সাক্ষাৎকার

করোনার প্রথম ধাক্কা আমরা কাটিয়ে উঠেছি: কবির আহমেদ

কবির আহমেদ। চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজ থেকে স্নাতক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। ১৯৯১ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মাধ্যমে তার কর্মজীবন শুরু।  এছাড়াও তিনি প্রাইম ব্যাংক, আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডে কাজ করেছেন।  তিনি এনআরবিসি ব্যাংকে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০১৩ সালের এপ্রিলে যোগ দেন।  বর্তমানে তিনি এই ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি কবির আহমেদ রাইজিংবিডিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেশের ব্যাংকিং খাত, অর্থলগ্নীকারক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজার, অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলেছেন।  সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেসবাহ য়াযাদ।

রাইজিংবিডি: বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত, অর্থলগ্নীকারক প্রতিষ্ঠানের সার্বিক অবস্থা কী? কবির আহমেদ: করোনাকালীন র্বতমান ব্যাংকিং খাত একটি চ্যালেঞ্জিং সময় অতিক্রম করছে। বিশ্বময় সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।  প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমাদের ব্যাংকিং খাত যে ভূমিকা পালন করছিল, তা কিছুটা থমকে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদনশীলতা, অর্থনৈতিক তৎপরতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন, এমনকি জীবনযাত্রা—সব জায়গায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।  এ সময় বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার সে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার ফলে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য লক্ষ করা যাচ্ছে। পাশাপাশি আমদানি প্রবণতা হ্রাস পাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে কিছুটা স্থবিরতাও দেখা যাচ্ছে।

রাইজিংবিডি: করোনাকালীন প্রথম এবং দ্বিতীয় ধাপের শেয়ার বাজারের অবস্থা, বিনিয়োগকারীদের আর্থিক ক্ষতি থেকে উত্তরণের জন্য করণীয় কী বলে মনে করেন? কবির আহমেদ: বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাসমূহ, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সহযোগিতার বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।  করোনার প্রথম ধাক্কা আমরা কাটিয়ে উঠেছি।  প্রাথমিক ধাক্কায় সরকার বিভিন্ন সেক্টরে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, যা ছিল মূলত ঋণকেন্দ্রেকি প্রণোদনা। এর ব্যবস্থাপনার সিংহভাগই ছিল ব্যাংককেন্দ্রিক।  দ্বিতীয় ধাক্কায় খেয়াল রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠিত সেক্টরের সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি সেক্টরও যেনো সহজে প্রণোদনা প্যাকেজ এবং ব্যাংকিং সুবিধার আওতায় আসতে পারে।  বিশেষ করে কৃষি ও ক্ষুদ্রশিল্পে, সহজ শর্তে বিনিয়োগের জন্য ব্যাংকগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে।

রাইজিংবিডি: পুঁজিবাজারে বুঝে না বুঝে যারা বিনিয়োগ করছেন, সেসব বিনিয়োগকারীদের জন্য আপনার পরামর্শ? কবির আহমেদ: ব্যাংকে আমানতের বিপরীতে সুদের হার কমে যাওয়ায়, বুঝে না বুঝে অনেকেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন।  তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, গুজবে কান দিয়ে, অল্প সময়ে অধিক লাভের আশায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ না করে, সতর্কতার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা করার জন্য। যারা শেয়ার বিনিয়োগে আগ্রহী, তাদের অবশ্যই বাজার বিশ্লেষণ করে, পর্যাপ্ত জ্ঞান নিয়ে তারপর বাজারে আসতে হবে।

রাইজিংবিডি: আপনার ব্যাংকের গ্রাহকসেবার মান বাড়াতে, গ্রাহকদের সন্তুষ্টির বিষয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা? কবির আহমেদ: এরই মধ্যে আমরা বিশেষ সার্ভিসের মাধ্যমে গ্রাহকদের মাঝে আলাদাভাবে সুনাম র্অজন করতে সক্ষম হয়েছি।  গ্রাহকসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে আমরা সার্ভিস লেভেলে কঠোরনীতি অনুসরণ করে থাকি। আপনারা জেনে খুশি হবেন, করোনাকালে আমরাই একমাত্র ব্যাংক যাদের সব সার্ভিস সেন্টার গ্রাহকদের সুবিধার্থে খোলা ছিল। এছাড়াও করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষে আমরা নানাবিধ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এর মধ্যে অন্যতম হলো, আইটি ভিত্তিক প্রোডাক্ট ও ডেলিভারি চ্যানেল চালু করা।  যার মাধ্যমে গ্রাহকরা ঘরে বসে বা সামাজকি দূরত্ব বজায় রেখেই দ্রুততার সঙ্গে ব্যাংকিং সেবা নিতে পারবেন। ইতোমধ্যে আমরা ‘প্ল্যানেট’ নামক মোবাইল অ্যাপ লঞ্চ করেছি। যার মাধ্যমে ঘরে বসেই গ্রাহকরা ফান্ড ট্রান্সফার, অনলাইন ডিপোজিট, ইউটিলিটি বিল প্রদান, মোবাইল টপ আপ ইত্যাদি সুবিধা গ্রহণ করতে পারছেন।  এছাড়া দ্রুত আমরা ঘরে বসেই অ্যাকাউন্ট ওপেন করার সুবিধা চালু করতে যাচ্ছি।

রাইজিংবিডি: এখন ব্যাংকের চাকরিতে বিজনেস, ম্যাথ, ফাইন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং, ইকোনোমিক্স ইত্যাদি রিলেটেড বিষয়ে না পড়েও কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর ভালোমন্দ দিক এবং অন্য বিষয়ে পড়ে যারা এই পেশায় আসতে চায়, তাদের জন্য আপনার পরার্মশ? কবির আহমেদ: আসলে ব্যাংকিং ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্যে পরিশ্রম, সৃজনশীলতা, নেতৃত্ব ইত্যাদি গুণাবলীর পাশাপাশি তাত্বিক জ্ঞান থাকাও জরুরি। এর জন্য যে গ্র্যাজুয়েশন পর্যায়ে রিলেটেড বিষয়ে পড়ে আসতে হবে, এমনটি জরুরি নয়। বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি, ব্যবসা শিক্ষার বাইরেও অন্য বিষয়ে পড়াশোনা করা কর্মীরা বেশ ভালো করছে। বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পড়ে আসা কর্মীরা বেশ ভালো করছে।  অন্য বিষয়ে পড়ে যারা এ পেশায় আসতে চাইবে, তাদের জন্য আমার পরামর্শ হচ্ছে-পরবর্তী সময়ে তারা যেনো এমবিএসহ অন্যান্য প্রফেশনাল ব্যাংকিং ডিগ্রিসমূহ নেওয়ার চেষ্টা করেন।

রাইজিংবিডি: নগদ, বিকাশ, শিওরক্যাশ, কিউক্যাশ এসব অনলাইন লেনদেনের মাধ্যম, অর্থলগ্নীকারক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সঙ্গে জেনারেল ব্যাংকিং কার্যক্রম সাংঘর্ষিক বলে মনে করেন কী? কবির আহমেদ: মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসসমূহ প্রথাগত ব্যাংকিং বহির্ভূত বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সেবার আওতায় এনেছে।  এসব সার্ভিস প্রথাগত জেনারেল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বরং পরিপূরক হিসেবে কাজ করছে।  তবে এটা সত্যি যে, বাংলাদেশে এই ধরনের সার্ভিস যে মডেলে কাজ করছে, তার বেশকিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রথমত, এই পদ্ধতি মূলত ব্যবহার করা হচ্ছে, অর্থ ট্রান্সফারের জন্য। এখানে গ্রাহকদরে ক্যাশ আউটের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ কোম্পানি মাত্রাতিরিক্ত চার্জ নেয়। যা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসে যোগদানের অন্তরায়।  এছাড়া ব্যাংকের মতো এসব প্রতিষ্ঠানগুলো লেনদেনের পরিপূর্ণ সল্যুশন হয়ে উঠতে পারেনি।  ব্যাংকের মতো অনেক ধরনের বাধ্যবাধকতা এদের নেই। যার ফলে এ মাধ্যমটি ব্যবহারে বিবিধ ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। তাই, এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে আরও কার্যকর মডেলে এমএফএস গড়ে তুলতে হবে।

রাইজিংবিডি: আমাদের জনসংখ্যা, সার্বিক অর্থনীতি, নাগরিকদের জীবন-যাপনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তুলনামূলক বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা বেশি বলে মনে করনে কী? কবির আহমেদ: দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ও জনসংখ্যার জীবনমানের ক্রমবর্ধমান হার বিবেচনায় বেসরকারি ব্যাংকের সংখ্যা বেশি বলা যাবে না।  তবে ব্যাংকগুলোর মধ্যে ‘একই টার্গেট কাস্টমারদের’ মধ্যে সেবা দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।  এ প্রবণতার কারণে ‘পটেনশিয়াল  কাস্টমার’ ও ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর’ একটি বড় অংশ ব্যাংকিং সেবার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। তাই ব্যাংকগুলোকে তাদের সেবার ব্যাপ্তি আরও বাড়াতে হবে। না হলে বেশিসংখ্যক বেসরকারি ব্যাংকের সুফল দেশের জনগণ পাবে না।

রাইজিংবিডি: অনেক বড় কোম্পানি সহজে ঋণ পাচ্ছে। এদের কেউ কেউ ঋণখলোপি বা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে।  কারো কারো শাস্তি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আটকে যাচ্ছে ব্যাংকরে হাজার হাজার কোটি টাকা।  অন্যদিকে ব্যক্তি ও ক্ষুদ্র এসএমই ঋণ পাওয়া এবং তা আদায়ে ব্যাংকের কঠোর নীতি- এই বিষয়ে আপনার মতামত? কবির আহমেদ: ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সব ব্যাংককেই রেগুলেটরি অথরিটির গাইডলাইনের আলোকে কিছু নীতিমালা মেনে চলতে হয়। অনেক সময় বড় বড় গ্রাহকরা সদিচ্ছা থাকা স্বত্বেও নিয়ন্ত্রণের বাইরের কিছু কারণে গ্রাহক ঋণের টাকা দিতে ব্যর্থ হন।  অন্যদিকে ব্যক্তিক বা রিটেইল ঋণসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জামানত ছাড়া প্রদান করা হয়ে থাকে,  যে কারণে ঋণ প্রদান ও আদায়ে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। তবে অত্যাধুনকি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এ ধরণের ঋণ প্রদানে জটিলতা কমিয়ে আনা সম্ভব।

রাইজিংবিডি: করোনাকালে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার বলে মনে করেন? কবির আহমেদ: স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে যেনো গ্রাহকরা লেনদেন করতে পারেন, এজন্য বিভিন্ন রকমের আইটি নির্ভর অলটারনেট ডেলিভারি চ্যানেল ব্যবহার বাড়াতে হবে।  যেমন, মোবাইল অ্যাপস্, ইন্টারনেট ব্যাংকিং এসব ব্যবহারের বিস্তার বাড়াতে হবে।  অনেক ব্যাংকই মোবাইল পেমেন্ট সার্ভিস (এমএফএস) নিয়ে আসলেও গ্রাহকদের জন্য পরপূর্ণ ও কার্যকরি পেমেন্ট সিস্টেম নিয়ে আসতে পারেনি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চীনের ‘উইচ্যাট’, ‘ইউনিয়ন পে’, জাপানের ‘লাইন’ এর আদলে পেমেন্ট সিস্টেম- দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার জন্য সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।