সারা বাংলা

রক্ত দিয়ে লেখা যে গল্প

নজরুল ইসলাম। ’৭১-এর রণাঙ্গনের যুদ্ধাহত একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। পাকবাহিনীকে হটাতে বাংলার এ দামাল ছেলে দেশপ্রেম আর অসীম সাহসিকতা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে।

দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে অংশ নিয়েছেন বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে। তার মতো মুক্তিযোদ্ধাদের সেই যুদ্ধের বিনিময়ে জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালি জাতি পেয়েছে লাল-সবুজের পতাকা। সেই সব যুদ্ধের স্মৃতি তিনি রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য বর্ণনা করেছেন।

এ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ১৯৫৪ সালে ১ জুলাই নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরনগর (রামনগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১০ সাল থেকে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাঁদের বিভিন্ন কল্যাণকর কাজে জড়িত আছেন তিনি।

যুদ্ধাহত এ বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমি তখন ভৈরব আসমত আলী কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে তখন আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। দেশকে শক্রমুক্ত করার শপথ নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাড়িতে কাউকে না বলে ৫ জুন চলে যাই ভারতে। তখন আমার কাছে ছিল মাত্র ১৬ টাকা। সেখানে গিয়ে হাফানিয়া ক্যাম্পে ঠাঁই হয়। ২১ দিন ভারতের গোকোলনগর, উদয়পুর ও পালাটল ক্যাম্প থেকে পৃথক ৩টি অস্ত্র চালানো ট্রেনিং নিয়ে আগতলার কাছে মনতলায় অবস্থিত ক্যাপ্টেন মতিন এর ৩ নং সেক্টরে ই-কোম্পানির একটি ক্যাম্পে চলে আসি। ২ নভেম্বর ভারতের ত্রিপুরা থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কথা জানিয়ে বাবার কাছে একটি চিঠি লিখি। পরে বাংলাদেশে আমি সর্বপ্রথম সিলেটের মনতলার কমলপুরে একটি অপারেশনে যাই। পাকবাহিনীর সাথে আমাদের জয় হয়। পরে মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২নং সেক্টরের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।’

মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা প্রথমেই আখাউড়া আক্রমণ করে সে এলাকা দখল করে মনতলা ও জগদীশপুরে ক্যাম্প স্থাপন করি। পরবর্তী সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহাবাজপুর হাই স্কুলে ক্যাম্প করি। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তুল্লা নামক গ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথে যুদ্ধে আর্টিলারি শেলের বিস্ফোরণে শহীদ হয়েছিলেন। তার নাম ছিল ফজলুর রহমান।

আখাউড়ার যুদ্ধে পাকসেনাদের ছোঁড়া শক্তিশালী আর্টিলারি শেল এসে পড়ে ব্যারাকের মধ্যে। এই আর্টিলারি শেলের বিস্ফোরণে ফজলুর রহমানের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তার একটা হাত পাওয়া গেছিল এক জায়গায়, আর পা গিয়ে পড়েছিল অন্য এক জায়গায়। আর্টিলারি শেলের বিস্ফোরণে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। তখন তার হাতে ছিল একটি স্বর্ণের আংটি। এই আংটি আমাদের অফিসার মানে (কোম্পানি কমান্ডার) স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখেন।

তারপর শাহাবাজপুরে আমরা ক্যাম্প স্থাপন করি। তখন আমাদের ক্যাম্পে ফজলুর রহমানের বৃদ্ধ বাবা ও মা তার ছেলের সন্ধানে আসেন। আমি তখন ব্যারাকের পাহারায়।

সেই সময় ব্যারাকে বৃদ্ধ বাবা-মা এসে বলেন, ‘আমার ছেলে ফজলুর রহমান কোথায়? তার বৃদ্ধ বাবা-মা খবরটা লোক মারফত কিছুটা জেনে ছিল। তখন ফজলুর রহমানের বাবা-মা বলেন, তোমরা যে ফিরে আসছো, আমার ছেলেকে কোথায় রেখে আসছো? আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও। তখন সুবেদার মুজিবুর রহমান, আমাদের সবাইকে একত্রিত করে সাথে নিয়ে ফজলুর রহমানের বাবা-মাকে বলেন, আপনার ছেলে স্বাধীনতা যুদ্ধে মারা গেছে। আপনার ছেলে ধন্য সে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। আজকে আমরা ফেরৎ আসছি, আমরাই আপনার ফজলুর রহমান, আমরাই আপনাদের সন্তান।’

সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্না স্বরে নজরুল বলেন, ‘আমরা তাদের মৃত্যু দিবসটা পর্যন্ত পালন করি না। কিন্ত সেই দিন আমরাই ফজলুর রহমানের বাবা-মাকে বলেছিলাম, আমরাই তাদের সন্তান।’

আখাউড়া যুদ্ধ সর্ম্পকে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পূর্ব-দক্ষিণ রণাঙ্গনের একটি ভাগ ছিল নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলার আখাউড়ার ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত এবং ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ এলাকাগুলো মুক্তিযোদ্ধে ২নং সেক্টরের আওতায় ছিল।

১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী রক্তাক্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ২নং ও ৩নং সেক্টরে। ২ ডিসেম্বর তারিখে পাকহানাদার বাহিনী তুমুল আর্টিলারি শিলিং ও গোলাগুলির মাধ্যমে আমাদের পশ্চাৎপদ করার জন্য মরণপণ লড়াই চালায়। এদিকে আখাউড়া, গঙ্গা-সাগর ও কসবায় পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মেজর খালেদ মোশারফ ও মেজর হায়দারের নেতৃত্বে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ২ ডিসেম্বর কর্নেল শফিউল্লাহর এস ফোর্স আখাউড়া, সিংগারবিল ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় আমাদের সাথে সম্মিলিত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং এলাকাগুলো পাকসেনা মুক্ত করি।

২ ডিসেম্বর বিকেলে সেই রক্তাক্ত ত্রিমুখী যুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন এবং পাকবাহিনীর বহু সৈনিককে আমরা হত্যা করি। ওই সময়ের যুদ্ধে আর্টিলারি শেলের আঘাতে আমি আহত হই।’

আখাউড়া যুদ্ধের পর পাকসেনাদের ভয়াবহ অবস্থা সর্ম্পকে বর্ণনা দিতে গিয়ে নজরুল ইসলাম আরও বলেন, ‘৫ ডিসেম্বর আখাউড়া পতনের পর পাকিস্তানি বাহিনী একটি ব্রিগেট সৈন্য সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কিছু সংখ্যক সৈন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যায়। তার মধ্যে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈন্য সাধারণ জনতার হাতে ধরা পড়ে মারা যায়। পাকিস্তানি পরাজিত সৈন্যরা পিছু হটার সময় যে অবর্ণনীয় কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কোথাও এরা খাদ্য ও পানি পেল না। বাড়ি বাড়ি থেকে ভাত, মাঠে মাঠে মুলা ও পেঁয়াজ খেতে হয়েছিল তাদের। সব সময় এদের মনে হতো যে, প্রেতাত্মার মতো মুক্তিবাহিনী তাদেরকে অনুসরণ করছে। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা ও তৃষ্ণায়, বিশ্রামের অভাবে শরীর ছিল শক্তিহীন।’

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘যুদ্ধ তখনো শেষ হয়নি এরই মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী চলে গিয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে। যৌথ বাহিনীর সাথে আরও বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ হয় এবং পরিশেষে পাকিস্তানি বাহিনী সম্মিলিত বাহিনীর কাছে টিকতে না পেরে ভৈরব চলে আসে এবং মেঘনা নদীর উপড় রেলওয়ে ব্রিজের কিছু অংশ ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়।

১ ডিসেম্বর রায়পুরার পূর্ব রণাঙ্গনে মিত্রবাহিনীর যৌথ প্রতিরোধের কারণে পাকসেনারা ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বপাড় ও তার আশপাশে অবস্থান নিতে থাকে।

এদিকে পাকবাহিনী যাতে করে ঢাকা অভিমুখে পলায়ন করতে না পারে, সেই জন্য নরসিংদীর রায়পুরা থানার রামনগর, গৌরীপুর, তুলাতলী ও বেগমাবাদ গ্রামের ব্রহ্মপুত্র নদ ও মেঘনার তীরবর্তী এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা ৬ ডিসেম্বর ব্যারিকেড ও প্রতিরোধ ঘাঁটি স্থাপন করে তুমুল আক্রমণ চালায়। ৯ ডিসেম্বর ভারতের ৪র্থ রেজিমেন্ট হেলিকপ্টারে রায়পুরা ও তার আশেপাশে অবতরণ করতে থাকে। ১০ ডিসেম্বর ভারতীয় ১০বিহার রেজিমেন্ট ও ১৮ রাজপুত্র রেজিমেন্ট রায়পুরা এসে পৌঁছলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যুক্ত হয়। ফলে রায়পুরা ১০ ডিসেম্বর শক্রুমুক্ত হয়।

৯ মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধে রায়পুরার অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তাদের মধ্যে গ্রুপ কমান্ডার আব্দুস ছালাম কাউছারকে রায়পুরার হাইরমারা থেকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তার আর কোনো সন্ধান মেলেনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন আশুগঞ্জ যুদ্ধে শহীন হন, তার লাশ মেঘনা নদীতে ভেসে যায়। আরেক খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন নান্টু তিনি সিলেটের কমলগঞ্জের যুদ্ধে পাকসেনাদের সাথে নদী পথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন, তার লাশ ও নদীতে ভেসে যায়।

রায়পুরার আরেক বীরমুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন দুদু, তিনি বেতিয়ারা যুদ্ধে যখন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, তখন পাকসেনারা তাকে বারবার বলছিল পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে, কিন্তু দুদু বারবার জয় বাংলা স্লোগান দিতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বেতিয়ারা যুদ্ধে নিহত আরেক বীর মুক্তিযোদ্ধা বশিরুল ইসলামেরও লাশ পাওয়া যয়নি।

এছাড়া ভারত থেকে আসার পথে পাক-বাহিনীর গুলিতে মির্জাপুরের মুজিবুর রহমান মাধবপুরের মহাজনপুর গ্রামে মারা যান। তার লাশ কেউ আনতে পারেনি।

পাক-বাহিনীর তাণ্ডবে বাংলাদেশ তখন ছিল মৃত লাশের ঘর। অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত দেহ নদীতে ভেসে গেছে। দিনের পর দিন বন্দি রেখে নির্মম অত্যাচার করে রাতের আঁধারে গুলি করে হত্যা করে সেই লাশ বধ্যভূমিতে ফেলে দিয়েছে পাকসেনারা। আজও সে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে আসে।

 

নরসিংদী/হাকিম মাহি