‘সবার জন্য সমতা’ এ বছর নারী দিবসের প্রতিপাদ্য এটি। নারী আজ সমাজের চোখে সমতা পেয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপের প্রতিবেদন বলছে, এ লিঙ্গসমতা আগামী ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান থাকবে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা তাদের অবস্থান প্রমাণ করেছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে নারীর সম্পৃক্ততা বেড়েছে। নারী হয়ে উঠেছে আরো বেশি আত্মপ্রত্যয়ী। সমাজে আজ পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান অবদান রাখছে। যেমনটি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধের তার নর।’
নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ, সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে এবং নারীর অবদান উদযাপনের জন্য প্রতি বছর ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়।এই দিবস প্রতিটি নারীকে তার সফলতা, তার প্রাপ্তি এবং তার অবদানের কথা মনে করিয়ে দেয়। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাই হাজারো সফল নারীর মধ্যে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ নিজ জায়গায় সফল কয়েকজন নারীর সফলতার গল্প তুলে ধলেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাথিয়া ঐশী ।
সাহিদা আখতার আশা
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল অ্যান্ড ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রভাষক। সাহিদা আখতার আশা কথা বলেছেন কর্মক্ষেত্রে নারীর অবদান নিয়ে।
যেকোনো সমাজ ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ সহিষ্ণু শব্দটি হল ‘নারী’। অথচ এই নারী শব্দটির পূর্বে ‘সফল’ বিশেষণ যোগ করতে গিয়ে বরাবরের মতো আজও থমকে দাঁড়াতে হয়।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম আমার। বেড়ে উঠেছি প্রতিবেশী ঘরগুলোতে জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যসের ‘আবুল’ চরিত্রটির বাস্তব রূপায়ন দেখে। কৃতজ্ঞতা আমার বাবা-মায়ের প্রতি, যারা আমার প্রাণশক্তির ডানা দুটোকে ছেঁটে না ফেলে, উড়তে দিয়েছিলেন মুক্ত আকাশে। সেই অসীম পরিক্রমার একটি ক্ষুদ্র অংশ হিসেবে আজ আমি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু প্রশ্নটি যখন স্বাধীনতা ও সফলতার, স্বভাবতই কপালে চিন্তার বলিরেখা সুস্পষ্ট হয়ে পড়ে। কেননা, যে সমাজ তার ৬ মাসের কন্যাসন্তান থেকে শুরু করে শতবর্ষী বৃদ্ধা মাকেও ধর্ষণের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না, সে সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত অর্জনকে সফলতা হিসাবে দাবি করা আমার জন্য বিড়ম্বনাও বটে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকার, মন্ত্রী-উপমন্ত্রীসহ নারীর ক্ষমতায়নের কিছু চকচকে উদাহরণ থাকলেও সমগ্র নারী সমাজের প্রতিচ্ছবি অনেকটা বাতির নিচে আঁধারের মতোই। কী দুর্ভাগ্য আমাদের, নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছিনিয়ে এনেছিল যে স্বাধীন বাংলাদেশ, সে দেশ আজও নারীর নিরাপদ আশ্রয় মাতৃকোল হয়ে উঠতে পারেনি।
দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান নারীকে সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সম অধিকার দিয়েছে। সংবিধানের এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যকর রয়েছে নারীবান্ধব বিভিন্ন আইন ও নীতিমালা। তা সত্ত্বেও নারীর এই অস্বীকৃত এবং অবমূল্যায়িত জীবনের পেছনে রয়েছে নারী বিরোধী নেতিবাচক সমাজ মনস্তত্ত্ব। আমাদের সমাজে এখনও পুরুষ প্রাবল্য প্রকট।
আমার ছাত্রজীবন অনেকাংশে সুখকর হলেও এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি নানামুখী নীরব নির্যাতন ক্রমশই বর্ধমান। এমনকি নারী যখন নিজ যোগ্যতায় কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করে, ঠিক তখনই যোগ্যতার মাপকাঠিতে তলিয়ে থাকা সহকর্মীরা নানা কূটকৌশলে তার গতিরোধের চেষ্টায় লিপ্ত থাকে।
আশার কথা হলো বর্তমান সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে নারীর অবস্থানে। সরকার পরিচালনা থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ক্রীড়াঙ্গণসহ দেশের প্রায় সকল খাতেই নারীর সক্রীয় অংশগ্রহণ ক্রমশ দীপ্তমান হচ্ছে।
কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, স্বাধীনতা শব্দটির সাথে নিয়ন্ত্রণ ও পরিমিতিবোধ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই পুরুষ বিদ্বেষ নয়, বরং নারীর স্বাধীনতা ও সাফল্যের জন্য চাই নারী পুরুষের সহাবস্থান। নানা প্রতিবন্ধকতার বালুচর পেরিয়ে আজ আমার অবস্থান সম্মানজনক এক পেশায়। স্বপ্ন দেখি সেই দিনটির, যে দিন আমার সন্তানতুল্য ছাত্র-ছাত্রীরা সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজমান নারীবিদ্বেষী অন্ধকার দূরীভূত করতে সক্ষম হবে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর প্রাক্কালে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২০ এ আমাদের অঙ্গীকার হোক নারীর অধিকার ও উন্নয়ন বিরোধী সকল প্রতিবন্ধকতা জয় করে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন।
লাবণী খাতুন
তিনি এ বছর প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত একজন নারী। লাবণী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের স্নাতকোত্তরের একজন গুণী শিক্ষার্থী । তিনি শুনিয়েছেন তার এবং নারীর সফলতার গল্প।
আমি একটি স্বল্পশিক্ষিত পরিবারে বেড়ে উঠেছি, যেখানে স্কুলের গণ্ডি পেরোলেই পিতামাতা বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করেন। যদিও পরবর্তী সময়ে আমি তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমান সময়ে নারীর প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারীর নিরাপত্তাহীনতা। আমি আইনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছি। প্রধানমন্ত্রী স্বর্নপদক ২০১৮ পেয়েছি। এ পর্যন্ত আসতে আমাকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এমনকি এখনো হচ্ছে। প্রধান সমস্যা হচ্ছে নিরাপত্তাহীনতা। দূরে কোথাও পরীক্ষা দিতে যাবো ভয় লাগে বাসে, পথে-ঘাটে হেনস্তার শিকার হব কিনা। তবে, এই ভাবনা দূরীকরণে এবং নারীকে তার সঠিক মান দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে নিরলস ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
নারী আজ সর্বক্ষেত্রে সফল। এই সফলতা আমাদের চারপাশে নজর দিলেই দেখা যায়। প্রধানমন্ত্রী স্বর্নপদক ২০১৮ পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে ৮৪ জন ছেলে ছিল এবং বাকি ৮৮ জনই মেয়ে। আগে যেখানে নারীদের চার দেয়ালে আটকে রাখা হত, সেখানে আজ নারীরা কর্মজীবী নারী হিসেবে গড়ে উঠেছে। এইতো সমাজের সফলতা। একজন নারী হিসেবে আমার সফলতা।
মাহমুদা মাহি এবং লাবণী খাতুন
মাহমুদা মাহি
মাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের একজন শিক্ষার্থী। তিনি কথা বলেছেন নারী উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ নিয়ে।
আদিকালের আরো ১০টা পরিবারের মতো আমার পরিবারে আমরা দুই বোন হওয়ায় বাবারও খুব আক্ষেপ ছিল। তার আক্ষেপ কমাতে তিনি আমাদের দু’জনকে সব কাজে সর্বদা সহায়তা করেছেন। তিনি চেয়েছেন আমরা স্বাবলম্বী হই। ছেলে থেকে কম কিছু ভাবেননি। পরিবার থেকে কখনো কোনো প্রতিবন্ধকতা আসেনি, কিন্তু পরিবারের বাইরের মানুষ এবং সমাজ থেকে এসেছে অনেক প্রতিবন্ধকতা, অনেক কটু কথা।
বর্তমান সমাজের নানা মানুষের নানা দৃষ্টিভঙ্গি নারীর অনেক বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, লোকে কী বলবে এইটা ভেবেই নারী অনেকটা পিছিয়ে। সমাজে আপনি যাই করেন না কেন, মানুষের কথা শুনতেই হবে, ভালো হোক খারাপ হোক। সফল না হওয়া পর্যন্ত কেউ আপনার পাশে থাকবে না। আমি একজন নৃত্যশিল্পী, আর এইটার জন্য আমার বাবা-মা ছাড়া পরিবারের আর কেউ সমর্থন করেনি।
তবে বলতে পারি, আগের চেয়ে সমাজে এখন নারীর স্বাধীনতা অনেক বেশি, কিন্তু স্বাধীন হলেও মেয়েরা এখনো নিরাপদ না। যে পরিমাণে ধর্ষণ হচ্ছে আমাদের সমাজে, এ কারণেই পরিবার তার মেয়ে নিয়ে এত বেশি চিন্তিত থাকে।
আমার একটা সুযোগ হয়েছিল নিজের ভার্সিটিকে রিপ্রেজেন্ট করার, সেখানে গিয়ে যখন আমি নিজেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেই, তখন সবাই খুব আশ্চর্যজনকভাবে তাকিয়েছিল। অনেকেরই ধারণা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক কিছুই হয় না। এ রকম একটা ভার্সিটি থেকে আমি একা একজন নারী নিজের ভার্সিটিকে রিপ্রেজেন্ট করছি, সবাই খুব সাধুবাদ জানিয়েছিলেন।আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়কে সবার সামনে তুলে ধরতে পেরেছি, এটাই আমার সার্থকতা।এটি আমার অনেক বড় অর্জন বলে আমি মনে করি।
আর তার চেয়েও বড় অর্জন ছিল নৃত্যাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করা।উদ্যোগ নিয়েছিলাম, যারা নাচকে ভালোবাসে তাদের জন্য একটি সংগঠন গড়তে।আমি পেরেছি সেই সকলের জন্য এমন একটি সংগঠন উপহার দিতে।আসলে এটি শুধু সংগঠন নয়, এটি সব নৃত্যশিল্পীদের ভালোবাসার জায়গা। অনেক নারীই তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারে না, কিন্তু আমি সবার সহযোগিতায় সেটা পেরেছি।আমি নিজেকে সত্যিই ভাগ্যবান মনে করি।
শারীন সুলতানা মিম
বিশ্ববিদ্যালয়ে লালনকন্যা নামে খ্যাত গায়িকা মিম ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, নারী হিসেবে আমাকে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়নি বরং আমি সবার পরিপূর্ণ ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছি।তবে, নারীদের কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকেই। কখনো পরিবার থেকে, কখনো বা সমাজ থেকে। কিন্তু আমি মনে করি, নারীর প্রধান প্রতিবন্ধকতা নারীরা নিজেই। আর পুরুষশাসিত এ সমাজ তো আছেই। নিজেদের দুর্বল ভেবে নেওয়াটা আসলে নারীর জন্য প্রতিবন্ধকতা। বলতে পারি, নারীদের প্রতিবন্ধকতার শেষ নেই। এসব কিছুর মধ্য দিয়েই নারীরা আজ এগিয়ে চলছে।
এ যুগের নারী যথেষ্ট স্বাধীন, কিন্ত এই স্বাধীনতাও আমাদের সমাজের মানুষ ভালো চোখে দেখে না। কারণ হলো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, যা আমাদের মানসিকতা ও বিবেকের বিপর্যয়। তবে, বর্তমান সমাজে নারীদের প্রতি অনেকটাই ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও শহরের চেয়ে গ্রাম অনেক পিছিয়ে।
আমি একজন গায়িকা, তার চেয়ে বড় বিষয় আমি একজন মুসলিম পরিবারের মেয়ে। তাই প্রতিবন্ধকতা এসেছে অনেক। তবে পরিবার থেকে নয়। বাইরের মানুষগুলো থেকে, তাই খুব একটা কিছু করতে পারেনি, কিন্তু বহুবার সমালোচিত হয়েছি। গান রেওয়াজ করার সময় যাতে শব্দ বেশি দূরে না যায়, তাই ঘর আটকে রেওয়াজ করেছি। হাল ছাড়িনি, কারণ ভালোবাসি এই গানকে। হাজারো প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও গানকে ভালোবেসে গেছি। পথ চলতে গেলে এ প্রতিবন্ধকতাগুলো মনে খুব বাজেভাবে প্রভাব ফেলে। সামনে আগানোর তেজটা দমে যায়। কিন্তু এগুলো পেরিয়ে আজ যখন সেসকল মানুষগুলোই প্রশংসা করে, তখন খুব ভালোলাগে।
গান নিয়ে ছোটবেলা থেকেই চলাচল, বিশেষ কিছু চ্যানেল যেমন বৈশাখী, চ্যানেল ওয়ান, চ্যানেল আই, বিটিভি, বরিশাল বেতারে মোটামুটি নিয়মিতই ছিলাম। ‘তারায় তারায় দ্বিপ শিখা’ নামক চ্যানেল আই’য়ের একটা অনুষ্ঠানে সারা বাংলাদেশে তৃতীয় হয়েছিলাম। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়েও সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। যতটুকু সাফল্য এসেছে আমার জীবনে, তার জন্য আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া। ইবি/হাকিম মাহি