মতামত

কপিরাইট আইন: বাস্তবতা ও প্রত্যাশা

মানুষের অন্তর্নিহিত তাড়না সভ্যতার পথ চলার বাহন। সৃজনমনস্ক মানুষের জিজ্ঞাসু মন সভ্যতার চাকাকে সজোরে ঘুরিয়েছে। সৃজনশীল মানুষ সৃজনানন্দে বিভোর হয়ে থাকলেও সৃজনকর্ম থেকে আয় এবং ধারাবাহিকতা রক্ষার তাগিদও অনুভব করে আধুনিক যুগে। মধ্যযুগে সৃজনমনস্ক মানুষ বৈষয়িক ভাবনায় উদগ্রিব ছিলেন না।

ইতিহাসের পাঠ বলে দেয়, সতেরো শতকে ইংল্যান্ডে বই মুদ্রণকে কেন্দ্র করে লেখক ও প্রকাশকের সুরক্ষার জন্য আজকের দিনের কপিরাইট আইনের মতো কিছু বিধানের প্রচলন হয়। আধুনিককালে লেখক-প্রকাশকসহ সকল সৃজনকর্মের স্রষ্টার অধিকারকে স্বীকৃতি, সুরক্ষা ও দীর্ঘমেয়াদী আয় অর্জনের নিমিত্তে নৈতিক ও আর্থিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় কপিরাইট আইনের ব্যানারে। আজ বিশ্বস্বীকৃত সার্বজনীন কপিরাইট আইনের মান্যতা রয়েছে। কোনো সৃজনকর্মের প্রণেতা তার সৃজনকর্মের বিভিন্ন পন্থায় পুনরুৎপাদন, বিক্রয়, বাজারজাতকরণ, লাইসেন্স প্রদান এবং জনসম্মুখে প্রদশর্নীর ক্ষেত্রে প্রণেতার একচ্ছত্র অধিকারের বিষয় আইনে নিশ্চিত আছে। কপিরাইট আইন বা মেধাস্বত্ব আইন সুসংসহত করতে উন্নত বিশ্ব ১৮৮৩ সালের প্যারিস কনভেনশন, ১৮৮৬ বার্ন কনভেনশনে পেটেন্ট, ডেনমার্ক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজাইন, জিওগ্র্যাফিক্যাল ইনডিকেশন, কপিরাইট বিষয়গুলোকে আমলে এনেছে বিশ্বময়। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কনভেনশনের বিষয়গুলোকে মেনে অনুস্বাক্ষর করেছে। ফলে বাংলাদেশে বিদ্যমান কপিরাইট আইন আন্তর্জাতিক আইনগুলোর আলোকে দেশীয় আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে কপিরাইট আইন-২০০০ (২০০৫ সালে সংশোধিত) কার্যকর আছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত দপ্তর সংস্থা হিসেবে রেজিস্ট্রার অব কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়াদি দেখভাল করে থাকে।

বাংলাদেশে বিদ্যমান কপিরাইট আইনের (৯৩)১ ধারা অনুযায়ী সাব-ইন্সপেক্টরের নি¤œতর পদাধিকারী নন, এমন যে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেফতারি পরোয়ানা ছাড়াই পাইরেসি সংক্রান্ত কর্মের সব অনুলিপি বা যন্ত্রপাতি বা দ্রব্যসামগ্রী এবং অনুলিপি তৈরির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সব প্লেট বা যন্ত্রপাতি বা দ্রব্যসামগ্রী যেখানেই পাওয়া যাবে তা জব্দ করতে পারেন। কিন্তু দুঃজনক হলেও সত্য এই বিষয়টি অনেক পুলিশ কর্মকর্তা জানেন না। পুলিশ বিভাগের প্রশিক্ষণে দায়িত্ব, শৃঙ্খলা এবং ফৌজদারীর কার্যবিধির প্রত্যক্ষ অপরাধমূলক বিষয়গুলোকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় সৃজনকর্মের রক্ষণের জন্য কপিরাইট আইনকে সে রকম গুরুত্ব দিয়ে প্রশিক্ষণে আমলে নেয়া হয় না। ফলে কপিরাইট বিষয়ে কোনো প্রতিকার চাইতে গেলে পুলিশের কাছে কপিরাইট আইনের প্রতিপালন সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য না থাকায় অনেক সময় পুলিশ অনীহা দেখায়। প্রচলিত আইনে রেজিস্ট্রার অব কপিরাইটকে যৎসামান্য দেওয়ানী ক্ষমতা (যেমন কোনো ব্যক্তিকে সমন প্রদান করে হাজির হতে বলা) দেওয়া হলেও সে ক্ষমতা তামিল করার জন্যও আবার পুলিশের শরণাপন্ন হতে হয়। পুলিশ রেজিস্ট্রারে দপ্তরের কাজের দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখালেও রেজিস্ট্রারের তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ থাকে না। 

এমন বাস্তবতায় কপিরাইট আইনকে সময়বান্ধব ও কার্যকর করতে সরকার বিলম্বে হলেও ২০১৭ সালে কপিরাইট আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। আইন সংশোধনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমিসহ অনেকে নতুন আইন যেন পুরাতন আইনের সীমাবদ্ধতা রহিত করে অংশীজনদের চাহিদা মেটাতে পারে এবং আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারার বর্ণনা, ব্যাখ্যা সহজ ও অধিক গ্রহণযোগ্য হয় সে বিষয়ে তৎপর হই। নতুন প্রস্তাবিত আইনের প্রণিধানযোগ্য দিকগুলো হলো :

প্রস্তাবিত নতুন আইন:

 কপিরাইট এর একটি সহজ সংজ্ঞা সংযোজন করা হয়েছে। সময়ের দাবি অনুসারে বেশ কিছু উপধারা (সংজ্ঞা)- যেমন নৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, রিলেটেড রাইটস, পাবলিক ডোমেইন, সংকলক প্রভৃতি সংযোজন করা হয়েছে। শিল্পকর্মের সংজ্ঞাসহ বেশ কিছু উপধারা আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ক্রেজিস্ট্রারের আদেশের রিভিউ করার বিধান রাখা হয়েছে। কপিরাইট ট্রাস্কফোর্সকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কয়েকটি জটিল ধারা ভেঙে বিভিন্ন উপধারায় বিভক্ত করে সহজীকরণ করা হয়েছে (যেমন ধারা ৫২)। কপিরাইট লঙ্ঘনজনিত মামলা দায়রা জজ ছাড়াও দ্রুত নিস্পত্তির স্বার্থে বিশেষ আদালত বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারবে। এ সংশ্লিষ্ট একটি বিধান রাখা হয়েছে। লোকজ্ঞান ও লোক-সংস্কৃতির অধিকার সুরক্ষা পাবে প্রস্তাবিত এই আইনে (অধ্যায় ৭ক)-এ লোকসংস্কৃতির নি¤œরূপ অভিব্যক্তিসমূহ সুরক্ষা করা হবে, যথা-(ক) লোকসংস্কৃতির মৌলিক অভিব্যক্তি (খ) লোকসংস্কৃতির সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তিসমূহ (গ) লোকসংস্কৃতির শারীরিক কসরৎ-প্রধান অভিব্যক্তিসমূহ (ঙ) লোকসংস্কৃতির মূর্ত অভিব্যক্তিসমূহ (চ) লোকভাষা, চিহ্ন, প্রতীক ইত্যাদি (ছ) লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় অভিব্যক্তি (জ) সনাক্তকৃত নতুন কোনো মূর্ত বা বিমূর্ত অভিব্যক্তি। প্রস্তাবিত আইনে এই বিষয়ে একটি অধ্যায় নতুন সংযোজন হয়েছে। বিদ্যমান আইনের একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে সচেতনতার অভাব। এ লক্ষ্যে কপিরাইট বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সচেতন করতে প্রদত্ত আইনে নানা পদক্ষেপ আছে। ডিজিটাল মিডিয়ার সুযোগে ইউটিউবসহ নানা গান, নাটক, ইত্যাদির উর্পাজনে প্রণেতাকে উপেক্ষা করা হয়। প্রস্তাবিত আইনে উল্লেখিত মাধ্যম থেকে অর্জিত আয়ে প্রণেতার অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাংলাদেশের কার্যকর কপিরাইট কোনো সমিতি নাই। নতুন আইনে কপিরাইট কমিটি গঠন করে এক্ষেত্রে অবদান রাখার সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছে। ছাপানো হরফে যে কোনো বই দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পড়ার উপযোগী নয়, সেগুলো ডিজিটাল টকিং বই, ব্রেইল বই, অ্যাকসেসিবল ইলেকট্রনিক টেক্সট অথবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য পাঠযোগ্য করার ক্ষেত্রে কপিরাইট আইনে ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কপিরাইট আইনের এই সামান্য পরিবর্তন ঝউএ এঙঅখ সবার জন্য একীভূত শিক্ষা অর্জনে সহায়ক হবে। প্রতিবন্ধীদের বৃহত্তর স্বার্থে আইনের চলতি সংশোধনীতে উল্লেখিত বিষয়টির সংশোধনের জন্য বিবেচনা করা হবে। এ লক্ষ্যে একটি নতুন উপধারা সংযোজন করা হয়েছে। কপিরাইট বিষয়ক রেগুলেটরি হিসেবে কপিরাইট অফিসকে পূর্বতন অবস্থা থেকে অধিকতর শক্তিশালী করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইন প্রয়োগ ক্ষেত্র কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শাস্তি ও জরিমানা বৃদ্ধি, ট্রাস্কফোর্স গঠন ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৯৩ ধারায় পুলিশ যেন কাউকে অহেতুক হয়রানি বা কেউ হটকারি আচরণের শিকার না হয় এজন্য “রেজিস্ট্রার বা উপযুক্ত প্রতিনিধি দ্বারা অবহিত”- এমন শব্দ সংযোজন করা হয়েছে। এই সংযোজনীতে বলা হয়েছে “লঙ্ঘিত অনুলিপি জব্দ করিতে পুলিশে ক্ষমতা” (১) সাব-ইন্সপেক্টরের নি¤œতর পদাধিকারী নহেন এমন যে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যদি এই মর্মে রেজিস্ট্রার বা উপযুক্ত প্রতিনিধি দ্বারা অবহিত হন যে, ধারা ৮২ এর অধীনে কোনো কর্মের বা ধারা ৮৪ এর অধীনে কোনো কম্পিউটার কর্মের কপিরাইট লঙ্ঘনজনিত কোনো অপরাধ সংঘটিত হইয়াছে, হইতেছে বা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাহা হইলে তিনি গ্রেফতারী পরোয়ানা ছাড়াই কর্মটির সকল অনুলিপি লঙ্ঘনকারী অনুলিপি তৈরি, বিতরণ, প্রদর্শন ও বহনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সকল প্লেট, সামগ্রী, উপকরণ যেখানেই পাওয়া যাক- জব্দ করিতে পারিবেন। যে-কোনো অনুমোদিত সম্প্রচার বন্ধে কপিরাইট অফিসকে ক্ষমতায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। নতুন আইনে কপিরাইটের আওতা, প্রণেতার আর্থিক অর্জন সুসংতহকরণ ও এ বিষয়ক বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন সর্বোপরি প্রয়োগ ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত উদ্যোগের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। নতুন আইনের খসড়ার ২(৬) ধারায় সংযোজন করে বলা হয়েছে- কপিরাইট অর্থ সৃজনকারীর সৃজনশীল কর্মের পুনরুৎপাদন করার অধিকার এবং সৃজনশীল কর্মের উপর সৃজনকারীর নৈতিক ও আর্থিক অধিকার। নতুন আইনের খসড়ার ৮৩ ধারায় সংযোজন করে বলা হয়েছেÑ কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনে শাস্তি তিন বছরের স্থলে পাঁচ বছর এবং অন্যুন ছয় মাসের পরিবর্তে এক বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত সংশোধিত নতুন কপিরাইট আইনে অংশীজনদের প্রত্যাশাপূরণ এবং আইনের বিধানকে সুসংহত করার প্রচেষ্টা রয়েছে। বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে একটি নতুন আইন প্রণয়ন কিংবা পরিমার্জনে এতটাই সময়ক্ষেপণ করা হয় যে আইনটি যখন জনগণের জন্য উন্মুক্ত হয় তখন আইনটি অনেকাংশে সময় উপযোগিতা হারায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় আমাদের প্রস্তাবিত কপিরাইট আইন সে দিকেই হাঁটছে। ২০১৭ সালের পরিমার্জন করা আইন এখনও প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের (সংস্কৃতি) পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। পরবর্তী পর্যায়ে জনপ্রশাসন, আইনসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের চৌহদ্দি পার হতে কতটা সময় ব্যয় হয় সেটাই বিবেচ্য।

প্রস্তাবিত পরিমার্জনকৃত কপিরাইট আইন ২০১৭ সালে প্রস্তাবিত হলেও তা এখন কপিরাইট আইন ২০২০ হিসেবে অুমোদনের প্রহর গুনছে। সংশোধিত আইন ই-বুকের মাধ্যমে যে অবৈধ কনটেন্ট বাজার সয়লাব করছে সে বিষয়ে সুরক্ষায় বেশ কিছু কার্যকর বিধান সংযুক্ত করছে। এখন কর্তৃপক্ষের আন্তরিক হয়ে আমলাতন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে বাস্তবতা ও পারিপাশ্বিক অবস্থা বিবেচনায় সংশোধিত আইন পাশ করে দিতে হবে। এখনো আইনটি পাস হলে চলমান অনেক সমস্যার সমাধান হবে এবং আইনের প্রতিপালনের মাধ্যমে সৃজনকর্মের স্রষ্টার আর্থিক ও নৈতিক অধিকার রক্ষা করে সৃজনশীল মানুষকে উদ্ভাবনী কাজে নিয়োজিত রাখা যাবে। না হলে সৃজনপিপাসু মানুষ বঞ্চনার যন্ত্রণা নিয়ে ধীরে ধীরে সৃজনে অনাগ্রহী হবে- যা জাতীয় জীবনে অশনি সংকেত।

ধারণা করা হয়, সামনের সময়গুলো হবে ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টির। কাজেই পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে কপিরাইটের নতুন চ্যালেঞ্জে আমরা যদি আইন, বিধি, সচেতনতাসহ সার্বিক সফলতা নিয়ে এগুতে পারি তবেই সৃষ্টিশীল কাজের স্বত্ব যেমন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে, তেমনি সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত লেখক, প্রকাশক, শিল্পী, সাহিত্যিকগণের সামাজিক মর্যাদা বাড়বে, সৃষ্টিশীল ক্ষেত্রটিও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে।

লেখক: সংশোধিত কপিরাইট আইন জাতীয় কমিটির সদস্য ও খ-কালীন শিক্ষক, মুদ্রণ ও প্রকাশনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা/তারা