সাক্ষাৎকার

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হয়েছি: মিনার মনসুর

মিনার মনসুর কবি ও প্রাবন্ধিক। বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী প্রতিবাদী সাহিত্যধারার তিনি পুরোধা ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর রয়েছে গভীর বিশ্লেষণ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে তার আত্ম-নিবেদন অত্যন্ত সময়োপযোগী। এজন্য বহুবার তাঁকে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাঁর মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক পরিশ্রমলব্ধ গবেষণাগ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত বীর যোদ্ধারা’।  বইটি প্রকাশ করতে গিয়েও মিনার মনসুর রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হয়েছিল। সেই প্রতিকুল সময়ের কথা এবং বইটি লেখার প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাৎকারে।

রাইজিংবিডি: ‘মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত বীর যোদ্ধারা’ বইটি লেখার ভাবনা আপনি কীভাবে পেলেন?

মিনার মনসুর: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা নিজের পরিচয় দিতে ভয় পেতে। ’৭৫ পরবর্তী ২১ বছর এদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন হয়নি। সেসময় যারা ক্ষমতায় ছিল তারা মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু বিলীন করতে চেয়েছিল। তারা মুক্তিযুদ্ধকে উপেক্ষা করতে করতে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, মুক্তিযোদ্ধারা সব আশা হারিয়ে ফেলেছিলেন। সেই অবস্থায় ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন আমরা একটি উদ্যোগ নেই। তৃণমূল পর্যায় থেকে ২৫০ জনের বেশি মুক্তিযোদ্ধাকে ঢাকায় এনে সংবর্ধনা দেই ধানমন্ডি মাঠে। এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে  মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা, মেডেল এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। তখন এই মানুষগুলোকে দেখে, তাদের কষ্ট দেখে আমার হৃদয়ে নাড়া দেয়। যে মানুষগুলো মুক্তিযুদ্ধে মেশিনগান চালিয়েছে তাঁদের কেউ আজ দিনমজুর, কেউ ভিক্ষাবৃত্তি করে, কেউ-বা শ্রমিক। তাদের দিকে তাকানো যায় না। এই দৃশ্য দেখার পর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, মানুষগুলোর সঙ্গে আমার জীবনে আর দেখা নাও হতে পারে। তখন আমি তাদের সাক্ষাৎকার নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ২৫০-৩০০ জন লোকের সাক্ষাৎকার নেয়া সহজ বিষয় ছিল না। তারা ঢাকায় মাত্র ২ দিন ছিলেন। তখন একটি প্রশ্নপত্র লিখে তাদের বিলি করা হলো। তখনও বেশ কিছু বিপত্তি দেখা গেলো। অনেকে লিখতে পারেন না। তখন আমি বললাম, আপনারা বাড়ি ফিরে গিয়ে এলাকায় যারা লিখতে পারে তাদের মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর লিখে আপনি টিপসই কিংবা স্বাক্ষর করে যাবতীয় প্রমাণসহ পাঠিয়ে দেবেন। সেসময় আমি নিজ খরচে তাদের প্রত্যেকের ছবি তোলার ব্যবস্থা করি। সে অনুযায়ী তাদের অনেকেই পরে প্রশ্নের জবাব লিখে পাঠায়।

এভাবে আমাদের কাছে প্রায় সবারই সাক্ষাৎকার এবং তাদের সনদসহ প্রমাণগুলো চলে আসে ১৯৯৮ সালে। এরপর যাবতীয় ডকুমেন্টস নিয়ে যখন আমরা কাজ শুরু করি তখন একপর্যায়ে সরকার পরিবর্তন হয়। যেদিন সরকার পরিবর্তন হয় সেদিনই আমাদের অফিস আক্রান্ত হয়। যাবতীয় ডকুমেন্টস তছনছ হয়ে যায়। আমার নামে দেওয়া হয় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। এরপর সেখানেই আমাদের থেমে যেতে হয়। ২০০৮ সালে আমরা নতুন করে সেই বই ছাপানোর উদ্যোগ গ্রহণ করি। কিন্তু ততদিনে মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণগুলো হাতছাড়া হয়ে যায়। হারিয়ে ফেলি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবিগুলোও। তারপরও এটাই সান্ত্বনা যে আমরা শেষ পর্যন্ত বইটি প্রকাশ করতে পেরেছি।

রাইজিংবিডি: আপনাদের অফিসে হামলার কারণ কী ছিল?

মিনার মনসুর: তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতা পাওয়ার পরদিনই জানতে চান- বাংলাদেশে কোন কোন প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে? আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করতাম সে প্রতিষ্ঠানের নাম তিনি জানতেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। তার এই বক্তব্যের পরদিনই আমাদের প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়। বিএনপি জামায়াতের মাস্তান ও সন্ত্রাসী বাহিনী সমস্ত ডকুমেন্টস তছনছ করে। লুটপাট চালায়। এরপরও আমি নানাভাবে সেগুলো উদ্ধার করার চেষ্টা করি। এভাবে আমি ১৪৩ জনের ফাইল পাই। কিন্তু ছবিগুলো আমি পাইনি এবং অনেক মুক্তিযোদ্ধোর মূল সনদ হারিয়ে ফেলি। এরপর আমার নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করাও নাকি রাষ্ট্রদ্রোহী!

রাইজিংবিডি: বইটি লেখার কারণ কী?

মিনার মনসুর: আমি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা বই পড়েছি; ঘাটাঘাটিও করি। কিন্তু আমি যে বিষয়টিতে আলোকপাত করেছি সে বিষয়টি বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খুব বেশি স্থান পায়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মোটামুটি মধ্যবিত্ত কিংবা শহুরে মধ্যবিত্তকে খুব বেশি ফোকাস করলেও গ্রামের একেবারে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী, কৃষক, শ্রমিক বা দিনমজুরের ইতিহাসকে খুব বেশি স্থান দেয়া হয়নি। বাংলার সাধারণ মানুষের সম্মুখ যুদ্ধের ইতিহাস কিংবা অবদান খুব বেশি পাওয়া যায় না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তদের অবদানও কম নয়। যদিও তাদের ইতিহাস খুব বেশি পাওয়া যায় না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রধানত হয় সশস্ত্র বাহিনীর, নয়তো কোনো একটি বাহিনীর হয়ে লেখা হয়েছে। এতে শহুরে মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ মুক্তিযুদ্ধের বেশিরভাগ ক্রেডিট বা অবদানের খেতাবটি পেয়ে যায়। এমনকি যুদ্ধ যারা করেনি তারাও ক্রেডিট পেয়ে যায়। কিন্তু  গ্রামের সেই হতদরিদ্র কৃষক না পেলো মুক্তিযোদ্ধার খেতাব, না পেলো এর কোনো সুযোগ-সুবিধা। পায়নি কোনো জীবিকাও। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে তাদের এমন অবস্থা হয়েছিল যে, তারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেয়ার সাহসও পেতো না। মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিলেই মিলতো সমাজে নানারকম গঞ্জনা, ভৎর্সনা। সেসময় তারা ছিল সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত আর নির্যাতিত জনগোষ্ঠী।

রাইজিংবিডি: বইটির বিষয়বস্তু সংক্ষেপে যদি বলতেন।

মিনার মনসুর: বইটিতে খুবই মজাদার কিছু বিষয় আছে। কোনো কোনো সময় মনে হতে পারে, এগুলো রিপিটেশন বা পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু এগুলো ছিল তাদের আলাদা আলাদা মতামত। কিন্তু সবচেয়ে মজার বিষয় হলো তাদের মূল বক্তব্য একই রকম ছিল। আমরা তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ১০টি প্রশ্নের উত্তর চেয়েছিলাম। এর মধ্যে একটি ছিল: ‘কী স্বপ্ন নিয়ে তারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন?’

প্রায় বেশিরভাগ মানুষের স্বপ্ন ছিল, যে সমাজ তাদের প্রতি সুবিচার করেনি, তারা সেই অন্যায্য সমাজ থেকে মুক্ত হতে পারলে তারা সুবিচার পাবেন। দেশ স্বাধীনের মাধ্যমে তাদের অধিকার বুঝে পাবেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ থেকে দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। দেশকে স্বাধীন করে সরকারের সহায়তায় এবং নিজেদের চেষ্টায় যাবতীয় অভাব অনটন থেকে মুক্ত ও আত্মনির্ভরশীল হওয়া। এক কথায় তাদের খুব বেশি চাহিদা বা চাওয়া পাওয়া ছিল না। তারা যেন সামাজিকভাবে সবাই মিলে একটু সুখে শান্তিতে থাকতে পারে সেটাই ছিল তাদের স্বপ্ন।

প্রথম প্রশ্নের আরেকটি সম্পূরক প্রশ্ন ছিল: ‘কেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন?’ এর উত্তরে তাদের বেশির ভাগই বলেছেন: ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণে উদ্ধুদ্ধ হয়ে দেশ ও জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত এবং স্বাধীন করার জন্য।’

আমাদের সাত নম্বর প্রশ্ন ছিল: ‘কার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোনো অস্পষ্টতা, দ্বিধা বা মতভিন্নতা দেখা যায়নি। সবাই একবাক্যে বলেছেন ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়েই তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই তাদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাদের বক্তব্য থেকে এটাও স্পষ্ট যে, এই ভাষণের পরই প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সাক্ষাৎকার দাতা ১৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধার কেউই অন্য কোনো ঘোষকের নাম কিংবা অন্য কারও স্বাধীনতা ঘোষণার কথা বলেননি।

আমাদের নবম প্রশ্ন ছিল: ‘যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন বর্তমানে দেশ সেভাবে চলছে কী?’ এর উত্তরে অনেকেই বলেছেন ‘দেশ সেভাবে চলছে না।’ উল্লেখ্য, সেসময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় ছিল। তারা বলেছেন, সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্খার বাস্তবায়ন ঘটেনি। আমরা হয়তো বিশ্ব দরবারে স্বাধীন দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছি কিন্তু নিরন্ন অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি। দেশে ছিনতাই, রাহাজানি, হত্যা, ধর্ষণ ও দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। সংগঠিতভাবে আমরা জাতির মুক্তি সংগ্রামের কাজকে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছি।  অথচ এটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির অবশ্যপালনীয় রাজনৈতিক কর্তব্য।

আমাদের সর্বশেষ প্রশ্ন ছিল: ‘বর্তমানে দেশ নিয়ে কী ধরনের স্বপ্ন দেখেন?’ এর উত্তরে তারা বলেছেন, ‘আমরা এখনও একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল, বৈষম্যহীন, সন্ত্রাসমুক্ত  ও বেকারমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। দেশে শান্তি ফিরে আসবে, মানুষ মান সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে এবং সবার সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত হবে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমরা স্বপ্ন দেখি, দলনিরপেক্ষভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ইতিহাস তুলে ধরা হবে। বাংলাদেশ স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।

রাইজিংবিডি: বইটি প্রকাশ করতে গিয়ে কোনো অতৃপ্তি কাজ করেছে?

মিনার মনসুর: বইটিতে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের ছবিগুলো দিতে পারিনি। দিতে পারলে বিষয়টি পূর্ণাঙ্গ হতো। এটি একটি বড় কষ্ট। তারপরও চেষ্টা করেছিলাম সেসময়ে বইটি বের করতে। কিন্তু নানা কারণে হয়ে ওঠেনি। তবে সর্বশেষ ২০০৮ সালে সেটি করতে পেরেছি। একটু হলেও কষ্ট লাঘব হয়েছে।