকে মানাতে পারছে না। অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে ভুগছে সে। দস্তয়ভস্কির এই উপন্যাসকে অস্তিত্ববাদের প্রথম সাহিত্য নিদর্শন বলা যায়। আর দস্তয়ভস্কির ঢাউস উপন্যাস ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজোভ’(১৮৮০)-কে অস্তিত্ববাদী উপন্যাস হিসেবে দাবি করেছেন স্বয়ং জ্যাঁ পল সার্ত্রে। দস্তয়ভস্কির শেষ এই উপন্যাসটি একই সঙ্গে স্বাধীন ইচ্ছা, নৈতিকতা এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন তোলে। জ্যাঁ পল সার্ত্রে ১৯৪৯ সালে ‘অস্তিত্ববাদ একটি মানবতাবাদ’ (Existentialism Is a Humanism) নামে ছোট্ট একটি পুস্তিকা লেখেন। উল্লেখ করা দরকার প্যারিসে এক বক্তৃতার লিখিত সংস্করণ এটি। এই পুস্তিকাতে সার্ত্রে মূলত ব্যক্তি এবং ব্যক্তির আয়ত্বাধীন সকল কিছুর টিকে থাকার উপরই অস্তিত্বকে প্রাধান্য দেন। মানুষের মৌলিক সত্তা, স্বাধীনতা, ইচ্ছা ইত্যাদির টিকে থাকার উপরই গুরুত্ব দেন সার্ত্রে। তিনি বলছেন, ‘মানুষ সর্বপ্রথমে টিকে থাকে, নিজের মুখোমুখি হয়, জগতে উত্থিত হয় এবং তারপর নিজের অবস্থান নির্ধারণ করে।’ সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী ধারণা অনুযায়ী মানুষ যে কোনো মূল্যে আগে টিকে থাকে এবং টিকে থাকার জন্য সব কিছু করে। যদিও অস্তিত্ববাদের উৎসভাবনা দেখা যায় ডেনিশ দার্শনিক সোরেন কিয়েকাগার্দের দর্শনে। সার্ত্রে অবশ্য অধিক প্রভাবিত ছিলেন জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেলবার্গ দ্বারা। আর অস্তিত্ববাদ (existentialism/L'existentialisme) শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছেন ফরাসী দার্শনিক গ্যাব্রিয়েল মার্সেল। অবশ্য এক সেমিনারে মার্সেল ‘অস্তিত্ববাদ’ পরিভাষাটি ব্যবহার করলে সার্ত্রেই প্রথম আপত্তি তোলেন। পরবর্তী সময়ে সার্ত্রে ‘অস্তিত্ববাদ একটি মানবতাবাদ’ বইটি লেখেন এবং সার্ত্রের পথ ধরেই অস্তিত্ববাদ ক্রমশ শিল্প, সাহিত্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সার্ত্রের ‘মাছি’ (The Flies, ১৯৪৩), ‘প্রস্থান নাই’ (No Exit, ১৯৪৪) ইত্যাদি নাটকে অস্তিত্ববাদের সুপ্রয়োগ দেখা যায়। এটুকু প্রারম্ভিকের প্রয়োজন বোধ করেছি শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাস প্রসঙ্গে আলোচনার প্রয়াসে। শহীদুল জহিরকে কম-বেশি আমাদের সকল সাহিত্য সমালোচক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন ‘যাদু-বাস্তবতার’ পরিপ্রেক্ষিতে। আমি অন্তত ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসে অস্তিত্ববাদের প্রভাব লক্ষ্য করি। এই আলোচনা তারই সূত্রপাত।

‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসের শুরুতেই লেখক শহীদল জহির বয়ান করেন, ‘ঊনিশ শ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট্ করে ছিঁড়ে যায়। আসলে বস্তুর প্রাণতত্ত্ব যদি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে হয়তো বলা যেত যে, তার ডান পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতে বস্তুর ব্যর্থতার জন্য নয়, বরং প্রাণের অন্তর্গত সেই কারণে ছিন্ন হয় যে কারণে, এর একটু পর আবদুল মজিদের অস্তিত্ব পুনর্বার ভেঙে পড়তে চায়।’ লেখক কাহিনি বয়ানের শুরুতেই আমাদের জানিয়ে দেন, এই উপন্যাসটি আদতে আবদুল মজিদের অস্তিত্বের সংকটের উপন্যাস। শুধু তাই নয়, ‘অস্তিত্ব পুনর্বার’ ভেঙে পড়ার উপন্যাস। উপন্যাসের সময়কাল পনেরো বছর। পাক হানাদার বাহিনীর আকস্মিক হামলায় ২৫ মার্চের বাঙালির চরম দুর্ভোগ ও সংকটের কাল থেকে কাহিনি বিস্তৃত হয়েছে ১৯৮৫ সাল নাগাদ। যুদ্ধের কালে আবদুল মজিদ এক কিশোর। আর ১৯৮৫-তে এসে সে পরিণত। ১৫ বছরের এই পরিণতকালে পৌঁছাতে আবদুল মজিদকে সামষ্টিকভাবে পার হতে হয়েছে এক অনিশ্চিত, সংকটময় পরিস্থির মধ্য দিয়ে। মানুষের জীবন টিকিয়ে রাখার চরম সংকট থেকে মুক্তি পেতেই আবদুল মজিদকে উপন্যাসের শেষে এসে দেখি চেনা পরিবেশ, প্রতিবেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে। কেননা, ‘সে প্রথমে নিজেকে বাঁচাতে চায় এবং কোনো সমষ্টিগত প্রচেষ্টার অবর্তমানে সে তা করতে পারে; এখনই মহল্লা ত্যাগ করে।’

‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসে অস্তিত্বের সংকট কেবল ব্যক্তি আবদুল মজিদের নয়, বরং সে পুরো একটি সমষ্টি বা গোষ্ঠির অস্তিত্ব-সংকটের প্রতিনিধি। এই সংকট কেবল প্রাণ নয়, মানবিক অধিকারের সংকট। ইতিহাস বলে অশ্রু ও রক্তে লেখা আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭১ সালে এই সংগ্রামের কালে মানুষ ও তার জীবনের বিবিধ মৌলিক অস্তিত্বের সংকট তৈরি হয়েছিলো। বহু নারী পুরুষকে সম্ভ্রম আর প্রাণ দিতে হয়েছিলো। নিরীহ শান্তিপ্রিয় বাঙালি এমন হত্যা আর বলাৎকারের মুখোমুখি আর কখনও হয়নি। ‘তারা আজীবন যে দৃশ্য দেখে কিছু বোঝে নাই- যখন একটি মোরগ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মুরগিকে- মহল্লায় মিলিটারি আসার পর তাদের মনে হয়েছিল যে, প্রাঙ্গনের মুরগির মতো তার মা এবং কিশোরী কন্যাটি, পরিচিত ভালোবাসার স্ত্রী, তাদের চোখের সামনে প্রাণভয়ে এবং অনভিপ্রেত সহবাস এড়ানোর জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটি এমন মর্মান্তিকভাবে তাদের জানা থাকে যে, তাদের বিষণ্ণতা ছাড়া আর কোনো বোধ হয় না। তাদের বিষণ্ন লাগে। কারণ, তাদের মনে হয় যে, একমাত্র মুরগির ভয় থাকে বলাৎকারের শিকার হওয়ার আর ছিল গুহাচারী আদিম মানবীর। কিন্তু পাকিস্তানি মিলিটারি এক ঘণ্টায় পঞ্চাশ হাজার বৎসর ধরে মানুষের বুনে তোলা সভ্যতার চাদর ছিঁড়ে ফেলে এবং লক্ষ্মীবাজারের লোকেরা তাদের মহল্লায় মানুষের গুহাচারিতা এক মর্মান্তিক অক্ষমতায় পুনরায় অবলোকন করে; তারা মা এবং ছেলে, পিতা এবং যুবতী কন্যা একসঙ্গে বলাৎকারের অর্থ অনুধাবন করে। এই সময় কিশোর আবদুল মজিদ তার যুবতী বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে।’ পাকিস্তানি মিলিটারির আদিম বিভৎসতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পুরো একটি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিলো। তাই, ‘তখন মহল্লার লোকদের যে অনুভূতি হয়েছিল সেটা এই অবস্থায় সব প্রাণীরই হয়, তা হলো ছুটে পালানো। কিন্তু লক্ষ্মীবাজারের লোকেদের অতীতের সেই উপলব্ধির কথাটি মনে পড়ে যে, দেশে পালানোর স্থান নেই এবং এবার তারা পলায়নের প্রবল ইচ্ছে অবদমিত করে যার যার বাড়িতে থেকে যায়।’ এ এক প্রবল অস্তিত্ব সংকটের মুহূর্ত, যখন আর মানুষের পালানোরও জায়গা থাকে না। পরিস্থিতি মানুষকে কখনো অসহায় প্রাণীতে পরিণত করে। মুরগির মতো একটি গৃহপালিত প্রাণীর অনিবার্য অনিশ্চিত জীবনের মতো হয়ে ওঠে মানুষের জীবন। ‘মোমেনা আপাকে দেখে আবদুল মজিদের মনে হয়েছিল, তাকে মুরগির মতো জবাই করে কুয়োতলায় ঝাঁকার নিচে চাপা দেয়া হয়েছে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে আবদুল মজিদ তখন সেই অনুভূতিটির বিষয়ে সচেতন হয়েছিল, যার নাম ঘৃণা এবং আক্রান্ত হয়েছিল সেই আবেগের দ্বারা যার নাম প্রতিহিংসা। কিশোর আবদুল মজিদ অনুভব করতে পেরেছিল যে, সে মোমেনা আপার অপমানের প্রতিশোধ নিতে চায়- ‘কান্দিচ না আপা, মান্দার পোর থোতা ফাটায়া দিয়া আমুনে। কিন্তু সে নিশ্চিতরূপেই বুঝতে পারে নাই সে কীভাবে তা করবে এবং ওই সময়ই সে সেই বোধটিও আবিষ্কার, যার নাম কাপুরষতা।’

কিশোর আবদুল মজিদের অস্তিত্ব সংকটের তীব্রতা ঘৃণা, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধকে প্রকাশের সুযোগ দেয় না। শেষ পর্যন্ত এক তীব্র অস্তিত্বের সংকটে কিশোর আবদুল মজিদ ‘কাপুরষতা’ অনুভব করে। একাত্তরে অনেকের মতোই বোন মোমেনার সম্ভ্রম ও প্রাণ রক্ষা করতে পারে না আবদুল মজিদ। কিন্তু স্বাধীন দেশে সে আশায় বুক বাঁধে। ‘মোমেনার কথা আবার যখন তার স্মৃতিতে স্পষ্টভাবে এসে পড়ে এবং যখন সদ্যোজাত মেয়ে সন্তানটির নামকরণ নিয়ে তার নানী, দাদী, মা ও খালা অচিরেই তৎপরতা শুরু করে, তখন আবদুল মজিদ তার কন্যাটিকে দুহাতে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বলে যে, এই কন্যাটির নাম ‘মোমেনা’ রাখা হোক। তার কথা শুনে সকলে স্তব্ধ হয়ে যায়। তার বৃদ্ধা মা নিমজ্জিত হয় তার নিজের প্রথম কন্যার আগমন এবং তিরোধানের ঘটনার আনন্দ এবং বেদনার স্মৃতি উদঘাটনে, অন্যরা বুঝতে পারে যে, এই নামটি এই পরিবারের লোকেদের আবেগ এবং অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। আবদুল মজিদের মেয়ের নাম ‘মোমেনা’ রাখা হয়ে যায়। ছোট মোমেনার অস্তিত্বের ভেতর বড় মোমেনার অস্তিত্ব যে ফিরে আসে, এ ব্যাপারে আবদুল মজিদের কোনো সন্দেহ থাকে যে, বড় মোমেনাকে তারা বাঁচাতে ব্যর্থ হয়েছিল।’ একাত্তর সাথে আবদুল মজিদ তার বোনের অস্তিত্ব রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। ঊনিশ পঁচাশি সালে আবদুল মজিদ যখন দেখে যুদ্ধাপরাধী বদু মওলানা পুনরায় ক্ষমতায় এসেছে, মেয়ের নাম ‘মোমেনা’ রাখায় বদু মওলানা গং তাদের কৃতকর্মের স্মৃতি দেখতে পায়, তখন আবদুল মজিদ ‘ছোট মোমেনার অস্তিত্ব’ টেকাতেই নিজেদের পুরনো বাড়িটি বিক্রি করে মহল্লা ত্যাগ করে। ‘এবং ধরে নেয়া যায় যে, তাদের বাড়ি বিক্রি হয়ে গিয়ে থাকলে লক্ষ্মীবাজারে তাদের নাম অবলুপ্ত হয়েছে।’

‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসে যুদ্ধকালে মানুষের যে তীব্র অস্তিত্ব সংকট দেখি যুদ্ধোত্তর স্বাধীন রাষ্ট্রেও সে সংকট বিলুপ্ত হতে দেখি না। রাজাকারের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কারণে আবদুল মজিদ শেষ পর্যন্ত নিজের আদি নিবাস থেকে অস্তিত্ব টেকাতেই স্বপরিবারে পালায় এবং তাদের পলায়নের মধ্য দিয়ে পুরনো ঠিকানা থেকেই তাদের নাম অবলুপ্ত হয়ে যায়। যুদ্ধ, ক্ষমতা, রাজনীতি ইত্যাদির কাছে মানুষের অস্তিত্ব একটা স্যান্ডেলের ফিতার মতো, কিংবা মুরগির মতো, কিংবা উঁইপোকার মতোই ঠুনকো- শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ তার দালিলিক উপস্থাপন। রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মার্চ ২০১৯/তারা