উপস্থাপনা বলতে স্বাভাবিকভাবে মানুষের সামনে নিজের কথা এবং প্রতিভাগে তুলে ধরাকেই বুঝি। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, নিজে বুঝি বা বুঝেছি অথাবা নিজে জানি বা যে বিষয়ে নিজের পুঁথিগত এবং বাস্তবিক জ্ঞান আছে, তা অন্যদের কাছে তুলে ধরাটাকেই উপস্থাপনা বলা যায়। মূলত দর্শকের সামনে তুলে ধরাই উপস্থাপনা।
আজকের আলোচনার বা উপস্থাপনের বিষয় হচ্ছে ‘আমার কাছে একটি ভালো উপস্থাপনার সংজ্ঞা’। অর্থাৎ কীভাবে একটি ভালো উপস্থাপনা করা যায়, আর সেই বিষয়ে আমার কী মনে হয় বা ধারণা টা কী? ভালো উপস্থাপনা সম্পর্কে জানতে হলে আমার মনে হয় উপস্থাপনার কিছু তাত্ত্বিক বিষয় সম্পর্কে জানাটা জরুরি।
এই জন্য প্রথমেই জানা দরকার একটি ভালো এবং সফল উপস্থাপনার জন্য ৩টি বিষয় সবসময় উপস্থাপকের মাথায় থাকতে হবে।
Understandable বা বোধগম্য
অবশ্যই উপস্থাপককে বুঝতে হবে দর্শক কেমন, তাদের বুঝতে পারার শক্তি কতটুকু, কী পরিমান তথ্য দিতে হবে, কেমন ভাষা ব্যবহার করতে হবে। মোট কথা সহজে এবং সহজ ভাষায় বোঝাতে হবে।
Memorable বা মনেরাখা
আমি যা বলব, তা যেন নিজে মনে রাখতে পারি। এই জন্য ৩ বা ৭টা পয়েন্ট করে নিয়ে সেগুলোর ব্যাখ্যা করতে হবে। তবে ৩ হচ্ছে জাদুকরী সংখ্যা, যা উপস্থাপক এবং দর্শক সবাই মনে রাখতে পারেন।
Emotional বা আবেগীয় করা
উপস্থাপনাটা আবেগীয় করতে হলে অবশ্যই গল্প বলে, সিন সেটিং দিয়ে উপস্থাপনা শরু করতে হবে। তবে, যেটাই বলি না কেন তা বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত হতে হবে। যেন মানুষের মনে তা গেঁথে থাকে।
তাত্ত্বিকভাবে আরও ৭টি বিষয় রয়েছে, যা একটি ভালো উপস্থাপকে এড়িয়ে চলতে হয় ভালো একটি উপস্থাপনা পরিবেশন করার জন্য।
Sloth বা অলস
উপস্থাপনের জন্য বারবার চর্চা করতে হবে, পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে হবে, অন্য কারো লেখা কপি-পেস্ট না করা এবং বিশ্বাসটা ঠিক রাখা।
Envy বা হিংসা
অন্য কাউকে হিংসা না করে বা সে আগে থেকেই ভালো বক্তা না বলা যেতে পারে। নিজের কাজে পরিশ্রম বেশি করলে তার মতো ভালো বক্তা হওয়া যাবে।
Gluttony বা অতি ভোজন
The more i say, the more i am a good speaker. অনেক কথা বা তথ্য দিলেই হয় না, বরং মানুষ যতটা নিতে পারে, ততটা দিতে বা বলতে হবে। কম এবং কাজের কথা বলা।
Pride বা অহংকার
প্রথমত, দর্শককে ছোট করে কথা না বলা, নিজেকে জাহির করার চেষ্ট না করা। আর আমি মাইক এবং স্টেজ পেলেই ভালো বলতে পারবো এমন চিন্তা না করা।
Greed বা লোভ
সময়ের ব্যাপারে চিন্তা করা। বেশি কথা না বলা। সময় চেয়ে নিয়ে আরও কিছু বলতে চাই বললে বোঝা যায় যে প্রস্তুতি ভালো নেই। এই জন্য ৩টি বিষয় মাথায় রাখতে হবে
(ক) যা অবশ্যই বলবো।
(খ) যা বলা উচিৎ।
(গ) যা সময় পেলে বলবো।
Wrath বা রাগ/ক্রোধ
দর্শক কখনো কখনো এমন কোনো প্রশ্ন করে, যাতে রাগ হতে পারে। তবে তার মতের উপর সম্মান জানাতে হবে। তার উপর রাগ করা যাবে না।
Lust বা কামনা বা প্রবল আগ্রহ
দর্শককে ছোট করার চেষ্টা না করা। এমন কোনো কথা না বলা, যাতে তাদের হেও করা হয়।
উপস্থাপনার প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বিষয় মাথায় রাখা খুব জরুরি। আর তা হলো আমি কোন ধরনের উপস্থাপনা পরিবেশন করব। অনেক ধরনের উপস্থাপনা থাকলেও মূলত এটি ৪টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
Persuasive বা প্রভাবিত করা
যেকোনোভাবে যেমন কোনো দ্বন্দ্ব মেটাতে বা কোন বিষয়ে আলোচনা করতে নিজের চিন্তা দিয়ে দর্শককে প্রভাবিত করা।
Inspirational বা অনুপ্রেরণীয় শ্রোতা চিন্তা করবে তার কথাগুলো গ্রহণ করলে কী হবে বা না করলে কী হবে। ডিল করা। কোনো সিদ্ধান্ত তৈরি করে দেওয়া, যা সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
উপরের আলোচনায় বলার চেষ্টা করেছি, তাত্ত্বিকভাবে ভালো উপস্থাপনার জন্য কি কি করতে হবে এবং কী বাদ দিতে হবে।
এখন বলতে চাই, আমার কাছে একটি ভালো উপস্থাপনা কী। এর সংজ্ঞা বা আমার মতে ভালো উপস্থাপনার জন্য কি কি করা উচিৎ।
আমার মতে একটি ভালো উপস্থাপনার জন্য অবশ্যই ভালো কনটেন্ট বা ভালো বিষয় দরকার। যা নিয়ে কথা বলতে গেলে মানুষের কাছে তা সহজেই উপস্থাপন করা যায়। তাছাড়া দেখা গেলো আমার দর্শকের মানের থেকে কনটেন্টের মান উঁচু বা নিচু হয়ে গেছে। আর এই জন্যই আমি কী বলতে চাই বা বলছি তা তারা বুঝতে পারছেন না।
শুধু ভালো বিষয় নির্বাচন করলেই হবে না। বরং সেই বিষয় যথাসাধ্য পুঁথিগত এবং বাস্তবিক জ্ঞান থাকতে হবে। বাস্তব জ্ঞান না থাকলে যার এই বিষয়ে জ্ঞান আছে তার কাছে থেকে জেনে নিতে হবে। মোট কথা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে হবে।
কথা বলার ধরনের ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিতে হবে। কীভাবে কথা বললে তা শুনতে ভালো লাগে, সেটা নিজেকে বুঝতে হবে। আর কণ্ঠস্বর যেন খুব জোরে বা খুব আস্তে না হয় সেটা মাথায় রাখতে হবে।
উচ্চারণ সুন্দর এবং নির্ভুল হতে হবে। যেমন সোয়েটারকে যেন ছয়টার না মনে হয়।
শারীরিক ভঙ্গিমায় রুচিশীলতা এবং দেখতে যেন ভালো লাগে, তা মাথায় রাখতে হবে। এমনভাবে দাঁড়াতে হবে যেন শরীরের পেছন দিকটা দর্শকের সামনে না থাকে।
আমার মনে হয় স্লাইড তৈরি করলে ভালো হয়। কারণ এতে দর্শক মনে করেন উপস্থাপক ভালো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। আর স্লাইড তৈরির ক্ষেত্রে বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত ভালো ভালো ছবি প্রদান, লেখার জন্য ভালো ফন্ট, অ্যানিমেশন, ছোট কোনো ভিডিও দেখানো যেতে পারে। তবে ভিডিওর ক্ষেত্রে অবশ্যই শব্দ শোনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। আকর্ষণীয় ভালো রঙ ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে। তবে স্লাইডে বেশি তথ্য না দেওয়াই ভালো। বরং পয়েন্ট আকারে সাজিয়ে সেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়াটা বেশি ভালো।
যে তথ্য দেবো, তার যেন সূত্রটা থাকে। যদি কেউ প্রশ্ন করে বসে, এই তথ্যের সূত্র কী? তাহলে সেটা যেন বলা যায়।
সহজ ভাষায় উপস্থাপন করতে হবে। যেন তা সবার জন্য বোধগম্য হয়। কম কথায় বেশি তথ্য পূর্ণ কথা বলতে হবে। তবে দর্শক যেন বিরক্ত না হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। দর্শককে ভাবাতে বা সে বিষয়ে চিন্তা যেন করে সেইভাবে কথা বলতে হবে। দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য কোনো গল্প দিয়ে বা বর্তমান কোনো ঘটনা দিয়ে কথা বলতে হবে। আকর্ষণ যেন ছুটে না যায় সে জন্য মাঝে মাঝে হাসাতে হবে এবং আবেগীয় কথা বলে দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখতে হবে।
সময়ের মধ্যে উপস্থাপনা শেষ করতে হবে, যাতে মনোযোগ হারিয়ে যাওয়ার আগেই কথা শেষ করা যায়। পোশাকের ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে কেমন, স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে কেমন এবং কর্পোরেট কোনো মিটিংয়ে কেমনভাবে কথা বলতে হবে, তা যেন ঠিক থাকে। কেউ ঠাট্টা করে কিছু বললে তাতে রাগ না করে বরং এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। কথার আঞ্চলিকতা দূর করতে হবে। বাংলিশ না বলে শুধু বাংলায় বা শুধু ইংলিশে বলতে হবে। ভালো বক্তা বলেই সব সময় ভালো বলতে পারবো এমন চিন্তা না করেই উপস্থাপনা শুরু করতে হবে।
‘কোনো দেশের বুলি, কোনো দেশের গালি’। মানে জায়গা ভেদে ভাষার পরিবর্তন থাকার কারণে কোনটা কোথাকার জন্য গালি বা বাজে কথা সেটা জেনে নিতে হবে। কথার মধ্যে ‘উম’ বা ‘অ্যা’ বা ‘হুম’ বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। নিজস্বতা বজায় রেখে কথা বলতে হবে। যেন কোনো কিছুই মেকি মনে না হয়।
খুব কনফিউজড না হয়ে কনফিডেন্ট নিয়ে কথা বলে যেতে হবে। হাত-পা না কাঁপিয়ে বরং তা নাড়াচাড়া করে উপস্থাপন করতে হবে। তবে যেন মনে না হয় কোনো নেতা ভাষণ দিচ্ছেন। কখনোই আমার উপস্থাপনায় অন্য কারো সম্পর্কে গীবত বা দুর্নাম করা যাবে না।
কোনো ব্যাপারে না জানলে তা নিয়ে তর্ক না করে জানি না সেটা মেনে নিয়ে জানার চেষ্টা করতে হবে। আইন বা ধারা বা সংখ্যা অথবা টাকার পরিমাণ বা গানিতিক কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রে বারবার দেখে নিতে হবে যে সেটা সঠিক কি না। তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে সবশেষ আপডেটটা বলতে হবে।
টেকনিকাল সব জিনিসগুলো ঠিক আছে কি না তা আগের দিন রাতেই ঠিক করে রাখতে হবে। যেন উপস্থাপনার আগে কোনো প্রকার সমস্যা না হয়। উপস্থাপনাকে ৩টি ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। তা হোলো পরিচিতি যে আমি কী বলব। বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা। আর উপসংহার।
এছাড়াও আরও অনেক বিষয় আছে বা থাকতে পারে, যা দিয়ে ভালো উপস্থাপনা কী তা বলা যায়। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে, ভালো উপস্থাপনার জন্য এই বিষয়গুলো মেনে চলা বাঞ্ছনীয় এবং অবশ্য কর্তব্য।
আর আমার কাছে উপস্থাপনা মানেই দর্শকের সামনে তুলে ধরা। আর সেটা নিজেকে এবং যে বিষয়ে বলব সেই বিষটাকে। তবুও আমি মনে করি, ‘Hope for the best, but ready for the worst.’
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
রাবি/হাকিম মাহি