বিশ্বের বিভিন্নস্থানে সমুদ্রগামী পণ্যবাহী জাহাজে কর্তব্যরত মেরিনাররা করোনাভাইরাসের টিকা নেওয়ার সুযোগ না পাওয়ার কারণে কর্মস্থলে যোগদান নিয়ে জটিলতায় পড়ছে। এ অবস্থায় জরুরী ভিত্তিতে তাদের টিকার ফ্রন্টলাইনার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
তারা বলেছেন, সময়মত কর্মস্থলে যোগ দিতে না পারলে তাদের চাকরি হারাতে হবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশিদের জায়গায় প্রতিযোগি দেশগুলো থেকে শূন্যপদে নিয়োগ দেওয়া হবে। এতে বাংলাদেশ মেরিনাররা চাকরি হারাবে, ফলে একদিকে বেকারের সংখ্যা বাড়বে পাশাপাশি বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হতে হবে।
এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ইউনিক্স লাইন নামের একটি জাহাজ কোম্পানিতে কর্মরত ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আতাউর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, আমি ১৯৮১ সালে ডেক ক্যাডেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করি। আমাদের অফিসার এবং অন্যান্য যাদের বয়স ৪০ বছরের কম তাদের অসুবিধা হচ্ছে। কারণ, সরকারের সুরক্ষা ওয়েব সাইটে নাবিকদের জন্য কোন কলাম নাই। যার জন্য তারা নিবন্ধন করতে পারছে না। অথচ কোভিড-১৯ এর বিশ্বের ৯০ ভাগ মালামাল আমরা নাবিকরা বহন করছি এবং বিশ্ব অর্থনীতির চাকা চালু রেখেছি। আই,এম,ও মেরিনারদের ‘কী ওয়ার্কার’ (Key worker) হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
তিনি বলেন, সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় আমাদের প্রতিযোগি দেশ যেমন- ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, ইন্ডিয়া, ক্রোয়েশিয়া ইত্যাদি বিশ্বের কোন কোম্পানিই কোভিড টিকা ছাড়া একসেপ্ট করছে না। তাতে আমাদের নাবিকরা যেমন চাকরি হারাবে, পাশাপাশি দেশ অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আয় থেকে বঞ্চিত হবে।
তিনি বলেন, মেরিনারদের জরুরিভিত্তিতে কোভিড টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। দুঃখজনক হলো সারা বিশ্ব মেরিনার্সদের ফ্রন্ট লাইনার এবং ‘কী ওয়ার্কার’ হিসেবে ঘোষণা দিলেও নিজ দেশে আমরা উপেক্ষিত। আজ আমেরিকায় আমাদের জাহাজ গেলে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সিমেন্স ক্লাব থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোভিড টিকা দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, এতদিন টিকার জন্য রেজিস্ট্রেশনের সর্বনিম্ন বয়স সীমা ৪০ বছর ছিল। সম্প্রতি তা ৩৫ বছর করা হলেও সমস্যা থেকেই যাবে। সমুদ্রগামী জাহাজে প্রাথমিক পর্যায়ে যারা যোগ দেন তাদের অনেকের বয়স ৩৫ এর নিচে। এ অবস্থায় মেরিনারদের বিশেষ কোটায় টিকা দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছি। বিষয়টি গুরুত্ব অনুধাবন করে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।
ক্যাপ্টেন আতাউর রহমান বলেন, পণ্যবাহী বিদেশি জাহাজে যোগদানের ক্ষেত্রে বর্তমানে কোভিড-১৯ এর টিকা দেওয়ার সার্টিফিকেট বাধ্যবাধকতা করেছে। কিন্তু টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন করতে প্রবাসী কর্মীদের জন্য অপশন থাকলেও মেরিনার্সদের জন্য কোন অপশন নেই। ফলে তারা টিকা নেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে অনেক মেরিনার কাজে যোগ দিতে পারছেন না। এছাড়াও ছুটিতে যারা দেশে ফিরবেন তারাও ছুটি শেষে চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় সমস্যায় পড়বেন।
তিনি জানান, বর্তমানে দেশে ১৩,৫০০ রেজিস্ট্রার্ড মেরিনার বিশ্বের বিভিন্ন সমুদ্রগামী জাহাজে কর্মরত। এদের মধ্যে ১১,০০০ অফিসার এবং ২,৫০০ অন্যান্য পদে নিয়োজিত। বাংলাদেশের নাবিকদের সুনাম রয়েছে বিশ্বজুড়ে। এছাড়া প্রতিবছর তারা গড়ে ২,১৫০ কোটি ডলার সমপরিমান রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। ফ্রন্টলাইনার হিসেবে দেশের অর্থনীতিতে এইসব নাবিকদের অবদান অব্যাহত রাখতে হলে তাদের সহজে টিকার আওতায় আনা জরুরী।
বিশিষ্ট লেখক, কলামিস্ট ও বাংলাদেশ মেরিন একাডেমির ২৭তম ব্যাচের ক্যাপ্টেন আতিকুল্লাহ খান রাইজিংবিডিকে বলেন, বয়স এবং ‘সুরক্ষা অ্যাপস’ এ প্রবাসী কর্মীদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য মেরিনারদের জন্য কোন অপশন না থাকায় টিকা নিতে সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হচ্ছে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মরত কর্মীদের চেয়ে একজন মেরিনার কয়েকগুণ বেশি বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন। ছুটিতে আসা অনেক মেরিনার টিকা নেওয়ার জন্য ঘুরছেন। তারা কোন ভাবে টিকা নিতে পারছেন না। ফলে তাদের চাকরি হুমকির মধ্যে পড়েছে। এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব ছুটিতে আসা মেরিনারদের চাকরি রক্ষার স্বার্থে ইন্টারন্যাশনাল মেরিনার্স অরগানইজেশনের ঘোষিত ‘কী ওয়ার্কার’ হিসেবে টিকা দেওয়ার পদ্ধতি সহজ করা হোক। এ বিষয়ে তিনি স্বাস্থ্য, নৌপরিবহন ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় দ্রুত এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বিদেশি কন্টেইনারবাহী সমুদ্রগামী জাহাজের ক্যাপ্টেন বলেন, যেকোনো দেশের অর্থনীতি সেদেশের আমদানি-রপ্তানির উপর অনেকাংশেই নির্ভর করে। আর এই আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে জড়িত আছেন মেরিনাররা। এছাড়া, মেরিনাররা দেশের রেমিট্যান্স এ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। অথচ তারা বরাবরই অবহেলিত। করোনাকালীন কোনো ধরনের মেরিনার বান্ধব উদ্যোগ আমরা দেখিনি। বর্তমানে, কোম্পানিগুলো কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনেটেড মেরিনার্স এর দিকে ঝুঁকছে। ফলে, গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরে আমরা অন্যান্য দেশের মেরিনারদের সঙ্গে তাল মিলাতে না পারলে বাজার হারানোর একটা সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আশা করবো, কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হবে এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে মেরিনারদের কী-ওয়ার্কার বিবেচনায় টিকার আওতাভূক্ত করা হবে।
এমডি আল মামুন নামের একজন মেরিনার বলেন, বিশ্বে আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে ৯০ শতাংশের বেশি পণ্য পরিবহন হয় সমুদ্রপথে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বছর শেষে রেমিটেন্সের বিরাট একটা অংশ যোগ হয় মেরিনারদের হাত দিয়ে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রতিবছর রেমিট্যান্স যোদ্ধা মেরিনাররা যোগান দিচ্ছে কমপক্ষে ৪০০ মিলিয়ন ডলার। ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের প্রস্তাবে নাবিকদের ‘কী ওয়ার্কার’ হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকার সেই ঘোষণায় সাক্ষর করেছে। এমন পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্স যোদ্ধা ‘ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার’ মেরিনাররা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে টিকা পাবে না, তা মেনে নেওয়া যায় না। এবিষয়ে জাতীয় স্বার্থে তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি।