সাক্ষাৎকার

‘আমাদের দেশে ভ্রমণ তুলনামূলক ব্যয়বহুল’

ফাতিমা জাহান। স্বাধীনচেতা মন নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন পৃথিবীর প্রায় ৩৫টি দেশ। দেখেছেন বিভিন্ন দেশের মানুষের জীবনযাপন, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য। প্রত্নতত্ত্ব তাঁর আগ্রহের আরেকটি বিষয়। তাঁর ভ্রমণ-গদ্যে বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব পায়। দেশ-বিদেশে ভ্রমণ শেষে তিনি এই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমাদের পর্যটনের সংকটের কথা। বাঙালির ভ্রমণ মানসিকতাও উঠে এসেছে তাঁর অর্জিত নিজস্ব ভাবনায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আমিনুল ইসলাম শান্ত।

রাইজিংবিডি: আপনি ট্রাভেলার। এর শুরুটা কীভাবে হয়েছিল?

ফাতিমা জাহান: শুরুটা খুব মজার ছিল! আমি ভারতের বেঙ্গালুরুতে পড়াশোনা করেছি। আমাদের ক্যাম্পাস থেকে বের হতে দিত না। বাবা কড়া শাসনে বড় করেছেন। অর্থাৎ আমার চারপাশে নিয়ম-শাসনের বেড়াজাল। কিন্তু আমার মন ছিল স্বাধীনচেতা। এই বাউন্ডারি থেকে বের হতে ইচ্ছে করছিল। ওই সময় মনে হলো, আমার বয়স তো এখন ১৮। ফলে কিছুটা হলেও অবাধ্য হতেই পারি। এই ভাবনা থেকেই একদিন গোয়া বেড়াতে গেলাম। দু’চারদিন একা একা ঘুরে বেড়ালাম। এই ট্যুরে আমি খুব আনন্দ পেলাম! গোয়া গিয়ে একা হোটেল খুঁজে বের করা, দর্শনীয় স্থান খুঁজে বের করে দেখা- একটা থ্রিল হলো মনে। আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। এরপর ধীরে ধীরে বাইরে ঘুরতে যাওয়া শুরু করলাম। চাকরি শুরুর পর ভারতের বাইরে ভ্রমণ শুরু করি।

রাইজিংবিডি: ভারতের বাইরে বেড়ানোর জন্য কোন দেশ প্রথমে বেছে নিয়েছিলেন?

ফাতিমা জাহান: নেপাল, এরপর ভুটান। এরপর ইস্টের দিকে যাওয়া শুরু করি। এখন পর্যন্ত ৩৫টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছি।

রাইজিংবিডি: এশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। দুই মহাদেশের সাংস্কৃতিক পার্থক্য কতটা চোখে পড়েছে?

ফাতিমা জাহান: অনেক পার্থক্য রয়েছে। শুধু এশিয়ার কথা যদি বলেন, তবে এখানেই অনেক কালচার রয়েছে। মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া, সাউথ এশিয়া ভিন্ন ভিন্ন কালচার। তুরস্ক এশিয়ার মধ্যে পড়েছে। তাদের কালচার লিবারেল। আমার ভালো লেগেছে। এশিয়ার কালচারে সবচেয়ে বড় বিষয় পারিবারিক বন্ধন। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া। এটি ইউরোপে নেই। তাছাড়া এশিয়ার প্রাচীন কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড খুব শক্তিশালী। সেটা সংগীত, নৃত্যকলা, আর্টস যাই বলুন না কেন। আমাদের খাদ্যাভাসও প্রাচীন। এটা ইউরোপ থেকে ভিন্ন। আসলে দুই মহাদেশেই সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্য রয়েছে। তুলনা করা মুশকিল! এবং প্রত্যেক সংস্কৃতিরই আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।

রাইজিংবিডি: আমাদেরও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। আমরা বিদেশি পর্যটকদের কতটা আকৃষ্ট করতে পারছি বলে আপনি মনে করেন?

ফাতিমা জাহান: একেবারেই আকৃষ্ট করতে পারছি না। আমার এক ছেলে বন্ধু ইরান থেকে এসেছিল। ও বলে গেছে- আমি আর আসব না। কারণ এখানে কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। জার্মানি থেকে আরেক নারী বন্ধু এসেছিল। ও বলেছে- আর আসবে না। কারণ ওকে এখানে বিব্রত হতে হয়েছে। আমাদের সামাজিক কিছু সমস্যা রয়েছে। আমরা বাংলাদেশিরা নিরাপত্তাহীনতার জন্য ভ্রমণ করতে পারি না। শঙ্কায় থাকি, ছিনতাইয়ের মুখে পড়তে পারি। অথচ আমাদের চমৎকার জায়গা রয়েছে! কিছুদিন আগে সাজেক গিয়ে বিস্মিত হয়েছি- এত সুন্দর জায়গা বাংলাদেশে! অথচ আমি পয়সা খরচ করে অন্য দেশে গিয়ে এ ধরনের জায়গা দেখে এসেছি। আমরা অনেক কিছু জানি না এবং মেনটেইন করতে পারছি না। ফলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হচ্ছি।

রাইজিংবিডি: এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কী বলে মনে করেন?

ফাতিমা জাহান: আমাদের পাশের দেশ ভুটান চলে পর্যটক দিয়ে। নেপালও অনেকখানি চলে পর্যটন খাত থেকে আয়কৃত অর্থে। এটা কীভাবে হয়েছে? তারা বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পেরেছে। ওদের ওখানে পর্যটকদের জন্য পরিবেশটা বন্ধুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তা আছে। ওখানে খারাপ কোনো ঘটনা খুব কম ঘটে। রাস্তাঘাট ভালো, থাকার ভালো জায়গা আছে, ভালো খাবারের ব্যবস্থা আছে এবং এসবের মূল্য নির্ধারণ করা। কেউ বাড়তি মূল্য রাখতে পারবে না। কিন্তু দেশে আমি যে হোটেলে পরিবার নিয়ে থাকব সেটা কতটা নিরাপদ? হোটেল মালিক ও সরকারকে এটা নিশ্চিত করতে হবে।

দেশে কোনো ট্যুরিস্ট যখন হেঁটে যায়, তখন পাশ থেকে কেউ না কেউ টিজ করে। কেউ উপযাজক হয়ে কথা বলতে চায়, গায়ে হাত দেয়! ট্যুরিস্টের কাছে এগুলো খুবই বিরক্তিকর। আমরা বাইরে বেড়াতে গেলে নির্ভয়ে সেখানকার রাস্তাঘাটে হাঁটি। পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে দেখি। কেউ গাড়িতে ঘুরে বেড়ায় না। তাদের এ ধরনের নিরাপত্তা দিতে হবে। সাধারণ মানুষকে আরো সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। নিরাপত্তার জন্য হট লাইন রাখতে হবে। যাতে অঘটন ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পৌঁছে যেতে পারে।

রাইজিংবিডি কার্যালয়ে ফাতিমা জাহান

বাংলাদেশ টেকনোলজির দিক দিয়েও পিছিয়ে আছে। নেপালের এয়ার টিকিট, হোটেল বুকিং সব এখান থেকে করতে পারি। বাংলাদেশে মাস্টার কার্ড দিয়ে অনেকে কিছু বুকিং করতে পারেন না- এতে ভ্রমণে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তাছাড়া আমাদের যে এত সুন্দর দর্শনীয় স্থান আছে তা বিশ্বের মানুষ জানে না। এজন্য প্রয়োজন প্রচার। এদিক থেকেও দেশ পিছিয়ে রয়েছে।

রাইজিংবিডি: আমাদের যাপিত জীবনে ভ্রমণের মানসিকতা কতটুকু আছে বলে মনে করেন?

ফাতিমা জাহান: ভ্রমণের মানসিকতা সবারই আছে। সবাই ভ্রমণ করতে চায়। কিন্তু অবকাঠামোগত ল্যাকিংস সমস্যা তৈরি করছে। যেমন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেত সময় লাগার কথা ৫ ঘণ্টা। কিন্তু সেখানে বাসে লাগছে ১০-১২ ঘণ্টা। এসব চিন্তা করলে আমাদের আর যেতে ইচ্ছে করে না। তারপর সাধারণ হোটেল ভাড়াও বেশি। এত খরচের কথা ভাবলে ভ্রমণের ইচ্ছে দমে যায়। আবার সময়মতো বাসের টিকিট পাওয়া যায় না। প্লেনে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যেতে যত খরচ হয়, ওই খরচ দিয়ে আমি থাইল্যান্ড যেতে পারি। এজন্য মানুষ বিরক্ত হয়ে দেশের ভেতরে ভ্রমণ করতে চায় না। অথচ আমাদের জীবন প্রচণ্ড একঘেয়ে। রিফ্রেশমেন্টের কোনো ব্যবস্থা নেই। এজন্য মানুষ ভ্রমণ করতে চায়। কিন্তু আমাদের দেশে ভ্রমণ করা অনেক ব্যয়বহুল।

রাইজিংবিডি: আপনি পূর্ব পরিকল্পনা করে ভ্রমণে বের হন, নাকি যখন যেভাবে মনে হয় হুটহাট বেরিয়ে পড়েন?

ফাতিমা জাহান: দুটোই করি। যখন লং ট্রিপে যাই তখন পূর্ব পরিকল্পনা করে বের হই। পড়াশোনা, চাকরি এসব গুছিয়ে তারপর লং ট্রিপে যেতে হয়। লং ট্রিপে সর্বোচ্চ টানা ৩ মাস ট্রাভেল করেছি। এছাড়া হঠাৎ ৪-৫ দিন ছুটি পেলে তখন হুটহাট চলে যাই। তবে ভ্রমণের ক্ষেত্রে পূর্ব পরিকল্পনা করে যাওয়াই ভালো। তাতে ঝামেলার আশঙ্কা থাকে না। যেমন: যেখানে যাচ্ছি সেখানে দর্শনীয় কী কী রয়েছে তার খোঁজ নেওয়া। যাতায়াতারে মাধ্যম চূড়ান্ত করে টিকিট বুক করা। দর্শনীয় স্থানের আশপাশে হোটেল খুঁজে বের করা।

রাইজিংবিডি: আপনার ভ্রমণ-গদ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। তার মানে ভ্রমণের আগে আপনাকে এ বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে হয়। এই প্রস্তুতিটা কীভাবে নেন?

ফাতিমা জাহান: এটা একটা ডকুমেন্ট। আমি যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারি না। যে কারণে প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস জানার জন্য সেখানকার বইপত্র সংগ্রহ করি। গুগলে সার্চ করলে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। আমি চেষ্টা করি সবটা পড়ার। উপলব্ধি করার চেষ্টা করি ওই সময়টা আসলে কেমন ছিল।

রাইজিংবিডি: আপনি ভ্রমণ লিখছেন। বই প্রকাশিত হয়েছে। এ বিষয়ে আপনি নতুন কী পরিকল্পনা করছেন?

ফাতিমা জাহান: আমি নিজেকে এখনও ভ্রমণ-সাহিত্যিক মনে করি না। যখন কোনো পত্রিকার সম্পাদক লিখতে বলেন তখন লিখি। ভ্রমণ বিষয়ক যে বইটি প্রকাশিত হয়েছে, সেটার সূত্রপাত রাইজিংবিডি থেকে। পত্রিকার সম্পাদক লিখতে বললে তখন আমি লেখার টেবিলে বসি। বই প্রকাশ করার পরিকল্পনা করে লিখছি- বিষয়টি তেমন নয়। এ মাসে তুরস্ক ভ্রমণের উপরে যে বইটি প্রকাশিত হয়েছে সেটিই এবারের বইমেলায় পাঠকদের জন্য থাকবে।

রাইজিংবিডি: সাহিত্যের অন্যতম একটি ধারা ভ্রমণসাহিত্য। সাহিত্যের এই মাধ্যমে তরুণ লেখকরা কেমন করছেন, কাকে সম্ভাবনাময় মনে হয়?

ফাতিমা জাহান: সর্বশেষ ভ্রমণসাহিত্যে বাংলা একাডেমি থেকে শাকুর মজিদ পুরস্কার পেয়েছেন। আমরা তাদের ইমিডিয়েট নেক্সট জেনারেশন। আমাদের জেনারেশনে এই মুহূর্তে কাউকে দেখছি না। একটা কথা বলতে চাই, চাকরি বা পড়াশোনার জন্য বিদেশ গিয়ে সেখানকার কিছু জায়গা ট্রাভেল করা- আমাদের দেশে ভ্রমণের কনসেপ্ট এখানে আটকে আছে। বাংলাদেশে ভ্রমণের অন্যতম আরেকটি কনসেপ্ট প্যাকেজ ট্যুর। হোটেল থেকে গাড়িতে স্পটে নিয়ে যাবে, আবার গাড়িতে হোটেলে পৌঁছে দেবে। তারপর হোটেল থেকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেবে- ট্যুর কমপ্লিট। আমি এই গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছি। ভারত-চীন বা ইউরোপের ট্রাভেলাররা এই গণ্ডির বাইরে। আমি সম্পূর্ণ নতুন একটি জায়গায় ভ্রমণে ইচ্ছুক। এমনও হয়েছে ভ্রমণে যেখানে গিয়েছি, সেখানে আমার বন্ধুরা আছে। কিন্তু আমি ওদের সঙ্গে দেখা করিনি। কারণ দেখা করলেই সময় নষ্ট হবে। আমি আগে ট্রাভেল করি, হেঁটে হেঁটে দেখার চেষ্টা করি, স্থানীয় সংস্কৃতি জানার চেষ্টা করি- তারপর যদি সময় থাকে তখন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে সময় কাটাই।

রাইজিংবিডি: ভ্রমণ করে কোন দেশটি আপনার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে?

ফাতিমা জাহান: প্রকৃতি বিচারে একেক দেশ একেক রকম সমৃদ্ধ। ভুটান খুবই সুন্দর দেশ। ভারতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ! আপনি কাশ্মিরে গেলে সুইজারল্যান্ডের মতো দৃশ্য দেখতে পাবেন! তুরস্ক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি দেশ। ইন্দোনেশিয়ায় গেলে সমুদ্রের আলাদা সৌন্দর্য পাবেন। চীনে গেলে অসাধারণ পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখবেন। কোনো দেশের সঙ্গে কোনো দেশের তুলনা করা যায় না। তবে তুরস্ক ভ্রমণ আমার জীবনে বিশেষ কিছু। মওলানা জালাল উদ্দিন রুমির সমাধিসৌধে যাওয়ার জন্য বহুদিনের পরিকল্পনা ছিল। তাঁর সমাধিসৌধে যাওয়াটাই আমার জীবনের বড় স্মৃতি। এর চেয়ে আনন্দের বা স্মরণীয় কোনো স্মৃতি আমার জীবনে নেই।