সাক্ষাৎকার

‘সিনেমায় আমাকে দেখে তারা খারাপ ভেবেছে, এতেই আমার আনন্দ’ 

চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান। গ্রামের মন্দ মোড়লের চরিত্রে তার অনবদ্য অভিনয় আজও বহু দর্শকের চোখে ভাসে। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। হয়েছেন প্রশংসীত। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। তাঁর প্রয়াণে এই সাক্ষাৎকারটি সংক্ষিপ্ত আকারে পুনরায় প্রকাশ করা হলো। মূল সাক্ষাৎকারটি গত বছর ঈদে রাইজিংবিডির বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।  

রাহাত সাইফুল : চলচ্চিত্র এবং নাটক দুই পর্দায় আপনি কাজ করেছেন? কোন জায়গায় কাজ করতে ভালো লেগেছে?   এটিএম শামসুজ্জামান : কোনো জায়গাতেই ভালো লাগেনি। সবগুলো ক-অক্ষর গোমাংস। জীবন ধারণের জন্য পয়সা প্রয়োজন, তাই কাজ করেছি। দুদিন পরে মারা যাব। কিন্তু আমার কথাগুলো থেকে যাবে। আবারও বলছি- সবগুলো ক-অক্ষর গোমাংস। পেটে বোমা মারলেও একটা ‘ক’ শব্দ বের হবে না, এমন মানুষ যদি নাটক, সিনেমা বানায় তাহলে আমার কিছু করার নেই। তবে সে তুলনায় নাটক এগিয়ে গেছে। আমার ঘনিষ্ঠজনেরা বলতো, নাটকে আরো বেশি মনোযোগ দিতে। কিন্তু চলচ্চিত্রের কথা ভেবে আমি আগে নাটকে সময় দেইনি। আমি যদি তাদের কথা মতো নাটকে আরো আগেই চলে যেতাম, তাহলে আজ আমার এই দশা হতো না।

রাহাত সাইফুল : বর্তমানে যারা সিনেমা নির্মাণ করছেন তাদের সর্ম্পকে আপনার মূল্যায়ন কী?  এটিএম শামসুজ্জামান : এখন যারা সিনেমা নির্মাণ করছেন তারা একদিকে ঝুঁকে আছেন। সেটা হচ্ছে- টাকা। যে শিল্পীর অর্থের ঝোঁক চলে যাবে তাকে শিল্প থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। যে মদ্যপান করে তাকে হয়তো আটকে রাখলে কিছুদিন পরে নেশাটা কমে যায়। কিন্তু সংস্কৃতিকে যারা অন্যধারায়, অন্য স্টাইলে নিয়ে যায় তাদের ফেরানো সহজ নয়। এখন সবাই এই অন্য ধারার নেশায় আচ্ছন্ন। সমস্যা হলো এই ধারার বিষয়ে তাদের কোনো স্বচ্ছ ধারণা নেই! তারা শুধু টাকার পেছনে ছুটছে।

রাহাত সাইফুল : চলচ্চিত্রের এই বেহাল দশার কারণ কী হতে পারে বলে মনে করেন? এটিএম শামসুজ্জামান : বলতে পারি, কিন্তু ওরা কষ্ট পাবে। কাউকে কষ্ট দেওয়ার ইচ্ছে নেই। চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন কার জন্য? একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে- বাংলার মানুষের জন্য চলচ্চিত্র বানাচ্ছি। তাদের জীবন, তাদের সংস্কৃতি, তাদের আচার-আচরণ সব কিছু নিয়েই চলচ্চিত্র। অন্তত এটুকুও যদি তাদের মাথায় থাকে তাহলে আর কিছু না হোক একেবারে না-দেখার মতো কিছু হবে না। আমার ধারণা যারা সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলেন তারা সংস্কৃতি কী জানেন না।

রাহাত সাইফুল : আমাদের চলচ্চিত্রে নতুন খল-অভিনেতা, কমেডিয়ান তৈরি হচ্ছে না কেন? আপনার ব্যাখ্যা কী?  এটিএম শামসুজ্জামান : এর অন্যতম কারণ ভালো স্ক্রিপ্টের অভাব। আমরা না কমেডি বুঝি, না কমেডি কীভাবে লিখতে হয় সেটা বুঝি। এখনকার স্ক্রিপ্ট রাইটাররা চেষ্টা করছেন না। ‘তারা পারছেন না’ বললে কষ্ট পাবেন। এবার আসুন অভিনেতা সম্পর্কে। অভিনেতা প্রতি মুহূর্তে তার চরিত্রের সঙ্গে কথা বলবে। এভাবে সে চরিত্র আত্মস্থ করবে। আমি এখনও চরিত্র ফুটিয়ে তোলার আগে নিজের সঙ্গে কথা বলি। সবসময় দেখি কোথায় কোন ভুল করলাম। কোথায় উচ্চারণ ভুল হলো। প্রতিনিয়ত ভুল করে যাচ্ছি। ভুল করতে করতেই শিখছি। অভিনেতার ভুল থেকে শেখার মানসিকতা থাকতে হবে। জীবন অনেক দ্রুত গতিতে চলছে। কিন্তু এই গতি অভিনেতার জন্য নয়। তার আলাদা সময় প্রয়োজন। যে সময়টুকু সে তার চরিত্রকে দেবে।

রাহাত সাইফুল : আপনি চলচ্চিত্রের সোনালি দিনের স্বনামখ্যাত অভিনেতা। তখন বাঘা বাঘা অভিনেতা ছিলেন। সেই সময় নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা কী ছিল? মানে, আপনার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী?  এটিএম শামসুজ্জামান : খলিল ভাই, মুস্তাফা (গোলাম মুস্তাফা) ভাইকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হতো। কারণ তারা জেনেশুনে অভিনয় করতেন। আমি চেষ্টা করতাম, মুস্তাফা ভাইয়ের কাছে যেন হেরে যেতে না হয়। মুস্তাফা ভাই চেষ্টা করতেন আমাকে হারাতে। আর এখন প্রতিযোগিতা হয় টাকার। অভিনয় শেষ হলেই টাকা; কে কতো টাকা পাবে সেই প্রতিযোগিতা। আমরা এভাবে ভাবতাম না। অভিনয়টাই ছিল গুরত্বপূর্ণ। কী পাবো তার চেয়ে বড় ছিল কী করতে পারবো এটা নিয়ে।

রাহাত সাইফুল : অনেকেই খল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু দেশে আপনিই প্রথম খল চরিত্রের সঙ্গে কমেডি যুক্ত করেছেন।  এটিএম শামসুজ্জামান : নষ্ট মানুষের চরিত্র আমি কমেডি দিয়ে করেছি। আমি অতি বাজে কথা বলবো, অতি নিষ্ঠুর কাজ করবো, যাতে মানুষ বুঝতে পারে ‘খুবই বাজে লোক’। বুঝতে পেরে তারা একটু হাসবে। তবে   আমি যাদের জন্য অভিনয় করি, তারা কীভাবে হাসে, কীভাবে কাঁদে এগুলো আমার শিখতে হয়েছে। আমি অধিকাংশ সিনেমায় বদমাইশ, ইতর চরিত্রে অভিনয় করেছি।

রাহাত সাইফুল : শুটিং করতে গিয়ে মজার কোনো ঘটনা কী মনে পড়ে?  এটিএম শামসুজ্জামান : অসংখ্য ঘটনা আছে। আমি গারো পাহারে শুটিং করতে গিয়েছিলাম। পরিচালক ছিলেন এহতেশাম। আমি জুম্মার দিনে গোসল করে পাজামা পাঞ্জাবি পরে যখন মসজিদে যাচ্ছি তখন একজন লোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- কোথায় যাচ্ছেন? আমি বললাম, মসজিদে যাচ্ছি। লোকটি বললো, জুম্মার নামাজ পরে আপনার লাভ কী? আমি বললাম, কেন ভাই? তিনি বললেন, জীবনে এতো আকাম করেছেন বুঝতে পারছেন না? আপনি একটা বাজে লোক! 

রাহাত সাইফুল : দর্শকের এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার দুঃখ হয়?  এটিএম শামসুজ্জামান : না। কখনো না। সিনেমায় দেখে তারা খারাপ ভেবেছে। এতেই আমার আনন্দ।

* এটিএম শামসুজ্জামান আর নেই