সাক্ষাৎকার

‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মুক্তিযুদ্ধের বড় একটি স্লোগান ছিল: শাওন মাহমুদ

বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটিতে তিনি সুর দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে আলতাফ মাহমুদের রয়েছে অমূল্য অবদান। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁকে ঢাকার আউটার সার্কুলার রোডের বাসা থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীকালে তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা মুখোমুখি হয়েছি তাঁর কন্যা শাওন মাহমুদের। কথোপকথনে ছিলেন— আমিনুল ইসলাম শান্ত।

রাইজিংবিডি: এই সময়ের বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই। শাওন মাহমুদ: বর্তমান প্রজন্মের উপর আমি অনেক নির্ভর করি। যাদের বয়স এখন ৩০ পেরিয়েছে তারা কীভাবে দেখছে- বিষয়টি আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জীবন-যাপন, স্বাধীনতার চেতনা, লালন ও বিকাশ করার একটা স্টেজ আমরা পেরিয়ে এসেছি। এজন্য আগামী প্রজন্ম কীভাবে বাংলাদেশ দেখছে তা জানতে বেশি আগ্রহী।  

রাইজিংবিডি: যে প্রজন্মের উপর আপনি ভরসা করছেন, সেই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস কতটা পৌঁছে দিতে পেরেছি বলে মনে করেন? শাওন মাহমুদ: অনেক দেরি হয়ে গেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চলল। মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভ করা দরকার ছিল। কিন্তু সেগুলো করা হয় নাই। তৃণমূলে অর্থাৎ স্কুল থেকে মুক্তিযুদ্ধের কর্নার করা বা ইতিহাস জানানোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। মুক্তিযুদ্ধ বিশাল একটি ব্যাপার। পাঠ্যবইয়ে একটি অধ্যায়ের মাধ্যমে এত বড় বিষয় তুলে আনা সম্ভব নয়। এগুলো ছাড়া পরিবারের বিষয়টিও রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার তৃতীয়বারের মতো রাষ্ট্র ক্ষমতায়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের অনেক কিছু করার আছে। মেট্রোরেলের উন্নয়নের চেয়ে আমাদের আর্কাইভ করা, জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখভাল করা, বীরাঙ্গনাদের দেখভাল করা— এমন অনেক কাজ রয়ে গেছে। কাজগুলো খুব সহজেই করা যেত। সেগুলো করতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের কথা সব মানুষের মুখে মুখে থাকত। এসব কাজ সম্পন্ন হলে সাংবাদিকরাই বারবার লিখতেন। এ ধরনের কাজ যত হতো, আরো বেশি আলোচনা হতো এবং তরুণরাও এ বিষয়ে কথা বলতো, তাদের মাথায় বিষয়টি গেঁথে যেত। যে শূন্যতা আগে সৃষ্টি হয়েছে তা এখন এতটাই জায়গা করে নিয়েছে যে, আপনি-আমি দুই কলম লিখে সমাধান করতে পারব না। এ ক্ষমতা যাদের হাতে তাদেরকে আরো বেশি সক্রিয় হতে হবে। শহীদ জননী যারা তারা কিন্তু প্রায় চলে যাওয়ার পথে। বলতে গেলে নাই-ই প্রায়। বেশির ভাগ মুক্তিযোদ্ধার বয়স হয়েছে। এসব বিষয় দেখলে মনে হয় এদের জন্য কিছু করা দরকার ছিল।

রাইজিংবিডি: বিজয়ের মাসে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হলো... শাওন মাহমুদ: আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে কাজগুলো করার কথা ছিল তা নিয়ে প্রথমেই বলেছি। চেতনা মানুষের হৃদয়ে থাকে। যে কাজ করার ছিল, বারবার বলার ছিল, তা না করে মুক্তিযুদ্ধকে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে যে, এখনকার ছেলেমেয়েরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে চায় না। বিষয়টি ওইখান থেকে এতদূর এসেছে! ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মুক্তিযুদ্ধের বড় একটি স্লোগান ছিল। আমাদের মাটি ছিল, দেশ ছিল, সরকার ছিল, ভাষাটাও নিয়ে এসেছিলাম। এরপর আমরা শ্রেণি-বিভেদ ভুলে পূর্ব বাংলার মানুষ একসঙ্গে থাকতে চেয়েছি। কিন্তু সেই জায়গাটা ধরে না রাখার দায় কাউকেই দিতে পারব না। কারণ এ দায় আমাদের সবার। সময়ের সঙ্গে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, সেখান থেকে এসব ঘটছে এবং যদি শক্তিশালী না হওয়া যায় তবে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আরো ঘটবে। শত্রুকে যদি আপনি রাস্তা না করে দেন তবে শত্রু আপনার ঘরে কেমন করে আসবে? ওরা প্ল্যাটফর্ম পায় কী করে? আমরা দিচ্ছি বলে ওরা পাচ্ছে। আমরা ওদের কথা কেন শুনব? ওদের কেন টক-শোতে ডাকব? ওদের কথা শোনার কিছু নেই!

রাইজিংবিডি: বাবার অনুপস্থিতি কখন সবচেয়ে বেশি আপনাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়? শাওন মাহমুদ: আমি স্কুলে পড়াকালীন সবার মা-বাবা স্কুলে আসতেন। কখনো সন্তানকে তার বাবা স্কুলে নামিয়ে যেতেন আবার কখনো স্কুল থেকে নিয়ে যেতেন। কিংবা ঈদের সময় বাবার সঙ্গে জামা-জুতা কিনতে যেত, এ সময় আমি বাবাকে খুঁজতাম। সেই সময়ের কথা এখনো মনে পড়লে ভাবি, কীভাবে নিজেকে বোঝাতাম! সেইসব স্মৃতি এখন অতটা স্পষ্ট মনে নেই। কিন্তু এই যে শূন্যতা— ওর বাবা আছে আমার কেন নেই? এই জায়গাটা বিশাল একটি ব্যাপার। আমাদের দেশে মেয়েদের বাবা কিংবা ভাই থাকা খুব দরকার। বাবা না থাকলে একটি মেয়ের আইডেন্টি ক্রাইসিস তৈরি হয়। এ সব ভাবলে পৃথিবীটাকে খুব নিষ্ঠুর মনে হতো। আমরা বসে থাকি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ভেবে। কিন্তু সবকিছু ঠিক হয় না। মানুষের মনের ক্ষত কখনো শুকায় না। পেশাগত কাজ, সংসার-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে মানুষ অনেক কিছু ভুলে থাকে। কিন্তু যখন ওই মানুষটি অবসরে যাবে, একা হবে, তখন সুখস্মৃতির চেয়ে ক্ষতগুলো বেশি মনে পড়বে।

রাইজিংবিডি: জীবনের এ পর্যায়ে এসে বাবার প্রতি কোনো অভিমান বা আক্ষেপ কাজ করে কী? শাওন মাহমুদ: ছেলেবেলায় প্রায়ই মনে হতো, বাবা আমাকে অথবা মাকে কেন প্রাধান্য দেয়নি। কিন্তু এই বয়সে এসে মনে হয়—বাবার জায়গায় আমি হলেও বাবা যা করেছেন তাই করতাম। একবারও অন্য কিছু ভাবতাম না। কারণ আমাদের রক্তে প্রতিবাদের বিষয়টি মিশে আছে। এখন মনে হয় না এটা অভিমান। শূন্যতা, ক্ষত থেকে মাঝেমধ্যে হয়তো এমনটা বলেছি!

রাইজিংবিডি: মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার এখন ক্ষমতায়। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে তাদের কাছে আপনার বিশেষ কোনো দাবি আছে কী? শাওন মাহমুদ: মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারের কাছে আমার কেন দাবি থাকবে? ওনারা তো মুক্তিযুদ্ধ নিয়েই কাজ করবেন। বিপক্ষের সরকার থাকলে দাবি করতাম, প্রতিবাদ করতাম।