আমার শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের কিছুটা সময় কেটেছে বাবা নামের বটবৃক্ষের ছায়াতলে। আমাদের পরিবার ছিল অতিথি পরায়ণ একটি পরিবার। সারাদির চুলোয় ভাতের হাঁড়ি চড়ানোই থাকত। আমার বাবা অতিথিসেবা করেই যেন সুখ পেতেন। আমরা দুই ভাই ও চার বোন ছিলাম বাবার চোখের মনি। আমাদের কোনো আবদারই তিনি অপূর্ণ রাখতেন না। অতিথিসেবা ও আমাদের আবদার রাখতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে বাবা অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে নিমজ্জিত হতেন। তারপরও বাজারের সবচেয়ে বড় মাছ, ডজন-ডজন মোরগ আমাদের বাসায় প্রায় নিয়মিতই ছিল। শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের কিছুটা সময় অভাব কি জিনিস আমি বা আমার পরিবারের সদস্যরা চোখেই দেখিনি। শহরের বিশাল অট্টালিকায় ছিল আমাদের পরিবারের বাস। আজ বাবা নেই। আজ থেকে ১৭ বছর আগে ২০০৩ সালে আমাদের রেখে চলে গেছেন পরপারে। তথাপি বাবাকে নিয়ে কিছু স্মৃতি আজও আমার চোখে ঝলমলে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। সে সময়ে আমাদের পুরো এলাকায় শুধুমাত্র মরহুম বশির মিয়া লন্ডনী’র বাসায় একটি ছোট সাদা-কালো টেলিভিশন ছিল। আমাদের পুরো শহরে টেলিভিশন ছিল হাতেগোনাদ। সে সময়ে রঙিন টেলিভিশন ছিল মানুষের কল্পনারও অতীত। সাদা-কালো টেলিভিশনও আমার শহর নয়, পুরো সিলেট অঞ্চলে কিনতে পাওয়া যেত না। টেলিভিশন কিনতে হতো রাজধানী ঢাকা থেকে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যেদিন মারা যান সেদিন টেলিভিশনে বার বার তাঁর মৃত্যুর খবর ও ভিডিও প্রচার করছিল। আমি আরো কিছু বন্ধুসহ জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর খবরটি দেখতে মরহুম বশির মিয়া লন্ডনী’র বাসার পশ্চিম পাশের জানালার সামনে দাঁড়াই। আকস্মিক ওই বাড়ির ছোট ছেলে আমাদের দেখতে পেয়ে গালিগালাজ শুরু করে এবং সটান করে আমাদের চোখের সামনে জানালাটি বন্ধ করে দেয়। আমি তখন খুব ছোট। নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারিনি। জানালা বন্ধ করে দেয়ায় আমি খুব অপমানিত বোধ করছিলাম। কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসি বাসায়। আমার বাবা তখন বাসার একটি কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলেন। আমার কান্নার শব্দে বাবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমাকে তিনি জড়িয়ে ধরে কান্নার কারণ জানতে চাইলে আমি পুরো ঘটনা বাবাকে খুলে বলি। সাথে সাথেই তিনি শোয়া থেকে উঠে আমাকে বলেন, ‘চলো দেখি তোমার জন্য কি করা যায়?’ আমাকে নিয়ে ২০ মিনিটের মধ্যেই তিনি বাসার সামনে থেকে রিকশায় চড়ে বসেন। আমি তখনো জানি না কি হতে যাচ্ছে। তো রিকশা নিয়ে সোজা বাসস্ট্যান্ডে। মিতালী পরিবহনের একটি বাসে করে সোজা রাজধানীতে। আমার পছন্দ মতো টেলিভিশন নিয়ে পরদিন ফিরে আসি বাসায়। আমাদের বাসায় টেলিভিশন এসেছে শুনে পাড়ার মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। প্রতি শুক্রবার বিকেলে বাংলা ছায়াছবি দেখাতো বাংলাদেশ টেলিভিশন। শুক্রবার দুপুর থেকেই বাসায় ভিড় যেন নিয়মিত হয়ে ওঠে। ফলে কক্ষে স্থান সঙ্কুলান হয় না। এক মাস পরই বাবা মিস্ত্রী এনে দুই কক্ষের মাঝের পার্টিশনের দেয়াল ভেঙে দিলেন। বিশাল কক্ষে বসে পাড়ার পুরুষ-মহিলাসহ প্রায় দেড় থেকে দুই শতাধিক মানুষ সিনেমা হলের মতো বাংলা ছবি দেখতেন। আমার মা ছবি দেখতে আসা এলাকাবাসীর চা’র ব্যবস্থা করতেন।
কিশোর বয়সের আরো একটি ঘটনা এখনো আমার মানসপটে। তখন ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। সে সময়ে সিনেমা হলে একটি ছবি মাসাধিককাল চলতো। স্থানীয় ভিক্টোরিয়া সিনেমা হলে ‘রাই বিনদিনী’ নামের ছবি আসে। সে ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন সুব্রত। ছবিটি আসার পর প্রতিদিন স্কুল ফাঁকি দিয়ে মর্নিং শো দেখতে যেতাম। স্কুল ছুটির পর যথারীতি ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। প্রতিদিন এক ছবি দেখা যেন নেশা হয়ে দাঁড়ালো। তবে আমার মর্নিং শো দেখাটা গোপন থাকলো না। কি করে যেন বাবা বিষয়টি জেনে গেলেন। একদিন স্কুল ছুটির পর বাসায় যখন ফিরলাম তখন বাবা জিজ্ঞেস করলেন শুনলাম তুমি নাকি সিনেমা দেখো? কথাটা শোনা মাত্র আমি তো প্রচণ্ড রাগে টগবগিয়ে উঠি। বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম আমার ব্যাপারে এমন মিথ্যে তথ্য কে দিলো? বাবা শান্ত গলায় বললেন, কে বলল তা জানার দরকার নেই। তবে যদি স্কুল ফাঁকি দিয়ে সিনেমা হলে গিয়ে থাকো আর যাবে না। পরদিন সকালে বন্ধু যোবায়ের আর আমি যথারীতি সকাল ১১টায় স্কুলের পোশাক পরে স্কুল ব্যাগ নিয়ে ভিক্টোরিয়া সিনেমা হলের সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠে ডান দিকে যেই মোড় নিয়েছি দেখি বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে কিছুই না বলে তিনি আমাকে বাসায় নিয়ে আসেন। বাসায় এসে বলেন, ‘তুমি আমাকে যা বললে তা ছিল মিথ্যে। আজ আমি নিজে প্রমাণ পেলাম। কেন এমন করলে?’ আমি কি এতে দমে যাবার পাত্র? বাবাকে বললাম আমি কোনোদিনও সিনেমা হলে যাইনি। সিনেমা হল কেমন তাও জানি না। তারপরও মিথ্যেভাবে আমার বিরুদ্ধে কে বা কারা তোমার কাছে বিচার দিয়েছে। আমি সিনেমা হলে না গিয়েই যেহেতু দোষী হয়েছি তাই আজ রাগ করে গিয়েছিলাম সিনেমা দেখতে। এ সময় বাবা বললেন, দেখো সিনেমা ভালো ছেলেরা দেখে না। তুমি তো মহালক্ষ্মী একটি ছেলে। তোমার মতো ভালো ছেলেদের এসব কাজ মানায় না। আশা করি আমার কথাগুলো মেনে চলবে। কথাগুলো শুনে আমি আমার কক্ষে চলে যাই। একটু পর নিজের ভুলের কথা বাবাকে বলতে যেই বাবার কক্ষের সামনে আসি তখন শুনি বাবা আমার মাকে বলছেন বুদ্ধি দেখেছো ছেলের? কীভাবে আমাকে ম্যানেজ করে গেল! একথা শুনে মা বললেন, ‘তুমি আস্কারা দিয়ে ছেলেটাকে নষ্ট করে ফেলছো।’ তখন বাবা বললেন এ বয়সে আমিও কি কম দুরন্ত ছিলাম?
আমার বাবা (মরহুম মো. কালা মিয়া, সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান, শ্রীমঙ্গল পৌরসভা) ছিলেন একজন প্রকৃত সমাজসেবক। স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন তিনি। বাবা ছিলেন একজন স্বপ্নচারী মানুষ। নিজে সমাজ সংস্কারের স্বপ্ন মনে প্রাণে লালন করতেন আর আমাদের মাঝে তা বিলিয়ে দিতেন। ছেলেরা প্রকৃতিগত ভাবেই মায়ের পক্ষে থাকে। মেয়েরা থাকে বাবার পক্ষে। কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকেই ছিলাম বাবা ভক্ত। আমরা ছয় ভাই-বোনদের কারো গায়ে বাবা কোনোদিন ভুলেও একটি টোকা দেননি। তবে দুষ্টামি করে মায়ের হাতে পিটুনি খেয়েছি সবাই। আমি পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে বাবার আদর-স্নেহ পেয়েছি সব সময়ই। বাবা চায়ের ব্যবসা করতেন। আমি মাঝে মধ্যে দোকানে গেলে দেখতাম বাবার পাঞ্জাবির পুরোটা ভেজা। আশেপাশে সাধারণ মানুষ। বাবা তাদের সকলের সমস্যার সমাধানে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতেন। একপর্যায়ে দোকানে মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে। বাবা দোকানে বসলেই গল্প আর আড্ডা জমাতো সাধারণ মানুষ। একদিন দোকানের ম্যানেজার মায়ের কাছে এসে বলে চাচাকে দোকানে পাঠাবেন না। দোকানে তিনি যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণ ব্যবসা শেষ। এ অবস্থা চলতে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে সবাইকে।
বাবা যখন বয়সের হিসেবে প্রায় জীবনের শেষ প্রান্তে এসে উপনীত হয়েছেন তখন তার শশ্রু দাড়ি মুখজুড়ে। সময় কাটতো ইবাদত-বন্দেগিতে। আমি বাইরে গেলে চেয়ে থাকতেন পথপানে। কোনোদিন বাইরের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে বেশি রাত হলে দেখতাম বাবা আমার অপেক্ষায় জেগে আছেন। আমি দরজায় এসে কলিং বেল বাজানোর সাথে সাথেই বলতেন, ‘কে ইসমাইল?’ আমি সাড়া দিলে বলতেন, ‘যাক এবার শান্তিতে ঘুমাতে পারবো।’
বাবা কি আজও আমাকে দেখেন? আমার অপেক্ষায় আছেন কি আজও? ১৭ বছর আগে বাবাকে হারালেও আজও বাবার বিরহে মনটা কাঁদে হু-হু করে। বাবাকে মনে পরে সব সময়। মাকেও মনে পরে দিবানিশি। প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস আসে। কিন্তু বাবাকে বলা হয় না-‘বাবা, মিস করি তোমাকে; বাবা অফুরন্ত ভালোবাসি তোমাকে।’
লেখক: কলামিস্ট
ঢাকা/মারুফ