অর্থনীতি

‘খাতুনগঞ্জ’ যে কারণে হারাচ্ছে জৌলুস

রেজাউল করিমচট্টগ্রাম, ৫ ফেব্রুয়ারি : খাতুনগঞ্জ। বাংলাদেশের ‘ওয়াল স্ট্রিট’। দেশের ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে ব্ড় বাজার খাতুনগঞ্জ। শুধুমাত্র মৌখিক বিশ্বাস আর সাংকেতিক ভাষায় এই খাতুনগঞ্জে প্রতিদিন হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়, লেনদেন হয়। দেশখ্যাত এই খাতুনগঞ্জ এখন ক্রমশ তার জৌলুস হারাতে বসেছে প্রতারণা আর বিশ্বাসভঙ্গের কারণে। বিশ্বাসভঙ্গের জন্য শত শত কোটি টাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য ব্যবসায়ী। খেলাপী ঋণের ফাঁদে পড়েছে অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক। খাতুনগঞ্জে একের পর এক ঘটতে থাকা বিভিন্ন প্রতারণামূলক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাংক এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। সম্প্রতি মোজাহের হোসেন নামের খাতুনগঞ্জের প্রতিষ্ঠিত ও বিশ্বস্ত এক ব্যবসায়ী বিপুল অঙ্কের ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ঋণ অপরিশোধিত রেখে গা-ঢাকা দেওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে ব্যাংকগুলো। প্রায় ৬শ’ কোটি টাকার বেশি হাতিয়েছেন এই ব্যবসায়ী। যা এ যাবত কালের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক প্রতারণা বলে খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।জানা গেছে, দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় পাঁচটি ব্যাংকের কাছে এই ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠানের নামে ৪৫০ কোটি টাকার মতো অনাদায়ি মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ রয়ে গেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া অনাদায়ি ব্যক্তিগত ঋণের পরিমাণও ১৫০ কোটি টাকার মতো। ব্যাংকগুলোর কাছে যৎসামান্য বন্ধকি জমি জামানত হিসেবে থাকলেও অন্যান্য ব্যবসায়ীর কাছ থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে চেক ছাড়া কিছুই নেই।খাতুনগঞ্জে শাখা আছে এমন কয়েকটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা রাইজিংবিডিকে জানান, বিশ্বাসের কারণে বিভিন্ন ব্যাংকের খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক শাখাগুলো প্রায় বিনা জামানতে সেখানকার ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে দ্বিধা করে না। এক দশক আগেও ঢাকার তুলনায় প্রায় সবগুলো ব্যাংকের চট্টগ্রামভিত্তিক খেলাপি ঋণ ছিল কম এবং এমনকি কোনো কোনো ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় খেলাপি বা শ্রেণীবিন্যাসিত ঋণের পরিমাণ থাকত শূন্য। কোনো ঋণগ্রহীতা অনিবার্য কারণে খেলাপি হয়ে পড়লেও অতি দ্রুত তা নিষ্পত্তি করে ফেলার একটা দায়বদ্ধতা ছিল।খাতুন গঞ্জের একটি বাণিজ্যিব ব্যাংকের কর্মকর্তা ইফতিখার হাসান জানান, খাতুনগঞ্জের সেই স্বর্ণযুগ এখন আর অবশিষ্ট নেই। খাতুনগঞ্জের ফিকে হয়ে আশা জৌলুস, পরিকল্পনাহীন নাগরিক ও ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং ক্রমবর্ধমান অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে এখানকার অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এ এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আধুনিক সুসজ্জিত ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছেন। এককালের সওদাগরি সংস্কৃতির পরিবর্তে গড়ে উঠেছে করপোরেট সংস্কৃতি। ঋণখেলাপি হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ীকে একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে নামতে হচ্ছে আইনি লড়াইয়ে।খাতুনগঞ্জের প্রবীণ ব্যবসায়ী হাজী আবু হায়দার জানান, বর্তমান চট্টগ্রাম কোতয়ালী থানা এলাকায় প্রায় ১৩৮ বছর আগে শেখ মোহাম্মদ হামিদুল্লা খানের পত্নী খাতুন বিবির দান করা জায়গার ওপর খাতুনগঞ্জের বাণিজ্যিক কেন্দ্র বা সওদাগরি ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়েছিল। সেই খাতুনগঞ্জ পরবর্তী সময়ে পরিণত হয়েছিল সমগ্র বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের প্রায় ৮০ শতাংশের মূল সরবরাহের মুল বাণিজ্যিক কেন্দ্র। প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দুই হাজারেরও বেশি দোকান, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অফিস এবং বিভিন্ন পণ্যের আড়ত ও গুদাম নিয়ে প্রতিদিন জমজমাট আমদানিনির্ভর ব্যাবসায়িক কার্যক্রমের প্রাণকেন্দ্র খাতুনগঞ্জ। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কর্ণফুলী নদী হয়ে চাক্তাই খাল দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুবিধার কারণে একচেটিয়া উৎকর্ষ লাভ করে খাতুনগঞ্জ। খাতুনগঞ্জের ব্যবসা প্রসারিত হয় কোরবানীগঞ্জ ও চাক্তাই পর্যন্ত।খাতুনগঞ্জ ট্রেড এন্ড ইন্ডাষ্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি মাহবুব আলম রাইজিংবিডিকে জানান, অতি প্রাচীন খাতুনগঞ্জ বাণিজ্যকেন্দ্রটির মূল কার্যক্রম হলো আমদানি এবং ইনডেন্টিং (বিদেশি রপ্তানিকারকের দেশীয় প্রতিনিধিত্ব) ব্যবসানির্ভর। অথচ খাতুনগঞ্জ তথা চট্টগ্রামকেন্দ্রিক যে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতো, তার উদ্যোক্তারা যে খুব উচ্চশিক্ষিত ছিলেন তা নয়। প্রখর ব্যবসায়িক জ্ঞান ও দূরদর্শিতার পাশাপাশি মৌখিক অঙ্গীকার রক্ষা এবং ব্যবসায়িক সততার কারণে তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন বিশ্বস্ততার একটি নিরবচ্ছিন্ন ধারা। সাদামাটা বহিরাঙ্গের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের একটা অতি সাধারণ গদিঘর বা অফিস নিয়ে খুব সাদাসিধা জীবন যাপন করলেও অতীত প্রজন্মের এঁদের অনেকেই হয়তো নিয়ন্ত্রণ করতেন সারা বাংলাদেশের নির্দিষ্ট কোনো পণ্যের আমদানি, মজুত ও সরবরাহ। এদের প্রায় সবাই আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং প্রভূত ব্যবসায়িক সুনামের অধিকারী, ফলে তাঁদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন ঘটত মূলত মৌখিক অঙ্গীকারের ভিত্তিতে।খাতুনগঞ্জের কাঁচামাল আমদানিকারক জামিল আহমেদ চৌধুরী জানান, খাতুনগঞ্জভিত্তিক ব্যবসায়িরা পণ্য আমদানি করলেও তারা বিপণনের সঙ্গে জড়িত থাকেন না। পণ্য বন্দরে পৌঁছার পর কখনো ব্রোকাররা, কখনো বা পাইকারি ব্যবসায়িরা পণ্যের চাহিদা বুঝে আগাম দিয়ে কিংবা আংশিক বাকিতে ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) কিনে নেন। যদিও সেই পণ্য হয়তো তখনো বন্দরের শেডে কিংবা অমুক মাঝির গুদামে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের গুদামগুলোর পরিচিতি হয় কুলিসর্দার বা মাঝিদের নামে। পরবর্তী সময়ে প্রকৃত পণ্যের কোনো স্থানান্তর ছাড়াই এই ডিও হাতবদলের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়িরা পণ্যবিশেষে লাখ থেকে কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করতে পারেন।খাতুনগঞ্জের লাখ লাখ বা কোটি কোটি টাকার ডিও কেনাবেচা কেবল মুখের কথা বা টেলিফোন কিংবা নিদেনপক্ষে একটা ছোট স্লিপের মাধ্যমে সম্পদিত হয়। এভাবে কয়েকবার হাতবদলের কারণে পণ্যের দামও বেড়ে যায় কয়েক দফা। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় এই ডিও ব্যবসা একসময় লাগাম ছাড়া হয়ে ওঠে, সেই সঙ্গে যুক্ত হয় ডিও জালিয়াতির মতো তৎপরতা। ভুয়া ডিও তৈরি করে অন্যায়ভাবে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে যেমন উধাও অনেক ব্যবসায়ী, তেমনি ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে অপর পক্ষ।খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়িরা জানান, এখানে গত ২০১৩ সালেই ব্যবসায়িক প্রতারণায় কমপক্ষে এক হাজার কোটি টাকা লুট করে বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে ১৫ থেকে ২০ জন ব্যবসায়ী। এতে শত শত ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৌখিক বিশ্বাসের কারণে এই বাজারে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হওয়ায় কেউ বিশ্বাসভঙ্গ করে প্রতারণা করলেও তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা নেয়ারও সুযোগ থাকে না। কোন ব্যবসায়ির কাছে সই করা চেক থাকলে সেই ব্যবসায়ী শুধু চেক প্রতারণার মামলা করেন। কিন্তু শত কোটি টাকা লোপাট করে উধাও হয়ে যাওয়ার প্রতারক ব্যবসায়ীর আর সন্ধান পাওয়া যায় না। চলমান অব্যাহত প্রতারণা আর বিশ্বাসভঙ্গের কারণে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাতুনগঞ্জে এখন আর আগের জৌলুস নেই। তবু সারাদেশের আমদানী বাণিজ্য এখনো নিয়ন্ত্রিত হয় খাতুনগঞ্জ থেকেই।

 

রাইজিংবিডি / টিপু