বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন

যেভাবে স্বাধীনতার ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু

শোষন-বঞ্চনার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা বাঙালি ১৯৭১ সালের মার্চের শুরু থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিলো ঢাকার রাজপথ। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের অগ্নিঝরা ভাষণের পর পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে আরও অগ্নিগর্ভ।

ওই সময়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক থেকে বঙ্গবন্ধুর যে নির্দেশ যেত বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশ মেনে চলতেন অক্ষরে অক্ষরে। অফিস-আদালত, ব্যাংক-বিমা, স্কুল-কলেজ, গাড়ি, শিল্প-কারখানা সবই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনেছে। ইয়াহিয়ার সব নির্দেশ অমান্য করে অসহযোগ আন্দোলনে বাংলার মানুষের সেই অভূতপূর্ব সাড়া ইতিহাসে বিরল ঘটনা। মূলত ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুই রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তখন তুমুল অসহযোগ আন্দোলন। এই পরিস্থিতিতে ঢাকায় এলেন সে সময়ের পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। ১৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক। মার্চের ২৪ তারিখ পর্যন্ত আলোচনায় কোনো সমাধান হলো না। পঁচিশে মার্চ রাতে ঢাকায় শুরু হলো সামরিক অভিযান। এর আগেই ইয়াহিয়া খান সেদিনই ঢাকা ত্যাগ করেন। আলোচনার মাধ্যমে সময়ক্ষেপণের উদ্দেশ্য ছিলো জাহাজে করে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও সৈন্য আনা।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে আক্রমণ চালায় ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে এবং পিলখানায় তৎকালীন সীমান্ত রক্ষী বাহিনী ইপিআর-এর সদর দপ্তরে। পাকিস্তানি বাহিনী ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শুরু করে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পরিচালিত বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করার অভিযান। ওই রাতে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রেপ্তার করে শেখ মুজিবুর রহমানকে।

শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আটক হওয়ার  আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। সেই ঘোষণা তিনি দেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকেই।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তাদের সম্প্রচার শুরু করে ২৬ মার্চ। তৎকালীন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বেতারের চট্টগ্রামের কয়েকজন কর্মী শহর থেকে অনেকটা দূরে নিরাপদ জায়গা হিসাবে কালুরঘাটে বেতারেরই ছোট্ট একটি কেন্দ্রে তাদের প্রথম অনুষ্ঠান করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানেই স্বাধীনতার সেই ঘোষণা প্রথম সম্প্রচার করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন রাজনীতিকদের মধ্যে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান। বেতার কর্মীরা নিজেদের ভয়েসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তার অনুবাদ যেটা লিফলেট আকারে পেয়েছিলো, সেটা বিভিন্ন কণ্ঠে বারবার প্রচার করে ২৬ মার্চ প্রথম ট্রান্সমিশানের এক ঘণ্টার মতো অনুষ্ঠানে।

কালুরঘাট কেন্দ্র থেকে ২৭ মার্চ সন্ধ্যাতেও দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠান সম্প্রচারে সক্ষম হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। সে দিনের অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন জিয়াউর রহমান। সে সময় তিনি সেনাবাহিনীতে মেজর পদমর্যাদায় কর্মরত ছিলেন। জিয়াউর রহমান ওই ঘোষণা পাঠ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নামে।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা এবং তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি তখন বিশ্ব মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। ওই সময়ে বিবিসির খবরে তখন বলা হয়, ‘...কলকাতা থেকে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানের খবরে প্রকাশ যে পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এক গুপ্ত বেতার থেকে জনসাধারণের কাছে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছেন।...’

ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়: ‘...ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। মুজিবুর রহমান একটি বার্তা পাঠিয়েছেন এবং সারা বিশ্বের নিকট সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন।...’

দিল্লির দ্য স্টেটসম্যান-এর খবর ছিল: ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, সামরিক অভিযানের প্রতিবাদে রহমানের পদক্ষেপ। একটি গোপন বেতার থেকে প্রচারিত ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের পূর্বাংশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে নতুন নামকরণ করেছেন।’

দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, লন্ডন: ২৭ মার্চের পত্রিকায় ‘সিভিল ওয়ার ফ্লেয়ারস ইন ইস্ট পাকিস্তান: শেখ এ ট্রেইটর, সেইস প্রেসিডেন্ট’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা ও ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলার কথা উল্লেখ করা হয়।

ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় ২৭ মার্চের এক খবরে বলা হয়, ‘...২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে ভাষণ দেয়ার পরপরই দ্য ভয়েস অব বাংলাদেশ নামে একটি গোপন বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। তার এই ঘোষণা অপর এক ব্যক্তি পাঠ করেন।’

এর বাইরে ভারতের বহু সংবাদপত্র এবং আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ক্যানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাপান, হংকং, নরওয়ে, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশের খবরে স্থান পায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার খবর।

আর্জেন্টিনার বুয়েনস আয়ারস হেরাল্ডের ২৭ মার্চের সংখ্যার একটি খবরের শিরোনাম ছিলো, ‘বেঙ্গলি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডিক্লেয়ার্ড বাই মুজিব।’

নিউইয়র্ক টাইমসে শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার ছবি ছাপানো হয়। পাশেই লেখা হয় ‘স্বাধীনতা ঘোষণার পরই শেখ মুজিব আটক।’

বার্তা সংস্থা এপির খবর ছিল: ‘ইয়াহিয়া খান পুনরায় মার্শাল ল দেওয়ার ও আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে।’

আয়ারল্যান্ডের দ্য আইরিশ টাইমস-এর শিরোনাম ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা।’ আর সাথে ছিল শেখ মুজিবের ছবি।

ব্যাংকক পোস্ট-এর খবরে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।’