সাতসতেরো

‘আমার বাবা যুদ্ধবন্দি ছিলেন’: সূচনা পর্ব

গল্পটি আমি অনেকদিন ধরে বলতে চেয়েছি। জীবনভর গল্পটি বয়ে বেড়িয়েছি। কিন্তু এটা লেখার মতো সময় কিংবা কথা, হতে পারে সাহস হয়ে ওঠেনি। পারিবারিক গোপনীয়তা ও গ্লানি আসলে প্রকাশ করা উচিত নয়। তাহলে আপনার প্রতিবেশীই আপনাকে নিয়ে উপহাস করবে। তবুও আজ সেসব একপাশে রেখে লিখতে বসলাম।

এখন মনে হচ্ছে আমি যেভাবে লিখছি, সেভাবে কখনো ভাবিনি। যা’হোক আমার বাবার স্মৃতি কিছুটা আপনাদের কাছে শেয়ার করার জন্য লেখাটা শুরু করলাম। মেজর নঈম আহমেদ, আমার পিতা, যিনি আমরা জীবনের গতিপথ তৈরি করে দিতে দারুণভাবে প্রভাব ফেলেছিলেন। নঈম ১৯৪৬ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরের বিখ্যাত ওয়ালেদ শহরে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেন। তিনি ছিলেন তিন ভাইবোনের মধ্যে মেজ এবং একমাত্র ছেলে। স্কুল ও কলেজে তিনি খেলোয়াড় হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। গতির প্রতি ছিল তার অন্যরকম মোহ।

লাহোরের অভিজাত সরকারি ইউনিভার্সিটি কলেজে তিনি সাঁতার ও নৌকাবাইচ দলের সদস্য ছিলেন। তাঁর খেলাধুলার সামর্থ্য ছিল মুগ্ধ করার মতো। ৩০ বছর পর কেবল তাঁর খেলাধুলার সুনামের কারণে আমার বড় ভাইকে সেই অভিজাত কলেজে ভর্তি করাতে পেরেছিলেন। আমার ভাইকে স্বাগত জানিয়ে কলেজের অধ্যক্ষ বাবাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের এখানে বহু ছাত্র এসেছে। কিন্তু কমই তাদের স্মৃতি রেখে যেতে পড়েছে এ প্রাচীন প্রাঙ্গণে। আপনার ছবি এখনো আমাদের কলেজের মূল দেয়ালে ঝুলছে।’

১৯৬৮ সালে গ্র্যাজুয়েশনের পর আমার বাবা পাকিস্তান আর্মিতে কমিশন লাভ করেন। তিনি সেনাবাহিনীর নন-কমব্যাট অংশে যোগ দেন। অর্থাৎ তারা সরাসরি যুদ্ধে যেতেন না। তাঁর কাজ ছিল যুদ্ধের গোলা বারুদের সরবরাহ নিশ্চিত করা। পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে বের হওয়ার পর তিনি করাচিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় ল্যাফটেনেন্ট খলিলুর রহমানের সঙ্গে। খলিল সাহেব বলেছিলেন, ‘নিয়তি আমাদের কাছে নিয়ে এসেছিল’।   পূর্ব পাকিস্তানে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, আমার বাবা সেখানে অর্ডিন্যান্স ডিপোতে পদায়িত হন। সেই সংঘর্ষটি খুব নিষ্ঠুর রূপ ধারণ করেছিল। ‘আমরা বাঙালিদের, বাঙালিরা আমাদের হত্যা করেছিল’, এভাবেই খলিল সাহেব সেই সময়ের পরিস্থিতির বর্ণনা করেছিলেন। খলিল সাহেব এখন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার। তিনি আমাকে সেই সময়ের ভয়াবহতার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন তা সহজে বলা সম্ভব নয়।

আমার বাবা যেহেতু নন-কমব্যাট সৈনিক ছিলেন, তাই তিনি খলিল সাহেবের মতো এতো নিষ্ঠুরতা দেখেননি। তিনি গোলবারুদ পরিবহনের দায়িত্বে ছিলেন। সেগুলো পরিবহনের জন্য তিনি নিজে ট্রেন চালিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি খুব গর্বসহকারে তার সন্তানদের বলতেন- একমাত্র হেলিকপ্টার ছাড়া তাকে সবই চালাতে হয়েছিল তখন।

১৯৭১-এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে ভারত যুদ্ধে অংশ নেয়। ফলে যুদ্ধটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে রূপ নেয়। সেই যুদ্ধ ১৩ দিন পর্যন্ত চলেছিল। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু আমার বাবার জন্য তখনই মাত্র যুদ্ধ শুরু হয়। তখন তার বেস অফিস ছিল ঢাকা থেকে ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল একটি গোলাবারুদের কনভয় ঢাকা নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু তার কমান্ডিং অফিসারের সেখানকার পথঘাট সম্পর্কে ভালো ধারণা ছিল না। ফলে বাবার কনভয়কে তিনি একটি ভুল পথে পাঠান। একসময় বাবা বুঝতে পারলেন তিনি দক্ষিণে যাওয়ার পরিবর্তে উত্তরে যাচ্ছেন। তার কনভয় ইতোমধ্যে একটা গহীন অরণ্যে ঢুকে পড়েছে। সেখানেই তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিজাত ইউনিট প্যারাট্রুপারদের এম্ব্যুশের শিকার হন। মেজর রাজ পাল সেই প্যারাট্রুপার দলের অধিনায়ক ছিলেন।

দুই দলের মধ্যে প্রচণ্ড বন্দুক যুদ্ধ শুরু হয়। আমার বাবা দেড়শ’ জন নন-কমব্যাট সৈনিকের দলের নেতৃত্বে ছিলেন। তিন ঘণ্টা সেই যুদ্ধ চলেছিল। এতে ৬৪ জন পাকিস্তানি ও ২৬ জন ভারতীয় সৈনিক নিহত হয়। বাবার সাহসিকতা দেখে ভারতীয় সৈনিকদের আদেশ দেওয়া হয়েছিল তাকে জীবিত ধরে আনার। পরবর্তী সময়ে মেজর পাল বলেছিলেন, ‘আমরা খবর পেয়েছিলাম এরা অর্ডেন্যান্স ট্রুপ। কিন্তু এরা যুদ্ধ করেছিল সুপ্রশিক্ষিত পদাতিক যোদ্ধাদের মতো।’

কিন্তু আমার বাবা যুদ্ধে ভয়াবহভাবে আহত হন। একটা মর্টার সেল এসে পড়ে তার বাঁ কাঁধে। তার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল ও তর্জনী উড়ে যায়। মর্টারের টুকরো তার বাঁ গালে ঢুকে পড়ে। একটা বুলেট তার বাঁ পায়ের পাতায় বিদ্ধ হয়। গোলার আঘাতে তার বা চোখের দৃষ্টি চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি হয় তার মস্তিষ্কে। সেটা আমরা অনেকদিন পর বুঝতে পেরেছিলাম। যখন তার মাথা সিটি স্ক্যান করা হয়। দেখা যায় মাথার ভেতরে অসংখ্য মর্টার সেলের টুকরো। আহত হওয়ার পর তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। ভারতীয় সৈন্যরা তাকে ঢাকায় মিলিটারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে তার রক্তাক্ত সামরিক পোশাক কেটে ফেলা হয়েছিল বিধ্বস্ত শরীর থেকে। হাসপাতালে তখন আহতের ভিড়। তাকে আহত অবস্থায় প্রায় ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল অস্ত্রোপচারের জন্য।

তিনি তখন কথা বলা তো দূর, চোখ খুলতে পারছিলেন না। তার মুখ ফুলে উঠেছিল। তাই তার পরিচয় কেউ শনাক্ত করতে পরেনি। ১৫ দিন পর্যন্ত কেউ তার কোনো খবর পায়নি। ফলে তাকে নিখোঁজের তালিকায় ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল। তাকে মৃত ভেবে তার সহকর্মীরা আমার দাদা-দাদীর কাছে এসে শোক প্রকাশও করে গিয়েছিল। কিন্তু তারা তাদের সন্তানকে জীবিত ফিরে পাওয়ার আশা ছাড়েননি। পূ্র্ব পাকিস্তানে থাকাকালে আমার বাবা ও খলিল সাহেবের কর্মস্থলের দূরত্ব ২০ কিলোমিটারের মতো ছিল। কিন্তু তারা নিয়মিত দেখা করতেন। একজন আরেকজনের কাপড় পরতেন। কিন্তু গণ্ডগোল শুরু হয়ে যাওয়ার পর দুজনের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।খলিল সাহেব একটা কঠিন সময় পার করছিলেন। একটানা সাতদিন পরিখায় থাকার পর তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। পরে তাঁকে আর্মি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সৌভাগ্যবশত মিলিটারি হাসপাতালে খলিল সাহেব ছিলেন। তিনিই বাবার ফুলে যাওয়া মুখ দেখে চিনে ফেলেন। ‘এটা আমার জন্য সত্যি সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল আমি সেখানে ছিলাম’, খলিল সাহেব বললেন। ‘নাহলে পাকিস্তানে না ফেরা পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার দেখা হতো না।’

আমার বাবা ৮ মাস হাসপাতালে ছিলেন। যখন তাকে ছেড়ে দেওয়ার মতো সুস্থ মনে করা হলো, তখন তাকে ভারতের বিহারের যুদ্ধবন্দিদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আরো অনেক যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে তাকে ট্রেনে বিহার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জনতার আক্রোশ থেকে রক্ষার জন্য ট্রেনের জানালাগুলো কাঠের তক্তা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। রেল লাইনের দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষুব্ধ মানুষের গালাগালি ঠিকই ট্রেনের ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছিল। লোকজন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছিল।

আমার বাবা যখন রাঁচির ক্যাম্প ৯৫-এ পৌঁছান তখন তার সাথে কিছুই নেই। পরনে কেবল হাসপাতালের পোশাক। তার সঙ্গের যুদ্ধবন্দিরা তাকে কিছু কাপড় দিয়েছিল। সেই কাপড় দিয়ে তিনি নিজেই ট্রাউজার সেলাই করেছিলেন। ক্যাম্পটি ছিল অফিসারদের জন্য। তাই প্রতি ৪ জন অফিসারের জন্য ১ জন করে আর্দালি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমার বাবা যেহেতু অসুস্থ ছিলেন, তার সেবার জন্য আলাদা একজন আর্দালি দেওয়া হয়েছিল আর্মি মেডিকেল কোর থেকে। একমাস নিবিড় সেবায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। আমার বাবা খুবই ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। যখন তিনি শরীরের শক্তি ফিরে পেলেন, তিনি অন্য বন্দিদের কোরআন শিক্ষা দিতে লাগলেন। ১৯৭৪ এর ফেব্রুয়ারিতে ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দির সঙ্গে বাবা পাকিস্তান ফেরেন। কিন্তু দেশের মানুষ তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়নি। মানুষের ভেতরে তাদের প্রতি ঘৃণা ছিল স্পষ্ট। সৈন্যদের আত্মসমর্পণ এবং তাদের বিরুদ্ধে হত্যা ও ধর্ষণের অভিযোগে পাকিস্তানের জনগণ খুবই লজ্জিত ছিল। মানুষজন যুদ্ধফেরত সৈনিকদের কাছ থেকে এসব নিষ্ঠুরতায় তাদের সম্পৃক্ততার কথা জানতে চাইত। কিন্তু আমার বাবার এসবের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। যে লড়াইয়ে তিনি আহত হয়ে বন্দি হয়েছিলেন, এর আগে তাঁকে পূর্ব পাকিস্তানে কোনো অস্ত্র ব্যবহার করতে হয়নি।

জনগণ না হয় তাদের ভালোভাবে নেয়নি, কিন্তু সেনাবাহিনী তো তার ফেরত আসা সৈনিকদের কাছে টেনে নেবে। কিন্তু তাও হলো না। খলিল সাহেব বলছেন, ‌‘সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের একই দিনে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আমরা বন্দি সৈনিকরা হয়ে পড়লাম নেতৃত্বহীন। আমরা যাদের আদেশে যুদ্ধ করেছিলাম, তারা জানলই না যুদ্ধবন্দিরা দুই থেকে তিন বছর আরেক দেশের বন্দিখানায় কিভাবে দিন কাটালো! আমরা সবাই ‘ব্ল্যাক’ ঘোষিত হলাম। এর অর্থ আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। আমরা আর দেশকে সেবা করার উপযোগী নই। অবশ্য এটি একটি বিশ্বব্যাপী প্রক্রিয়া, যুদ্ধবন্দি ফিরে এলে শত্রু দেশের প্রতি সম্ভাব্য আনুগত্য জানতে এবং সন্দেহ দূর করার জন্য তাদের জিজ্ঞেসাবাদ করা হয়। এই জিজ্ঞাসাবাদের পর সৈনিকদের অবস্থান ‘সাদা’ বা ‘ধূসর’ নির্ধারিত হয়।’

কিন্তু পেশাগত বিড়ম্বনা এর চেয়েও জটিল। ‘আমরা সরকার ও সেনাবাহিনী থেকে কোনো প্রকার সহযোগিতা পেলাম না’। খলিল সাহেব বলেন, ‌‘আমাদের কিছু অর্থ সাহায্য করা দরকার ছিল যাতে আমরা আমাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারি। তারা জানত আমরা ভারতের মাটি থেকে ফিরছি। তারা তো আবাসন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে রাখতে পারত। অথচ সেনাবাহিনীর এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা ছিল না।’

সৈনিকরা ফিরে এসে দেখল যারা একসময় তাদের সঙ্গে চাকরি করেছে, যুদ্ধের পুরোটা সময়ে নিরাপদে পশ্চিমে ছিল, তারা চাকরিতে অনেক এগিয়ে গেছে। নতুন দক্ষতা, আত্মবিশ্বাসে উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তারা বুঝতে পারল সেনাবাহিনীতে তাদের অবস্থান গুটিয়ে এসেছে। (আগামী পর্বে সমাপ্য)

মূল: সুননিয়া আহমেদ পীরজাদা সূত্র: আল জাজিরা অনলাইন, ১৬ মে ২০১৫