সারা বাংলা

লকডাউনে রোজগার বন্ধ, নিম্ন আয়ের মানুষের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ

খুলনা নগরীর দৌলতপুর রেল ক্রসিংয়ের পাশে ছোট একটি দোকানে সিঙ্গাড়া ও পুরি বিক্রি করতেন মিঠু মিয়া। সংসারের খাওয়া-পরা, ঘর ভাড়া, দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচসহ সবই চলতো তার এই দোকানের উপরে। তবে লকডাউন ঘোষণার পর থেকে দোকান খুলতে পারছেন না, তাই আয়-রোজগারও বন্ধ। এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে সংসার চালাতে। এত বেকায়দায় এর আগে কখনও পড়েননি তিনি।

শুধু মিঠু মিয়া নয়, লকডাউনের কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কাজকর্ম বন্ধ থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের সকল আয়ই বন্ধ হয়ে গেছে। ছোট খাটো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দিন মজুরেরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে। ফলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে চরম হতাশায় পড়েছেন তারা। ফলে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তাদের কপালে।

ইলেক্ট্রনিক ব্যবসায়ী রাজা মোল্লা বলেন, ‘জানুয়ারি মাসে ২ লাখ টাকা জামানত দিয়ে দোকান ভাড়া নিয়েছি। এছাড়া প্রতিমাসে ভাড়াবাবদ ৫ হাজার টাকা গুণতে হচ্ছে। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দোকান করেছি। একের পরে এক লকডাউনের কারণে দোকান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। মাস শেষে ভাড়ার টাকা দিতে আত্মীয় স্বজন, বন্ধুদের কাছে ধার নিতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, এখন কি করবো, ‘এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছি, কিস্তি দিতে হবে। টাকা কোথায় পাবো? চরম সংকটে পড়েছি।’

দৌলতপুর ভ্যান স্ট্যান্ডে কথা হয় ভ্যান চালক সাগর, পালাশ হোসেন ও আলমগীরের সঙ্গে। তারা বলেন, ‘লকডাউনের কারণে যাত্রী নেই। দিন শেষে চাল-ডাল কেনার টাকাও হচ্ছে না। ঘর ভাড়া, ছেলে-মেয়ে ও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। প্রথম দিকে বিত্তবানরা খাবার ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করলেও এখন তাও পাচ্ছি না। ফলে চরম বেকায়দায় আছি আমরা ভ্যান- রিকসা চালকেরা।

ইলেকট্রনিকের দোকানের কর্মচারি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘একের পরে এক লকডাউনে কারণে প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ফলে বেতন পাওয়া নিয়ে দুচিন্তায় আছি। এভাবে চললে মেস খরচ, খাওয়া- দাওয়া করে জীবন বাঁচানো কষ্টকার হয়ে যাবে।’

রূপসার রহিমনগর এলাকার ষাটোর্ধ নার্গিস বেগম জানান, ‘খুলনার বেলায়েতের ডকইয়ার্ডে কাজ করতেন তিনি। গত রমজানের লকডাউনের পর কাজ হারিয়েছেন। এখন খুব কষ্টে তার দিন কাটছে। একমাত্র সন্তান থাকে ঢাকায়। আর স্বামী অসুস্থ বৃদ্ধ আব্দুল মান্নান এখন কর্মক্ষম। বয়স্ক ভাতার সামান্য কিছু টাকা আর স্ত্রীর ডকইয়ার্ডের দৈনিক হাজিরায় চলছিলো তাদের সংসার। কাজ বন্ধ হয়ে পড়ায় তাকে ধরতে হয়েছে ভিক্ষার ঝুঁলি।’

আব্দুল মান্নান জানান, বয়সের কারণে নানা রোগে আক্রান্ত তিনি। একেতো আয়- রোজগার নেই অন্যদিকে ঘরভাড়া মাস গেলে ৮শ’ টাকা। গত তিন মাসের ভাড়া বাকি রয়েছে। নিরুপায় হয়ে লজ্জা ভেঙ্গে ভিক্ষার পথ বেছে নিয়েছেন। গত বছরের লকডাউনে ত্রাণ সহায়তা পেলেও এ বারে এখনো কোনো সাহায্য পায়নি তারা।

জুতা তৈরির কারিগর রহিমনগর কলোনির বাসিন্দা আসিফ মোল্লা জানান, লকডাউনে তার কাজ বন্ধ। পরিবারের পাঁচ সদস্যের মুখে খাবার তুলে দিতে হচ্ছে  ধার-দেনা করে। একই এলাকার বাদাম বিক্রেতা লালু মিয়ার ব্যবসাও বন্ধ। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষটি এখন রয়েছে চরম বিপাকের মধ্যে।

লালু মিয়া বলেন, ‘গত ১৫ দিন ব্যবসা বন্ধ, ঘরে কিছু নাই। আবার শুনছি আরো সাত দিনের লকডাউন দিছে। লকডাউন বাড়ালেও আমাদের দিকে কারো কোনো খেয়াল নেই। ’ আমরা কি না খেয়ে মরবো- প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি।

লালু মিয়ার মত এমন প্রশ্ন, এ এলাকার সকল দিনমজুর, নিম্ন আয়ের মানুষের। রামনগর-রহিমনগর এলাকার অনেকে খুবই দরিদ্র। লকডাউনের কারণে অধিকাংশই কর্মহীন। অনেকের ঘরে খাবার নেই। অনাহারে অর্ধাহারে দিন পার করেছেন তারা। লজ্জায় চাইতেও পারেন না কারো কাছে।

প্রসঙ্গত, গত ১ জুলাই থেকে চলমান লকডাউনের সময় আরও সাত দিন বাড়িয়েছে সরকার। লকডাউনের সময় যত বাড়ছে, ততই অর্থ ও খাদ্য সংকটে পড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষেরা। এমন অবস্থায় ত্রাণ সহায়তা তাদের হৃদয়ের নিশ্চুপ আকুতি।