ফাগুনের মলাট

বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে নীরা লাহিড়ীর তৃতীয় উপন্যাস ‘যুদ্ধ’

বাঙালির সংগ্রাম, আত্নত্যাগ, দিনযাপন, প্রেম-বিরহ, বেঁচে থাকা বাংলা সাহিত্যের মূল উপজীব্য। কোথাও যেন মিস লিংক থেকে গেছে। মূল বিষয়  হারিয়ে গেছে। ঢাকা পড়ে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ গৌরবের কাহিনি। যার যে দায়িত্ব ছিল তা পালন করতে পেরেছি কি?-  এ প্রশ্নের মুখোমুখি আমাদের দাঁড়াতে হয়। নিজস্ব ক্ষুদ্র  স্বার্থ, দেখার মনোভাব, স্বীকৃতি প্রদানের ব্যর্থতা সব মিলিয়ে আমরা এক অন্ধকারের কাছে সমর্পিত। লেখকের কাজ সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা। দায়বদ্ধতা থেকে সত্য উচ্চারণ করা। নীরা লাহিড়ী পেশায় ডাক্তার। তার অস্তিত্বজুড়ে রয়েছে সমাজবীক্ষণ। ডাক্তারি, গ্রাজুয়েশনের পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম নারী রেডিওলজিষ্ট হয়েও তার প্রধান প্রেম সাহিত্য। সাহিত্যে অনেক বিষয়  উপেক্ষিত হয়েছে। ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস সেভাবে লিখিত হয়নি। নীরা এগিয়ে এসেছেন। ব্রিটিশ পূররবতী ও পরবর্তী শোষণ-শাসন, বিদ্রোহ, বিজয়ের কাহিনি তার উপন্যাসের ভিত্তিভূমি। স্মৃতি  ও মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে তার পথচলা। অভিজ্ঞতা, অভিমান, দিনযাপন, ও রক্তাক্ত হওয়ার যন্ত্রণা নীরা ধারণ করেন।

স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। সংবেদী মন। ভাষাকুশল কথাগদ্য। লেখক নীরা লাহিড়ীর ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসের আখ্যান শুরু হয়েছে ছন্নছাড়া জীবন, হতাশা, অভাব, ব্যর্থ প্রেম, অর্থহীন যৌনতা, আবদ্ধ জীবনের আঙ্গিক দিয়ে। জীবিকাহীনতা, বিবিধ অসহায়তা, মর্মবেদনা, মিডিআর শঠতা- সব দোষপঙ্ক, কুটিলতা, নিস্পৃহতা নিয়েই এই শহর কেমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছে সবাইকে। এখানে নাগরিক মাত্রেই লাঞ্ছিত।  বিশেষতঃআক্রান্ত নারী, অপচয়িত নারীত্ব। তবু জীবনকে নতুন করে দেখার নাম স্পর্ধা। এ আস্পর্ধাই উপন্যাসটির ঐশ্বর্য।

কবিতা আর চিত্রভাষা থেকে নর-নারীর বন্ধুত্বের শুরু। ভালোবাসা চিরন্তন অনুভব। অনাদিকালের হৃদয়-উৎস। অবিবর্ণ কোনো বোধ- প্রেম। জীবনযাপন থেকে কবিতাযাপন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া যেন। প্রণয়ের প্রেক্ষিতে আত্মকে আবিষ্কার করা। জীবন নামক কেন্দ্রের মূল উৎসগুলোয় ফেরা। ক্রাইসিসগুলো চিনে নিতে নিতে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা। মধ্যবিত্ততা, মধ্যচিত্ততা, মানব সম্পর্কের গূঢ় অতলস্পর্শী তরঙ্গ উদ্বেল। ততে একাকার সুপ্তি, দুঃখসুখ। আবর্তিত বিরহমিলন, আবেগবর্ষার মুষলধার বর্ষণ। অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে নীরা লাহিড়ীর তৃতীয় উপন্যাস যুদ্ধ।

এটি প্রকাশ করেছে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ। উপন্যাসে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঘটনাবলী, বিদ্রোহ, মানুষের মনস্তত্ব উঠে এসেছে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের বিবর্তন, জীবন, সম্প্রদায়ের অবস্থান, অর্থনীতি নিয়ে যুদ্ধের কাহিনি। রাজনীতির পালাবদল, মনন্তর কীভাবে কজন মানুষকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয় নীরা খুব মনোযোগের সাথে দেখেছেন।

দেশ ভাগের পর  দিনাজপুরে আশ্রিত বিহারী, হিন্দু আর মাড়োয়ারীদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম বিধৃত হয়েছে। বাহানুদ্দিন ক্ষেত-চাষি ও রেলওয়ের চাকুরে কোনভাবে তার দিন কাটে। বিহারী সম্প্রদায়ের  সাথে  বাঙ্গালীদের আরেক লড়াই তখন শুরু হয়েছে। মুজিবুল্লাহ মানবিক। এদের সংখ্যা নগন্য। ৭১’ এর মুক্তি যুদ্ধে জামিল অংশগ্রহণ করে। কন্যা সালেহা ধর্ষিত হওয়ার পর তার ক্ষোভ, আহাজারি বাতাস ভারী করে। সৈয়দপুর বাংলাদেশের এক অনন্য স্থান সেখানে রাজাকার, বিহারি  ও বাঙ্গালীদের জীবনের যুদ্ধ সাধারণ মানুষ কম জানে। নীরা এক গুরুত্বপূর্ণ  জনপথের ভাঙাগড়ার কথা বলেছেন।

‘যুদ্ধ’ উপন্যাসের আখ্যানকৌশল জটিল, এতে বহুমাত্রিক চরিত্রের মানুষজন। সাহিত্যিকের নিজস্ব মানসভূমির নির্ভীকতা, ভাঙচুর আর নীরিক্ষা উপন্যাসে স্পষ্ট। লেখক রাজনীতিকে বড় গভীরভাবে দেখেছেন। বারবার দেখিয়েছেন উপমহাদেশে আগুন জ্বলছে- তবু দিনদিন ধারালো হচ্ছে মানুষ। তবু বলতেই হয়, অপসংস্কৃতির প্লাবনপঙ্কে সুস্বর কোথায়? কেবল অন্ধকার। আসমুদ্রহিমাচল বিপন্নতা। চেনা অক্ষরগুলোকে ভরসা করে ইতিহাসের বয়েস বেড়ে চলে। ইতিবৃত্ত লেখা হয় যে ভাষায়, তার নিজস্ব একটা রূপরীতি, কাঠামো এবং গতি আছে। নিজের অজান্তে লেখক সেগুলির কাছে আত্মসমর্পণ করেন। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন, “নক্ষত্রও এক দিন ঘুমিয়ে পড়ে, শুধু জেগে থাকে সহিষ্ণু মানুষ”। 

বাঙালিকে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে আর্থ- সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করতে হয়। সামরিক-স্বৈরশাসনের যাতাকলে নিষ্পেষিত জনগণ গণতন্ত্রের বন্দীদশায় এক নিদারুণ সময় কাটায়। গণতন্ত্র রচনার কারিগরদের নীরা আবিষ্কার করেছেন। ধর্মান্ধতা-বিরোধিতার তুমুল সৈনিক নীরা লাহিড়ী জেগে আছেন। তাঁর জয় হোক।

বইটি প্রকাশ করেছে জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ। প্রচ্ছদ এঁকেছেন চারু পিন্টু। মূল্য: ৬০০ টাকা