সালতামামি ২০১৬

দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছেন হাসি ও খুশি

জেলা প্রতিবেদকপাবনা, ৮ মার্চ : শতাধিক নারীর মনে সুখ এনে দিয়েছেন দুই বোন হাসি ও খুশি। তারা আত্মনির্ভরশীলতার দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছেন।

‘পরচুলা’ তৈরির মতো ব্যতিক্রমী একটি কারখানা প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপন করে তারা যেমন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন, তেমনি দরিদ্র শতাধিক নারীকে আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করেছেন।  

এই কারখানায় কাজ করে এলাকার দরিদ্র নারীদের জীবনে এসেছে খানিকটা দম ফেলার সুযোগ। কারখানার নারী কর্মীরা জানান, পরচুলা তৈরি করে তারা রোজগার করতে পারছেন। আর এতে ঘুচে গেছে তাদের দারিদ্র্য।

পাবনার চাটমোহরের হরিপুর ইউনিয়নের নিভৃত পল্লি মস্তালীপুর। এই গ্রামের মেয়ে তাজনাহার হাসি ও আরজিনা আক্তার খুশি। তারা গড়ে তুলেছেন ‘পরচুলা’ তৈরির কারখানা।

সম্প্রতি ওই গ্রাম সরেজমিন পরিদর্শন করে জানা গেছে, তাজনাহার হাসি ও আরজিনা আক্তার খুশি ২০১০ সালের প্রথম দিকে কারখানাটি গড়ে তোলেন। প্রথমদিকে ১০-১৫ জন কর্মী নিয়ে কারখানা শুরু হলেও বর্তমানে শতাধিক নারী সেখানে কাজ করছেন।

আরজিনা আক্তার খুশি বলেন, ‘আমার স্বামী ঢাকায় পরচুলা তৈরির কাজ করতেন। তার সঙ্গে আমিও এ কাজ করতাম। কিছুদিন পর গ্রামে ফিরে এসে আমার ছোট বোন হাসিকে সঙ্গে নিয়ে এই কারখানা গড়ে তুলেছি বাড়ির আঙিনায়।’

পরচুলা তৈরির পদ্ধতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রথমে ঢাকায় পরচুলা বিক্রেতাদের কাছ থেকে প্রতি কেজি তিন হাজার টাকায় চুল কিনে নিয়ে আসা হয়। সেই চুল ব্লিচিং, শ্যাম্পু, গ্লিসারিন, কন্ডিশনার দিয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। তারপর  চুল বান্ডিল করা হয়। এরপর নেটের ক্যাপে সুচ দিয়ে চুল বুনিয়ে পরচুলা তৈরি করা হয়।

খুশির স্বামী আল আমিন বলেন, ‘হেয়ার ফ্যাশনের তৈরি পরচুলা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহের পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান ও বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। শিগগিরই তা রপ্তানি করা হবে সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে।’

আয়-ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাইলে আল আমিন জানান, শ্রমিকদের মজুরিসহ প্রতিটি পরচুলা তৈরিতে খরচ হয় এক হাজার ৫০০ টাকা। একটি পরচুলা তৈরিতে সময় লাগে তিন থেকে চার দিন। প্রতিটি পরচুলা তৈরি করে মেয়েরা পায় ৩৫০ টাকা। ঢাকায় প্রতিটি পরচুলা পাইকারি বিক্রি হয় এক হাজার ৭০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকায়।

কারখানার কর্মী চাটমোহর ডিগ্রি কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রাবেয়া পারভীন বলেন, ‘অবসর সময়ে এই কারখানায় কাজ করি। পড়াশোনার পাশাপাশি রোজগার হচ্ছে। যেটা দিয়ে নিজের এবং সংসারের চাহিদা পূরণে কিছুটা সহায়ক হচ্ছে।’

কলেজছাত্রী কারিমা খাতুন ও পারভিন সুলতানাও জানালেন একই কথা। মস্তালীপুর গ্রামের ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী খালেদা খাতুন বলেন, ‘এখানে কাজ করে মাসে তিন হাজার টাকা করে আয় করছি। এই টাকা দিয়ে অভাবের সংসারে কিছুটা সহযোগিতা করতে পারছি।’

একই গ্রামের নওশাদ আলীর স্ত্রী আজমিরা খাতুন, রামপুর গ্রামের আলমগীর হোসেনের স্ত্রী মিনারা খাতুন, চড়ইকোল গ্রামের খোরশেদ আলমের স্ত্রী হাসিনা খাতুন জানান, ‘কারখানায় কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছি। অসুখ-বিসুখে চিকিৎসা করাতে পারছি।’

মস্তালীপুর গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা লাভলী খাতুন বলেন, ‘এই কাজের মাঝে আমি বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন খুঁজে পেয়েছি।’

স্থানীয় সংবাদকর্মী ইশারত আলী বলেন, ‘দুই বোনের এই উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। এর মাধ্যমে এলাকার গরিব নারীরা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছেন। নারীদের অগ্রগতির জন্য আমি সবাইকে দুই বোনের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই।’

উদ্যোক্তা তাজনাহার হাসি বলেন, ‘গ্রামের অসহায়, দরিদ্র, দুস্থ নারীদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থেকেই এই কারখানা স্থাপন করেছি। জীবিকার সন্ধানে নারীরা বেরিয়ে আসছে। আগামী দিনে প্রতিষ্ঠানটি আরো বড় করার পরিকল্পনা আছে।’

এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বলেছেন, দুই বোনের এই কারখানা অনেকের জন্যই একটি দৃষ্টান্ত। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হোক আরো অনেক নারী-আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এটাই প্রত্যাশা।

 

রাইজিংবিডি/শাহীন রহমান/ফেরদৌসী/আবু মো./শাহনেওয়াজ