মার্চ স্পেশাল

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রক্ষায় জীবনের ঝুঁকি নিলেন আমজাদ

যুগ যুগ ধরে যে মহাকাব্যিক ভাষণটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে, সেটির রেকর্ড ধারনের পর তা সংরক্ষন করা কঠিন হয়ে পড়েছিলো। তবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে কর্মরত কয়েকজন মুক্তিকামী বাঙালির বীরত্বে রক্ষা পেয়েছিল বাঙালির ইতিহাসের এই অমূল্য সম্পদ। তাদের একজন আমজাদ আলী খন্দকার, যিনি সে সময় ছিলেন চলচ্চিত্র বিভাগের ক্যামেরা সহকারী।

ডিএফপির ক্যামেরা সহকারী থেকে ক্যামেরাম্যান হয়ে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দেন তিনি। ২০০৪ সালে বিটিভির কন্ট্রোলার-চিফ ক্যামেরাম্যান হিসাবে অবসরে যান।  কর্মজীবনে বেশ কয়েকবার আহত হওয়া আমজাদের শরীরের বাঁ দিকের অংশ আট বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত।

আমজাদ আলী জানান, ১৯৬৯ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড গোপনে ধারণ করে সংরক্ষণ করতেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের বাঙালি কর্মীরা। এরই ধারাবাহিকতায় অসহযোগের আন্দোলনের উত্তাল সময়ে আসা ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ড সংরক্ষণের আয়োজন সম্পন্ন করেন তারা।  সে সময় চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক মহিবুর রহমান খানের (অভিনেতা আবুল খায়ের নামেই বেশি পরিচিত) নির্দেশে আমজাদসহ কয়েকজন ভাষণের ভিডিধারণ ও সংরক্ষণের এ কাজ করেন।

কিভাবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ধারণ করেছিলেন, ফিল্ম ডেভেলপ করেছেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তা লুকিয়ে সংরক্ষণ করেছেন সেই গল্প শুনিয়েছেন আমজাদ হোসেন।

সেদিন মুহুর্মুহু গর্জনে একাকার ময়দান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা সেদিন ছিল মিছিলের শহর। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ পায়ে হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন।  ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে ভরে উঠেছিল বিশাল ময়দান। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়ছিলেন বাঁশের লাঠি হাতে সমবেত লাখ লাখ বিক্ষুব্ধ মানুষ। বাতাসে উড়ছিল বাংলার মানচিত্র আঁকা লাল সূর্যের অসংখ্য পতাকা।

এই জনসমুদ্রে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ভিডিওচিত্র ধারণের কাজ করেন চলচ্চিত্র বিভাগের কর্মীরা। এক ভাগে দায়িত্ব মূল ভাষণ আর অন্য ভাগ ধারণ করে সেখানকার সার্বিক পরিবেশ। এই দুই দলে ছিলেন ক্যামেরাম্যান জেড এম এ মবিন, ক্যামেরাম্যান এম এ রউফ, ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকার, ক্যামেরা সহকারী এস এম তৌহিদ, ক্যামেরা সহকারী সৈয়দ মইনুল আহসান, ক্যামেরা সহকারী জোনায়েদ আলী ও এমএলএসএস খলিলুর রহমান।

ভাষণ রেকর্ডের প্রস্তুতি আমরা যখন যাই, সকাল বেলা থেকে লোকজনে মাঠ পূর্ণ হয়ে গেছে। তার মধ্যে আমরা গিয়ে ক্যামেরা বসালাম। ভাষণ রেকর্ড করার দায়িত্বে ছিলাম, আমি ও মবিন সাহেব। রউফ সাব ও তৌহিদ ঘুরে ঘুরে শট নেয়। ভাষণ রেকর্ডের পর সেটা সংরক্ষণে উদ্যোগী হন মহিবুর রহমান খা’র কর্মীরা।  পাকিস্তানিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছিল তাদের।

ফিল্ম ডেভেলপ করতে কৌশলের আশ্রয় ধারণকৃত ভাষণটির ফিল্ম ডেভেলপ করতে গিয়ে ধরা পড়তে পারেন সেই শঙ্কায় ট্যাগ লাইনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংশ্লিষ্ট কিছু না লিখে কৌশল নিলেন আমজাদরা; সেখানে লেখা হল-‘সাইক্লোন’। এর উদ্দেশ্য হলো যাতে কেউ বুঝতে না পারে এটি বঙ্গবন্ধুর ভাষণের রেকর্ড।  যাতে অন্যরা মনে করে, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় সংশ্লিষ্ট ফিল্ম এগুলো।

‘তখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ফিল্ম ডেভেলপ করে নিয়ে আসব, সে ব্যবস্থা আমাদের ছিল না।  এটা করত এফডিসি ল্যাবে।  বঙ্গবন্ধুর নাম দেখলে এটা নষ্ট করে ফেলবে সেজন্য আমরা কর্মীরা কৌশল করে ‘সাইক্লোন’ চিহ্ন দিয়ে এফডিসি থেকে ডেভেলপ করে নিয়ে আসলাম।”  

আর্কাইভ থেকে ভাষণ রক্ষা হলো যেভাবে ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর বিভিন্ন অফিস-আদালতের দায়িত্ব নেওয়া শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। চলচ্চিত্র বিভাগের মুক্তিকামী কর্মীরা ধারণা করলেন, পাকিস্তানি সেনারা যদি হানা দেয় তাহলে ভাষণটির রেকর্ড ধ্বংস করে দেবে। সে কারণে কীভাবে এগুলো সচিবালয়ের আর্কাইভ থেকে সরানো যায় সেই পরিকল্পনা করলেন বিভাগের প্রধান মহিবুর রহমান।

‘তখন উনি আমাকে বললেন, আমজাদ... তোমাকে একটা দায়িত্ব দেব।  আমি বলছি, কী দায়িত্ব স্যার? উনি বললেন, ‘ তোমাকে এই মুহূর্তে ফিল্মগুলো নিয়ে ঢাকার বাইরে যেতে হবে।”

৪২ ইঞ্চি ট্রাঙ্ক সেই কথার পর আমজাদকে ট্রাঙ্ক কিনে নিয়ে আসার জন্য টাকা দেন মহিবুর রহমান।  নির্দেশ পেয়ে সদরঘাট থেকে ৪২ ইঞ্চি মাপের ট্রাঙ্ক কিনে আনেন আমজাদ।

তিনি বলেন, ট্রাঙ্ক আনার পর মহিবুর রহমান নিজে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কাজী নজরুল ইসলামের ওপর করা ডকুমেন্টারি ফিল্ম ও বঙ্গবন্ধুর আরও ছবি ফিল্ম ঢুকিয়ে দেন।

‘এরপর আমি স্যারকে বললাম, ‘স্যার, আমি একটু আমার বাবার সাথে দেখা করে আসি?’ বললেন, ‘যাও’।  আমার বাবা বিজি প্রেসে চাকরি করতেন। আমি বাবাকে বললাম, ‘আমি দুই দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাইতেছি। চিন্তা কইরেন না।”

জীবনের ঝুঁকি নিলেন আমজাদ বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেখান থেকে সোজা সচিবালয়ে কার্যালয়েই ফিরলেন আমজাদ। বাসায় স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকলেও তাদের সঙ্গে দেখা করতে যাননি।  কার্যালয়ে আসার পর রেকর্ড নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাকে।

‘অফিসে যাওয়ার পরে খায়ের সাহেব আমাকে রুমের ভেতর নিয়ে গেল। আমাকে রুমের ভেতর নিয়ে বিদায় দিলেন। ... আমার হাত ধরে বললেন, ‘আমজাদ, আল্লাহ হাফেজ।’ ওনার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। উনি জানতেন যদি ধরা পড়ে তাহলে আর বাঁচবে না।”

সচিবালয় থেকে বের হতে হবে, কিন্তু বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সেনাদের সতর্ক পাহারা ও টহল। সচিবালয়ে ঢোকার ফটক ‘ সেকেন্ড গেইট’ দিয়ে বের হওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।

ওই ফটকের দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সার্জেন্ট ফরিদও ছিলেন সেই পরিকল্পনায়। বেবি ট্যাক্সিতে করে বড় আকারের ট্রাঙ্ক নিয়ে রওনা হন আমজাদ।  সংকেত পেয়ে ফটক খুলে দেন ফরিদ।

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল। সচিবালয়ের টিনশেড থেকে ট্রাঙ্ক নিয়ে বের হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সেনাবাহিনীর সতর্ক প্রহরায় কিছুটা সন্ত্রস্ত হলেও লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে থাকেন আমজাদ।

আর্মির জিপ! থমকে দাড়ান আমজাদ ‘ প্রেসক্লাবের সামনে এসে দেখি, আর্মির জিপ। মেশিন গান নিয়ে জনতার দিকে তাক করে বসে আছে। ওইখান দিয়ে আমার বেবি সোজা চলে আসল। ‘কী আছে?’ বললেই তো আমি শেষ।’

তবে কোনো ঝামেলা ছাড়াই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পাশ ধরে চাঁনখারপুল থেকে চকবাজার হয়ে সোয়ারিঘাটে পৌঁছে আমজাদের বেবি ট্যাক্সি। এর পরের ধাপ নৌকা পারাপারের।

সোয়ারিঘাটে যাওয়ার পর কুলিরা দৌড়ায়ে আসল। বলল, ‘স্যার কী এটা?’ আমি বললাম, ‘তাড়াতাড়ি উঠাও।’ নৌকায় উঠাল। নৌকায় করে জিনজিরায় গেলাম। নৌকায় বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেওয়ার পর আমজাদ দেখেন, শয়ে শয়ে লোক বাসের অপেক্ষায়। যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছে।

‘দেখি, একটা বাস ছাইড়া যাইতেছে। বাসের পেছনে জোরে একটা থাপ্পড় মারলাম। থাপ্পড় দেওয়ার পরে ড্রাইভারটা পেছনের দিকে তাকাল।... বাসের উপরে উঠায়া দিলাম।”

ভেতরে জায়গা না পেয়ে ট্রাঙ্কের সঙ্গে বাসের ছাদে চড়ে বসেন আমজাদ।  পৌঁছান নবাবগঞ্জের বক্সনগরে। কিন্তু বক্সনগর থেকে তার গন্তব্য হাঁটাপথ কিংবা ঘোড়া।

আমজাদ বলেন, ঘোড়ার পিঠে উঠায় দিয়ে ঘোড়াওয়ালা একদিকে ধরল, আমি একদিকে।  চার-পাঁচ কিলোমিটার হবে, বা এর বেশি হবে রাস্তা। আমরা পায়ে হেঁটে চলে গেলাম। জয়পাড়ায় মজিদ দারোগার বাড়িতে। ওইখানে গিয়ে তাদের বাড়িতে ওটা রাখলাম।

ওই সময়ে মহিবুর রহমানও পৌঁছে যান সেই এলাকায়। কিন্তু দারোগা বাড়ির অবস্থান থানার কাছাকাছি হওয়ায় সেখান থেকে ট্রাঙ্কটি সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা। তখন ওখান থেকে চর কুসাই নামে একটা গ্রাম আছে।  ওইখানে দুজনের বাড়ি আছে, হাজি দানেশ ও উমেদ খাঁ- দুই ভাই। ওই বাড়িতে উমেদ খাঁর ধানের গোলার ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয় ট্রাঙ্ক।

ধানের গোলায় মাসখানেক রাখার মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ট্রাঙ্কটি ভারতে নিয়ে যান মহিবুর রহমান। বিজয়ের পরপরই দেশে ফিরিয়ে আনা হয় সেই ভিডিও ফুটেজগুলো। সাদাকালো ওই ভিডিও ভাষণ ২০১৬ সালে রঙিন সংস্করণে রূপান্তরিত করা হয়।

ক্যামেরাম্যান হিসাবে ১৯৭৪ সালে পদোন্নতি পেলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আবার বিপদ নেমে আসার কথা জানান আমজাদ। ১৯৭৯ সালে তাকে চক্রান্ত করে ফিফথ গ্রেড থেকে ক্লাস থ্রিতে’ নামানো হয়।

‘তখন আমি আর জয়েন করলাম না। ছুটি নিয়ে রইলাম নয় মাস। ...এরপর টেলিভিশনে জয়েন করলাম।  সেখানে গিয়ে ২৬ মাস বেতন পাইলাম না।”

আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা জানতাম, ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু, তবুও ঝুঁকিটা নিয়েছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুকে আমরা ভালোবাসতাম।’