সারা বাংলা

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ৪ শহীদের কবরের পাশেই দাঁড়িয়ে ‘আমরাও প্রস্তুত’

চারপাশে ফসলের মাঠ। মাঝখানে পাকা প্রাচীর ঘেরা ছোট্ট সবুজ মাঠ। এর দক্ষিণ পশ্চিম কোণায় মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম নির্যাতনে নিহত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর চার শহীদের কবর। আর পাশেই বীরদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী পুরুষের আদলে নির্মাণ করা ভাস্কর্য ‘আমরাও প্রস্তুত’। এটি দেশের একমাত্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বরণে নির্মিত।

মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী শত্রু বাহিনীর মোকাবিলা করতে তীর ধনুক নিয়ে নিজেদের প্রস্তুতির জানান দিচ্ছেন একজন আদিবাসী পুরুষ। আর যুদ্ধের সেই প্রস্তুতির অনুপ্রেরণা জোগাতে পাশেই কাঁধে সন্তান,এক হাতে খুন্তি ও অন্য হাতে তুন (তীর রাখার পাত্র) এগিয়ে দিয়ে সহযোগী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন আদিবাসী নারী। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার কৃষক-জনতা, কামার কুমার, তাঁতি-জেলের সঙ্গে অংশ নিয়েছিলেন এ দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী পুরুষরা। ‘আমরাও প্রস্তুত’ ভাস্কর্যটি যেন সেই সাক্ষ্যই বহন করছে।

‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ৭ই মার্চের ভাষণের আহবানে সাড়া দিয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারী-পুরুষদের প্রস্তুতির সেই চিত্রই ফুটে তোলা হয়েছে ভাস্কর্যটিতে। সরকারি ১৪ শতক জায়গায় ২১ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ভাস্কর্যটি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার ধরঞ্জী ইউনিয়নের নন্দইল মিশন গ্রামের পাশে নির্জন মাঠে স্থাপন করা হয়েছে। এটি নির্মাণ করা হয় ২০১০ সালে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সভাপতি প্রফেসর আমিরুল মোমেনিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃৎশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগের তৎকালীন প্রভাষক বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক কনক কুমার পাঠক ও সহযোগী অধ্যাপক ড. একেএম আরিফুল ইসলাম। তাদের সহযোগিতা করেন ওই বিভাগের ৮-১০ জন শিক্ষার্থী। আর সেই থেকে ভাস্কর্যটি স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস‌্যদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রতীক হয়ে আছে।

ভাস্কর্যের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে নন্দইল গ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী চার শহীদের কবর আছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার অভিযোগে ১৯৭১ সালে যাদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। তারা হলেন— নন্দইল গ্রামের যোহন সরেন (৩৫) ও তার ভাই ফিলিপ সরেন (২৫) এবং খোকা হেমব্রম  (৩২) ও তার ভাই মন্টু হেমব্রম (২২)।

ওই সময় পরিবার ভারতে থাকলেও তারা দেশ ছেড়ে না গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখেন। শত্রুদের গতিবিধির তথ্য সরবরাহসহ তারা নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেন। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে তাদের গুপ্তচরবৃত্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের এক সকালে বাড়ির পাশের জলাশয়ে পাট ধোয়ার কাজ করার সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাত সদস্যের একটি দল পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ পাঁড়ুইল গ্রামে তাদের ধরে নিয়ে যায়। সেখানে আবুল হোসেন নামের একজনের বাড়িতে নিয়ে তাদের ওপর চরম নির্যাতন চালায়। পরে ঘরের মধ্যে গর্ত খুঁড়ে সেখানে ফেলে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে হত্যার পর তাদের মাটি চাপা দেয়। দেশ স্বাধীনের পর তাদের স্বজনরা ওই গর্ত থেকে হাড় ও অস্থি নিয়ে এসে নন্দইল গ্রামের পাশে তাদের কবর দেয়।

স্বাধীনতা যুদ্ধে চার শহীদের এই আত্মদানের জন্য কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে দেশের জন্য তাদের বীরত্ব গাঁথা ইতিহাস তুলে ধরতেই কবরের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে ‘আমরাও প্রস্তুত’ নামের ভাস্কর্যটি। 

ভাস্কর্য দেখতে আসা ধরঞ্জী গ্রামের বাবুল হোসেন জানান, এই ভাস্কর্য যে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের এতো বড় ত‌্যাগ নিয়ে নির্মিত তা এখানকার অনেকেই জানেন। বিশেষ করে এলাকার স্কুলপড়ুয়া শিশু-কিশোরদের এটি জানা উচিত। কিন্তু এটা নিয়ে তেমন কোনো প্রচার চোখে পরে না। এই তথ‌্য নতুন প্রজন্মের তরুণদের জানা উচিত।

ওই গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব‌্যক্তি অভিযোগ করে জানান, অনেক আগে এই ভাস্কর্যের সঙ্গে একটি নাম ফলক ছিলো। সেখানে শুধু ওই সকল বীরের নাম উল্লেখ করা হয়েছিলো। কিন্তু সংরক্ষণের  অভাবে বর্তমানে সেটিও নাই। এখানে তাদের নামফলকের সঙ্গে আত্নত‌্যাগের কাহিনীও উল্লেখ করা দরকার। এখানে আত্নত‌্যাগের কাহিনী উল্লেখ করে তাদের নাম ফলক থাকলে সবাই এ বিষয়ে সকলে জানতে পারবেন। তাই এ ব‌্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

ধরন্জী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা জানান, আদিবাসী এই ভাস্কর্য কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  ধরন্জী ইউনিয়নে ওই সময়কার  সকলেই জানে হানাদারদের নির্মম নির্যাতনের কথা। এই ভাস্কর্যের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।

ভাস্কর্যটির উদ্যোক্তা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক,গবেষক এবং জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি আমিনুল হক বাবুল জানান,মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের আত্মদানের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও তাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্মরণীয় রাখার লক্ষ্যেই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পল্লীর ওই নির্জন এলাকায় ভাস্কর্যটি নির্মাণ ও স্থাপন করা হয়েছে।

উল্লেখ‌্য, ভাস্কর্যটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ লাখ টাকারও বেশি। যার প্রধান অর্থ জোগানদাতা ছিলেন জেলা পরিষদের তৎকালীন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান। এ ছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্য,পৌর মেয়র,সংশ্লিষ্ট এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান,মুক্তিযোদ্ধাগণ এবং এলাকার প্রগতিশীল চেতনার ব্যবসায়ীমহলসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অর্থ ও শ্রম দিয়ে সহযোগিহতা করেছেন।