মার্চ স্পেশাল

৭ মার্চের ভাষণ: কোথায় কেমন আছে সেসব শব্দযন্ত্র

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আঙুল উঁচিয়ে যে মহাকাব্যিক ভাষণ দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তা কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে। প্রামাণ‌্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া সে ভাষণ এখন বিশ্বসম্পদ। তবে সেদিন যেসব শব্দযন্ত্রের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ ছড়িয়ে পড়েছিল মুক্তিকামী মানুষের কাছে, সেগুলো কোথায়?

যন্ত্রগুলো আছে। কিন্তু ভালো নেই। ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া সেই ‘কল-রেডী’ আজও থাকলেও অযত্ন-অবহেলার আছে সেই মাইক স্ট‌্যান্ড, মাইক্রোফোন। সেদিনের মাইক স্ট‌্যান্ড আজও আছে প্রতিষ্ঠানটির সংরক্ষণে। কিন্তু এতদিনেও তা রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অবহেলা-অযত্নে নষ্ট হওয়ার পথে সেই অমূল্য স্মৃতিধন‌্য সম্পদগুলো।

বার বার বলার পরও সরকারিভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ না নেওয়ায় হতাশ ‘কল-রেডী’র প্রতিষ্ঠাতা হরিপদ ঘোষের ছেলে ও প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান মহাব্যবস্থাপক বিশ্বনাথ ঘোষ। 

তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এটা নিয়ে আর কথা বলব না। চিন্তা করেছি, ব্যক্তিগতভাবে এ যন্ত্রগুলো সংরক্ষণ করব। অনেক চেষ্টা করেছি। সরকারের সংশ্লিষ্ট জায়গায় কথা বলেছি এগুলো সংরক্ষণের বিষয়ে। কিন্তু দেখলাম, এটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। হয়তো এটা সংরক্ষণে রাখার প্রয়োজনীয়তা নেই বলে তারা মনে করেন। যাহোক, আমি ব্যক্তিগতভাবে এগুলো মিউজিয়ামে রাখব। স্পন্সরও পাওয়া গেছে।’

১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা মার্চের ৭ তারিখে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীপ্ত কণ্ঠের সে ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। কালের পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর মহাকাব্যিক ৭ই মার্চের সেই ভাষণকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ‘ইউনেস্কো’। 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সভা-সমাবেশেও কল-রেডীর মাইকে বক্তব্য দিয়েছেন নেতারা। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ তো ইতিহাস। 

৫০ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর সেই আওয়াজ উজ্জীবিত করেছিল ৭ কোটি স্বাধীনতাকামী মানুষকে। যে কণ্ঠ কোটি মানুষের কানে পৌঁছে গিয়েছিল ‘কল-রেডী’র মাইকের মাধ্যমে, সেসব মাইক এখনও পড়ে আছে অযত্ন-অবহেলায়। এরইমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে ৭ই মার্চে ব্যবহৃত অনেক শব্দযন্ত্র।

বঙ্গবন্ধুর সেদিনের অগ্নিঝরা বক্তব্যের স্বাক্ষী মাইক স্ট‌্যান্ডগুলো বহু কষ্টে সংরক্ষণ করা হয়েছে, জানিয়ে বিশ্বনাথ ঘোষ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘জনসভা শেষ হতে না হতে খবর আসে, কল-রেড়ীর দোকানে আগুন দিয়েছে পানিস্তানের সমর্থকরা। এগুলো সংরক্ষণ করা খুব চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে আফসোস, এতদিনেও এগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি! দেওয়া হয়নি কোনো স্বীকৃতিও!’

‘আরজু লাইট হাউস’ থেকে ‘কল-রেডী’ ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। ওই বছর বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার মঠবাড়িয়া গ্রামের দুই ভাই হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষ পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে ‘আরজু লাইট হাউস’ নামে একটি আলোকসজ্জার দোকান চালু করেন। আলোকসজ্জার পাশাপাশি গ্রামোফোনও ভাড়া দেওয়া হতো। সভা-সমাবেশ ও বিয়ে-শাদিতে গ্রামোফোন ভাড়া নিত লোকজন। এভাবে অল্প দিনেই দোকানটি পরিচিত হয়ে ওঠে।

রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা মাইক ভাড়া নিতে শুরু করেন ‘আরজু লাইট হাউস’ থেকে। চাহিদা বাড়তে থাকে দিনে দিনে। তাই তাইওয়ান, জাপান, চীন থেকে আনা হয় মাইক। এরপর নিজের দোকানের কারিগর দিয়ে হরিপদ ঘোষ তৈরি করতেন বাকি অংশ। 

‘কল-রেডী’ নামকরণ কেন? বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে সভা-সমাবেশ বাড়তে থাকে। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রয়োজনেও মাইকের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। তাই মাইক সার্ভিসের সঙ্গে মিল রেখে ‘কল-রেডী’ নামটিই ঠিক করা হয়। প্রয়োজনে কল করলেই যেন মাইক রেডি থাকে। অর্থাৎ কল করলেই রেডী—‘কল-রেডী’। 

নামকরণের বিষয়ে বিশ্বনাথ ঘোষ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মূলত কল করলেই যাতে তাৎক্ষণিকভাবে সেবা দিতে পারি, এমন ভাবনা থেকে নামকরণ কল-রেডী।’

কল-রেডী মাইকে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও বক্তব্য দিয়েছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অনেকে। এছাড়া, বিভিন্ন সময়ে বিদেশি নেতাদের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ভারতের ইন্দিরা গান্ধী, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ‘কল-রেডী’ মাইক্রোফোন ব‌্যবহার করে ভাষণ দিয়েছেন। 

‘কল-রেডী’কে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনা আর ৭০ সালের নির্বাচনে জয়ের পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বাংলার মানুষ তখন ক্ষুব্ধ। এরই মধ্যে চলে এলো ১৯৭১ এর অগ্নিঝরা মার্চ মাস। ৭ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ৭ কোটি মানুষের প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশবাসী-বিশ্ববাসী তাকিয়ে আছেন—কী বলতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। ঘুম হারাম তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন। তার এই বক্তব্য ছড়িয়ে দিতে হবে আনাচে-কানাচে। কল-রেডীর মালিক হরিপদ ঘোষ ও দয়াল ঘোষকে ধানমন্ডির বাসায় ডেকে পাঠালেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশ দিলেন তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মাইক লাগাতে। হুমকি উপক্ষো করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দেন হরিপদ বিশ্বাস।

জনসভা যাতে সফল না হয়, সেজন্য প্রতিবন্ধকতা ও হুমকি-ধমকি ছিল। জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় অনেকেই হরিপদ ও দয়ালকে মাইক দিতে নিষেধ করেন। কিন্তু হরিপদ ও দয়ালের চোখেও তখন শোষকদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মাইক সরবরাহ লাগানোর কাজে নেমে পড়ে কল-রেডী। তখন রেসকোর্স ময়দানে মাইক লাগানো সহজ ছিল না। কারণ, শাসকগোষ্ঠীর সতর্ক নজরদারি ছিল রেসকোর্স ময়দানের দিকে। 

সেদিনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে হরিপদ ঘোষের চার ছেলের একজন বিশ্বনাথ ঘোষ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে মাইক লাগাতে গিয়েছিলেন আব্বা ও কাকা। মাইক লাগিয়ে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেন তারা। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কিছু বাড়তি মাইক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মজুদ রাখা হয়। যেন সমাবেশের দিন তাৎক্ষণিকভাবে লাগানো যায়। তিন দিন ধরে ৩০ জন কর্মী নিয়ে খুঁটি গাড়েন তারা। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় যেন যান্ত্রিক ত্রুটি না হয়, সেজন্য নিজে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি একজন সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দিয়েছিলেন হরিপদ ঘোষ। অতিরিক্ত তিনটি মাইক্রোফোন সঙ্গে রেখেছিলেন দয়াল ঘোষ। পরের দিন পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলো। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ কল-রেডীর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তবে জনসভা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘কল-রেডী’র দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয় পাকিস্তানের সমর্থকরা।

এত বছরেও কেন উপেক্ষিত কল-রেডী? ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে কল-রেডীর যে মাইকগুলো ছিল, সেগুলো অযত্ন আর অবহেলায় নষ্ট হতে বসেছে। ওই দিন জনসভায় ব্যবহৃত মাইক্রোফোনের স্ট্যান্ডটি আজও সংরক্ষিত আছে ‘কল-রেডী’র কাছে। সেদিন যেসব অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহার করা হয়েছিল, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি অ্যামপ্লিফায়ার এখনও আছে। আছে চারটি মাইক্রোফোন।

যে প্রতিষ্ঠানটি ইতিহাসের অংশ, জীবন্ত স্বাক্ষী; কেন সেই প্রতিষ্ঠানকে এখনও স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি এবং সেদিন ব্যবহৃত শব্দযন্ত্রগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, সে প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে উঠেছে। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী এবং মুজিববর্ষে এই দাবি আরো জোরালো হয়েছে।