ক্যাম্পাস

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সাহসী এক নাম সাইমন ড্রিং

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন নানা দেশের অজস্র সহমর্মী মানুষ। তাদের কেউ কেউ ভূমিকা রেখেছিলেন রাইফেল কাঁধে যুদ্ধের মাঠে, শরণার্থী শিবিরে, কেউবা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ ও জনমত গঠন করে। কঠিন সেই সময়ে তাঁরা যে ভূমিকা রেখেছেন নিঃসন্দেহে তা অবিস্মরণীয়। তেমনি একজন ‘সাহসী যোদ্ধা’র সম্পর্কে আজ জানবো।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানেন অথচ সাইমন ড্রিংয়ের নাম জানেন না এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সাইমন ড্রিং নামটি সুপরিচিত।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর রিপোর্টার সাইমন ড্রিং কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে কাজ করছেন। লন্ডনের সদর দপ্তর থেকে তাঁকে বলা হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত। সেখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে, তুমি ঢাকা যাও।’ সাইমন মার্চের ৬ তারিখে কম্বোডিয়া থেকে ঢাকায় এলেন। পরদিন ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জনসভায় লাখ লাখ মানুষের সমুদ্রে শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি প্রত্যক্ষ করলেন। বাংলাভাষী না হওয়ায় একটি বাংলা শব্দও তাঁর বোধগম্য হলো না, কিন্তু লাখ লাখ জনতার প্রতিক্রিয়া আর তাদের চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে এটা বুঝতে বাকি রইল না যে তিনি উপস্থিত হয়েছেন বিরাট এক রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে।

সপ্তাহখানেকের জন্য ঢাকায় এলেও আর ফেরা হলো না তাঁর। শুরু হলো তার পাকিস্তানের রাজনীতি ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলন ও সংগ্রাম সম্পর্কে স্বচক্ষে অভিজ্ঞতা অর্জন। পরিচিত হলেন শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সঙ্গে। দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক ঘটনাবলি নিয়ে তিনি নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠাতে লাগলেন লন্ডনে।

এদিকে পাকিস্তানি পিশাচরা আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও গোলাবারুদ এনে গণহত্যার সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। গণহত্যার নীলনকশা তৈরি করেছিলেন জেনারেল টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলী। ২৫ মার্চ রাতকে গণহত্যার জন্য বেছে নেওয়া হয়। এই হত্যান্ডের কথা যেন বহির্বিশ্ব জানতে না পারে সেজন্য আগেই সব বিদেশি সাংবাদিকদের গতিবিধির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় ও অনেককে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়। গণহত্যা পরিকল্পনার তত্ত্বাবধায়ক জেনারেল টিক্কা খানের ‘এদেশের মানুষ চাই না, মাটি চাই’- পোড়ামাটির নীতি নিয়ে গণহত্যায় নেমে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। চালায় ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যা।

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে উঠেছিলেন সাইমন ড্রিং। কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সাইমন ড্রিংকে খুঁজে পায়নি। তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলেই লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। তারপর এসব প্রত্যক্ষ করে লেখেন ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন।

ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৩০ মার্চ সেটা ছাপা হয়। এই প্রতিবেদন থেকেই বিশ্ববাসী জানতে পারে পাকিস্তানি বাহিনীর সেদিনের বর্বরতার কথা। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যার কথা বিহির্বিশ্ব জানতে পারায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গঠিত হতে শুরু হয়েছিল।

মার্চের ৩০ তারিখ সাইমনকে লন্ডন যেতে হয়। তারপর নভেম্বর মাসে আসেন কলকাতায়। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সংগ্রহ করে পাঠাতেন লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সঙ্গে প্রবেশ করেন মুক্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়।

সাইমন ড্রিং স্বাধীন বাংলাদেশে আবার এসেছিলেন ২০০০ সালে। কাজ করেছেন এ দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে।

বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে অর্জন করেন ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার; ইরিত্রিয়া যুদ্ধের ওপর ভ্যালিয়ান্ট ফর ট্রুথ; কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুরস্কের যুদ্ধের প্রতিবেদনের জন্য সনি ও হাইতিতে আমেরিকান আগ্রাসনের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করে অর্জন করেন নিউইয়র্ক ফেস্টিভ্যাল গ্রান্ড প্রাইজ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহসী সৈনিক সাইমন ড্রিংয়ের জন্ম ইংল্যান্ডে, ১৯৪৫ সালে। তিনি সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন ১৮ বছর বয়স থেকে। প্রত্যক্ষ করেছেন ২২টি যুদ্ধ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লব। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা ছিল আমাদের প্রকৃত সহযোদ্ধার সমতূল্য।

লেখক: শিক্ষার্থী, বদরগঞ্জ সরকারি কলেজ।

রংপুর/মাহি