সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছাদে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন সবুজ। সেখানে গেলেই দূর হয়ে যায় সব ক্লান্তি। তৃপ্তিতে ভরে ওঠে তার চোখমুখ। ছাদজুড়েই তার বনসাই’র ছড়াছড়ি।
মাত্র ১শ টাকা নিয়ে শুরু করা তার বনসাই এখন কোটি টাকার সম্পদ। ২৫ বছরের সাধনার ধন, ছাদে প্রতিটি পরতে পরতে বনসাইয়ের নান্দনিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হওয়ার উপায় নেই।
বলছিলাম মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার চর পাথালিয়া গ্রামের সরকারি চাকরিজীবী কেএম সবুজের কথা। পুরো নাম খান মুহাম্মদ সবুজ। থাকেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের আমবাগ পশ্চিমপাড়া এলাকায়। সেখানেই আড়াই বিঘা জমিত ও দুটি বাসার ছাদে তার স্বপ্নের বনসাইয়ের বাগান। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে বনসাই তৈরি করছেন।
সময়টা ১৯৯৬ সাল, সবুজ সিলেটে ঘুরতে গিয়ে এক নার্সারিতে একটি বনসাই দেখেন। তখনো তিনি বনসাই সম্পর্কে কিছুই জানেন না। বৃক্ষপ্রেমি হওয়ার মনের শখে ১শ টাকা দিয়ে ৪টি তেঁতুল গাছের চারা কিনে শুরু করেন বনসাই চাষ। এখন তার সংগ্রহে প্রায় ২০ হাজার বিভিন্ন প্রজাতির বনসাই রয়েছে। যেখানে এক হাজার থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকা দামের ১ কোটি টাকারও বেশি বনসাই আছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগ্রহী যুবকরা বনসাই সংগ্রহের পাশাপাশি বেকারত্ব ঘোচাতে নিচ্ছেন নানা প্রশিক্ষণ। এ বনসাই শিল্প সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে অনেক বেকারের কর্মসংস্থান ও মোটা অংকের বৈদেশিক মূদ্রা অর্জন হবে বলে জানান সবুজ।
বর্তমানে তার কাজে স্ত্রী, মা, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই সহযোগিতা করেন। দিন দিন বাড়ির ছাদ ছাড়াও জমিতে বনসাই বাগান সম্প্রসারিত করা হয়েছে। বাগানে কাজ করছেন ১২ জন শ্রমিক। বেশ কয়েকটি একক বনসাই প্রদর্শনীতে তার বনসাই আলোচিত হয়। ইতোমধ্যে পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী পদক।
সবুজ ২০০৭ সালে তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রখ্যাত বনসাই শিল্পী নাজমুল হাসানের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে চীনে এবং ২০১৮ সালে মালেয়শিয়া ও সিঙ্গাপুরে বনসাইয়ের ওপর প্রশিক্ষণ নেন।
সবুজ প্রতি বছর অন্তত ২০ লাখ টাকার বনসাই ভারত ও মালয়েশিয়ায় রপ্তানি করেন। তিনি বলেন, তার রপ্তানি করা বনসাই গাছ ক্রেতারা প্রথমে তার কাছ থেকে নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়ে যান। সেখানে বনসাইগুলো জাহাজে নারকেলের ছোবড়া দিয়ে স্কচটেপে বিশেষভাবে মুড়িয়ে টবে রাখা হয়। পরে গাছগুলো জাহাজ থেকে নামিয়ে হরমোন দিয়ে ফের টবে রাখা হয়। এই প্রক্রিয়ায় সেখানে বনসাই থেকে নতুন পাতা গজায়।
সবুজের সফলতার পেছনে রয়েছে অনেক অজানা ঘটনা। এই বনসাইয়ের জন্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তিনি। সবসময় গাছ নিয়ে পড়ে থাকায় আত্মীয়, পাড়াপ্রতিবেশি সবাই গাছা সবুজ বলে ডাকতো। এভাবেই চলতে থাকে ১২-১৩ বছর। পরিবারের সদস্যরা সবুজের প্রতি অতিষ্ঠ হয়ে যান। ঠিক সে সময়টাতে একটা বনসাই ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি করে বদলে যায় তার ভাগ্যের চাকা। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পরিবারের কাছে আবার ফিরে যান। তাদের কাছে বেড়ে যায় সবুজের কদরও। বড় পরিসরে নতুনভাবে শুরু করেন বনসাই উৎপাদন। এরই মধ্যে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে ফেলেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ঢাকা, মালয়েশিয়া রেডিয়েন্ট, ভারতের সার্ক কালচার ও চীনের ঘুঞ্জু লায়ান ডিস্ট্রিক নার্সারি এবং সিঙ্গাপুরের চায়না গার্ডেন থেকে।
পারিবারিক জীবনে কেএম সবুজের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে কেএম ওয়াসিফ নূর (৮) এ বয়সেই বাবার মতো বনসাই পরিচর্যায় বেশ পটু। সবুজদের যৌথ পরিবারে স্ত্রীসহ এখন সবাই বনসাই প্রেমি।
কেএম সবুজ বলেন, শখের বশে বনসাই করা শুরু হলেও এখন প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ টাকার বনসাই বিক্রি করি। বাণিজ্যিকভাবে বনসাই বিক্রি করে ভালো আয় হচ্ছে তার। তার বনসাই বাগানে ৪৫০ প্রজাতির ২০ হাজারের বেশি বনসাই রয়েছে। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও মানুষদের লক্ষাধিক বনসাই উপহার হিসাবে দিয়েছেন।
সবুজ বলেন, ছোট আকৃতি হওয়ায় বনসাই বাসা-বাড়ির যেকোন জায়গায় মানানসই। সবুজের কাছে থেকে সময় কাটানোর আগ্রহ থেকেই কর্পোরেট হাইজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কদর বেড়েছে বনসাই। তবে বাড়িতে আগ্রহী যে কেউ নিজেই এই শৈল্পিক বনসাই তৈরি করতে পারবে। এ জন্য কিছু নিয়ম ও কলাকৌশল জানতে হবে। আর এসব কলাকৌশল রপ্ত ও প্রশিক্ষণ নিয়ে বনসাই তৈরির জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসছেন তরুণ ও উদ্যোক্তারা। দেশে যুব মন্ত্রণালয়ের আওতায় কৃষি প্রশিক্ষণের সঙ্গে বনসাই জুড়ে দিলে দেশে অনেক বেকার যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
তিনি আরও বলেন, সম্পূর্ণ বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই দেশে চলছে বনসাই শিল্প। তবে ক্রমবর্ধমান চাহিদা থাকায় বনসাইয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই বনসাই শিল্পী। ইউরোপেও বনসাইয়ের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বনসাই রপ্তানিতে সরকারি সহায়তা পেলে এ শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে একটা গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করবে।