বৈশাখের পড়ন্ত বিকেল। প্রতিদিনের ন্যায় ঘুরতে বের হয়েছিলাম। হাঁটছিলাম মৈনারটেক রাস্তার পাশ ধরে। কয়েকটা গোলির মোড় পার হতেই অনুধাবন করলাম কান্নার আওয়াজ। থমকে গিয়ে মন দিলাম কান্নার আওয়াজে। বুঝতে পারলাম যেন এক বৃদ্ধা মায়ের আহাজারি। কৌতূহল নিয়ে সামনে আগালাম। হঠাৎ দৃষ্টি কেড়ে নিলো একটি সাইনবোর্ড। তাতে দেখতে পেলাম মোটা অক্ষরে লেখা আছে ‘আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম’। ততক্ষণে আর বোঝার বাকি ছিল না।
সামনে এগুতেই দেখি একজন বৃদ্ধা মা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম মা আপনি কাঁদছেন কেন? চোখের পানি মুছতে মুছতে আমাকে বললো বাবা! আমি এক কারাগারে বন্দি। ছেলে সন্তান কেউ খোঁজ নিতে আসে না আমার। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করার আগে সে জানালার পাশ থেকে চলে যায়।
জানতে পারলাম আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমটি সৈয়দা সেলিনা শেলী আপার ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়া। সেখানে কাজ করে একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন। তাদের কাছ থেকে জানা যায়, এই বৃদ্ধাশ্রম গড়ার পেছনের ইতিহাস। অবহেলিত এই মা নামক ভালোবাসাগুলোর জীবনের নিদারুণ গল্প।
এখানে আশ্রিত যারা তাদের বেশির ভাগই শারীরিক অথবা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। জরাজীর্ণ সেই ভবনে নেই গ্যাস, ইলেকট্রিসিটি কিংবা পানির সুব্যবস্থাও।
এদের কাউকে সাভার, কাউকে টঙ্গী, কাউকে পুরনো ঢাকার কোনো এলাকা থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছে সম্পূর্ণ নগ্ন, অত্যাচারিত কিংবা আহত অবস্থায়। মানুষগুলো ভারসাম্যহীন অবস্থায় নিজের ময়লা নিজেই খেয়েছে বহুদিন। ছেলে সন্তানরা কেউ খোঁজ নেয় না এদের। কিছুক্ষণ পর সেখান থেকে বের হয়ে আসলাম। সাইনবোর্ডের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবলাম, হয়তো মানবসভ্যতার নাম দিয়েছে বৃদ্ধাশ্রম।
কিন্তু নিজেই অনুধাবন করলাম, বৃদ্ধাশ্রম নয় যেন ভালোবাসার এক নিষ্ঠুর কারাগার। মা নামক এই ভালোবাসাগুলো বুঝি সারাদিন এই জানালা দিয়ে অপলোক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে এই বুঝি তার কেউ এলো, তাকে বুকে জড়িয়ে বললো, মা নিয়ে যেতে এসেছি তোমায়, চলো তুমি আমার সাথে আমার ঠিকানায়। ততক্ষণে হারিয়ে যাই এক ভাবনার জগতে। এই মানুষগুলোর ইচ্ছেগুলো বুঝি পূরণ হয় না। তাদের ছেলে সন্তানরা কেউ বুঝি আসে না একটা বারও দেখা করার জন্য।
অথচ, একদিন এই মানুষগুলো কতই না যত্নে বুকে জড়িয়ে লালন করেছিল আমাদের। সেই আমরাই তো আজ ইতিহাসে সভ্য মানব নামে পরিচিত। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আর বছরের পর বছর কতই না কষ্ট সহ্য করে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিল আমাদের। জন্মের পর যখন আমাদের কান্নার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিল না, তখন পাশে যে মহীয়সী নারী ছিল, সেই মা নামক ভালোবাসাটাকে আজ বৃদ্ধাশ্রম নামক চার দেয়ালের কারাগারে ফেলে রেখেছি।
আমাদের দৃষ্টির পালক নাড়তে সাজানো-গোছানো যে সবুজ পৃথিবীটা দেখতে পাই, সেই পৃথিবীটা হয়তো এতটা সাজানো গোছানো থাকতো না, যদি না ‘মা’ নামক বিধাতার এই শ্রেষ্ঠ উপহার না থাকতো। ছোটবেলায় যখন খেতে চাইতাম না, তখন এই মা কতই না আদর করে মুখে খাবার তুলে দিতো। কিন্তু আজ সে মা কেমন আছে, কীভাবে আছে তা আমাদের জানা নেই। মা ছিল আমাদের খেলার সাথী, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তাদের লাঠি হিসেবে আমরা নিজেদের তৈরি করতে পারিনি।
ভাবতে ভাবতে নিজের ভেতর প্রশ্ন জাগে, এই ভালোবাসাগুলো আর কতদিন এভাবে থাকবে? কোথায় গিয়ে থামবে শতাব্দীর এই রুদ্ধ শ্বাস? মা তো সেদিনও খায়নি আমি খাইনি বলে। কিন্তু মা আজও খায় না, আমি মাকে খাবার দেই না বলে। যে মা দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছিল, অসহ্য প্রসবের যন্ত্রণা সহ্য করেছিল, সেই মাকে এভাবে ফেলে রেখেছি, প্রকৃতি কি ক্ষমা করবে আমাদের?
আমাদের ভাবতে হবে একদিন আমরাও বৃদ্ধ হবো। আজ আমরা আমাদের ভালোবাসাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছি, একদিন হয়তো আমাদেরও আশ্রয় হতে পারে এই বৃদ্ধাশ্রমে। তখন আমরাও আশায় থাকবো, কেউ এসে আমাদের বুকে তুলে নেবে। জড়িয়ে ধরে বলবে, তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই।
বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে বন্দি হয়ে পচতে থাকা ভালোবাসাগুলো ক্রয় করে বুকে তুলে নেওয়ার সামর্থ্য আমাদের কারোরই হয়তো নেই, তাই হয়তো এই কারাগার তাদের শেষ ঠিকানা। সভ্যতা তৈরি করা যেই মানুষটি আজ বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে বন্দি হয়তো সেই সভ্যতা একদিন নিজেও এই কারাগারে বন্দি হয়ে যাবে। এটাই সত্যি যে, পৃথিবীর চেয়েও গুরুভার কিছু যদি থাকে, তা হলো মা। তাই আসুন বৃদ্ধাশ্রমকে না বলি। সবাই বুকে তুলে নেই এই ভালোবাসাগুলোকে। মনে রাখবো, পুরোপৃথিবী বিক্রি করলেও মা নামক ভালোবাসাগুলো ক্রয় করা সম্ভব হবে না।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ। ঢাকা/হাকিম মাহি