‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।’ এই কথাটি আমরা সেই ছোটবেলা থেকেই শ্রবণ করে আসছি। তবে আজকের বাস্তবতায় এ কথাটি কিছুটা বদলে গেছে। তাহলে কী বলব? হ্যাঁ এটাই বলতে হবে ‘সুশিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।’
শিক্ষা মানুষকে শিক্ষিত করে, কিন্তু সর্বদা সুশিক্ষিত বা প্রশিক্ষিত করে না। সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য চারিত্রিক গুণাবলি বা নৈতিকতা জরুরি। জন্মের পর থেকেই মানবশিশুর শিক্ষার হাতেখড়ি তার পরিবারে। এ জন্য পরিবারকে বলা হয় শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে যে মৌলিক শিক্ষা দেওয়া হয়, সেটাই তার গোটা জীবনের সব শিক্ষার ভিত্তি। সুতরাং যেকোনো শিশুর মানসিক ও দৈহিক বিকাশের জন্য প্রথম ও প্রধান বিদ্যালয় হচ্ছে তার পরিবার এবং মা-বাবা হচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাদের স্নেহ ভালবাসা আর জীবনাদর্শ পেয়েই বয়সে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি একটি শিশু মানবিক ও নৈতিক গুণাবলিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
শিশুদের জীবন একটি ক্ষূদ্র বীজের মতো। একটি বীজের মধ্যে সুপ্তাবস্থায় থাকে অঙ্কুর। সেই বীজ উর্বর মাটিতে রোপিত হলে, অনুকুল পরিবেশ ও পরিচর্যা পেলে ক্রমান্বয়ে বিশাল বৃক্ষে পরিণত হয়। তেমনি একটি মানবশিশু জন্মগ্রহণ করে অপার সম্ভাবনা নিয়ে। সেই সম্ভাবনা বাস্তবরূপে পরিণত হয় শুভাকাঙ্ক্ষী গুরুজনদের প্রতিপালন, পরিচর্যা আর ব্যক্তির নিজ সাধনার গুণে।
মা বাবার এই অকুণ্ঠ স্নেহ ভালোবাসার জন্যই শিশুর মধ্যে সার্বিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটতে শুরু করে। শুধু জৈবিক ও দৈহিক নয়, বরং নৈতিক দিক দিয়ে বিকশিত হতে সহায়তা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তারা তাদেরকে ভালো-মন্দ দুইয়ের পার্থক্য বুঝতে এবং মন্দকে পরিহার করে ভালোকে গ্রহণ করতে শেখান। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, সন্তান যেনো পরিণত বয়সে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কেননা মা-বাবা সবসময় সন্তানের সাথে থাকবেন না। সুতরাং তাদের অনুপস্থিতিতে সন্তান যেনো স্বাবলম্বী হয়ে ব্যক্তিগতভাবে যেকোনো পরিস্থিতিতে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। পক্ষান্তরে এই নীতির বিরুদ্ধাচরণ ঘটলে মানুষের মধ্যে অপরাধবোধ জন্মে। এর বিপরীত পথ অবলম্বন করা মানে নিজের ক্ষতিসাধন।
সভ্যতার শুরুতে মানুষ যখন শিক্ষার পথে পা বাড়ায়, তখন থেকে পরবর্তী কাল পর্যন্ত শিক্ষিত লোকজনের মাঝে সুশিক্ষাই বিরাজমান ছিল। তারা আদর্শবাদী ব্যক্তিবর্গ হিসেবে সবার নিকট সমাদৃত ছিলেন। সে সময় শিক্ষিত মানুষকে ইতিবাচক ভঙ্গিতে দেখা হতো এবং সেটা ছিল সার্বজনীন স্বীকৃত। কিন্তু বর্তমান সময়ে শিক্ষিতজনদের মাঝে সেসব গুণাবলি দেখা যায় না। লোভ লালসা, অর্থের কুপ্রবৃত্তি এবং স্বার্থের জন্য অর্জিত শিক্ষাকে ঠেলে দেয় পায়ের নিচে। নৈতিক গুণাবলি না থাকায় শিক্ষা পরিণত হয় কুশিক্ষায়। এসকল শিক্ষিত মানুষদের নৈতিকতার জায়গায় নিয়ে আসতে একটি কথারই উদ্ভব ঘটে, তা হলো সুশিক্ষা। সুশিক্ষা এবং স্বশিক্ষা একে অপরের পরিপূরক।
সুশিক্ষার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার এমন এক অবস্থা, যা শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে এবং যথাসময়ে স্বশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলে। সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে, হয়ে ওঠে খাঁটি দেশপ্রেমিক। তাদের সার্বক্ষণিক পদচারণায় সত্যের পথ হয়ে ওঠে আলোকিত। সুশিক্ষা মানুষকে সর্বউর্দ্ধে রাখে, নীতিবান হতে সাহায্য করে।
দূঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজব্যবস্থায় শিক্ষিতজনদের ভেতরেও সুশিক্ষার বড় অভাব। চোখ খুললেই চারপাশে বড় বড় ডিগ্রিধারী শিক্ষিত লোক দেখা যায়, তারা কতটা সুশিক্ষিত তা বর্তমান সমাজব্যবস্থার দিকে তাকালেই উপলব্ধি করা যায়। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বাড়ছে শুধু পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। কারণ সবাই এখন পরীক্ষার জন্য পড়ে। নিজে জানার জন্য, জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়ে না। যারা জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়ে, তারাই প্রকৃতক্ষে সমাজের দর্পণ। শুধু পয়সা উপার্জনই শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ নয়। তবে স্থান, কাল পাত্র ভেদে হওয়া দরকার। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উদ্দেশ্যই হওয়া উচিৎ জ্ঞানদান ও জ্ঞান আহরণ।
বিশ্বের অনেক দেশ আজ সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত। এসব দেশের নাগরিকেরা যেমন দায়িত্ববান, তেমনি কর্মঠ। লোভ লালসা তাদেরও আছে, কিন্তু তা চরিতার্থে, তারা কোনো অবৈধ পথ অবলম্বন করেন না। কঠোর পরিশ্রম করেন। একমাত্র পরিশ্রম আর নীতি নৈতিকতার জন্যই জাতীয় উন্নতিতে অবদান রাখেন এবং নিজেদের দেশকে উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাপী।
সুতরাং, সুশিক্ষার জন্য প্রয়োজন লোভ লালসাহীন নৈতিকতাপূর্ণ সমাজব্যবস্থা। জীবনকে বিকশিত করতে হলে নিজেকে সুশিক্ষায় বিকশিত করতে হবে। আর সেই শিক্ষা হতে হবে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধসমৃদ্ধ। সেই শিক্ষায় ভেতর থেকে মানুষকে আলোকিত হতে হবে, সেই আলোয় অন্যকেও সিক্ত করতে হবে। এমন চিন্তাধারাই আমাদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
ইবি/হাকিম মাহি