ভ্রমণ

দুর্গতিনাশিনীর মন্দিরে

বিশ্বের সাত আশ্চর্যের মধ্যে ভারতের তাজমহলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার নাম এসেই পড়েছিল, কিন্তু নিজস্ব খ্যাতির কারণে বেশি ভোট পেয়ে এগিয়ে গিয়ে তাজমহল সপ্তম আশ্চর্যে জায়গা করে নেয়। কি সেই আশ্চর্য যার তুলনা তাজমহলের কাছাকাছি!

সেটি হলো দুর্গতিনাশিনীর মন্দির; ভারতের মাদুরাই-এর মীনাক্ষী মন্দির। দক্ষিণ ভারতের অনিন্দ্য সুন্দর এই মন্দির নিজ ঐশ্বর্যে, রূপে যে কারো মনে স্থান করে নেবে; আমি তো ছবি দেখে দেখেই মুগ্ধ!

দক্ষিণ ভারতের প্রায় সব মন্দিরই মীনাক্ষী মন্দিরের কাছ থেকে স্থাপত্যশিল্প ধার করে তবেই পূর্ণতা পেয়েছে। ব্যাঙ্গালুরু শহরে বাস করার কারণে আমার এই মহালয়ার সকালে উড়ে মাদুরাই যাবার ইচ্ছেটা প্রকট হয়ে উঠল। যদিও দক্ষিণ ভারতে শরৎ কালে শিউলি বা কাশফুলের দেখা মেলে না, তবুও এই পুজোর সময় ঢাকের বাদ্যি আর দক্ষিণি সানাই-এর সঙ্গে মন্দিরের শোভাযাত্রা দেখলে দশেরার ছুটি সার্থক হবে। দক্ষিণ ভারতে দুর্গাপূজা তেমন বড় কোনো উৎসব নয়, দীপাবলি আর গনেশ পূজা বড় উৎসব। আর এখানে দুর্গাপূজাকে বলে ‘দশেরা’ বা ‘দাসেরা’।

মীনাক্ষী মন্দিরের ভেতরে লেখক

মাদুরাই এসেছি মহালয়ার পরদিন। মীনাক্ষী মন্দিরের খুব কাছে হোটেল হবার কারণে পায়ে হেঁটেই চলে যাওয়া যায় মন্দিরে। পথে কত জায়গা থেকে আগত ভক্ত! দক্ষিণ ভারতে তিরুপতির পর মীনাক্ষী মন্দিরে সবচেয়ে বেশি ভক্তরা ভিড় করেন পূন্য লাভের আশায়, আর বিদেশি ট্যুরিস্ট দক্ষিণ ভারত বলতে তো চেনেন মীনাক্ষী মন্দির আর কেরালার ব্যাক ওয়াটার।

সকাল সকাল কাঁধে স্কুল ব্যাগ নিয়ে, স্কুল ইউনিফর্ম পরে মাথার বেণীতে ফুলের গাজরা বা মালা দুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে আমাদের স্থানীয় মা দুর্গারা। দক্ষিণ ভারতে আসার পর আমার যে ব্যাপারটা খুব ভালো লাগে তা হলো- যে কোনো মেয়েই মাথায় ফুলের মালা পরে; সে যে ধর্ম বা জাতের হোক না কেন। কি পবিত্র একটা নিয়ম! ফুলের কাছাকাছি থাকা, সুগন্ধ মেখে রাখা।

পথের দু’পাশজুড়ে দোকানের অভাব নেই। কাঞ্জিভরম শাড়ি, স্বর্ণের গয়না, ইমিটিশনের গয়না, রেডিমেড কাপড়, জুতা স্যান্ডেল, খেলনা, মিষ্টি, নিমকি, পুজো দেয়ার সামগ্রী, প্রসাধনী থেকে শুরু করে হাঁড়িপাতিল, দা বটি, চাদর, ফ্লোর ম্যাট সবই পাওয়া যাচ্ছে মন্দিরের বাইরের এই বাজারে৷ একপাশে ভাজা হচ্ছে পুরি, জিলিপি তো অন্য পাশে বেশ আয়োজন করে পথেই ছোট দোকানে ভাজা হচ্ছে হরেক দক্ষিণি নিমকি। কত রাজ্য থেকে যে লোক এসেছে মীনের মতো সুন্দর যার চোখ তাকে দেখতে। কেউ মারাঠি ধাঁচে শাড়ি পরে জানান দিচ্ছেন বা কেউ রঙিন মারোয়ারী। কেউ তামিল আইয়ার অথবা কেউ কর্ণাটকের গৌড়া।

বেণীতে ফুলের গাজরা বা মালা দুলিয়ে স্কুলে যাচ্ছে স্থানীয় মা দুর্গারা

দোকানে রঙের পশরা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম মন্দিরের সদর দরজায়। জুতো খুলে রেখে যেতে হবে বাইরে। মন্দিরের সিস্টেম ভালো, টোকেন দিয়ে দেয় জুতোর জন্য। লাগোয়া নৈবিদ্যর দোকান। একটা থালায় আস্ত নারকেল, পাকাকলা, পান, কাচের চুড়ি, গোলাপজল। এরা দেবতার দুয়ারে যাবে। আমার কোথাও কিছু দেবার বা নেবার তাড়া নেই। উপরওয়ালা যা দেন তাতেই খুশী, বাড়তি চাহিদার কথা মনেই আসে না। 

দুর্গা মায়ের পিতৃগৃহে যাবার কালে কত না আড়ম্বে ভরে থাকে সময়। এ মন্দিরে মীনাক্ষী বা পার্বতী আর তাঁর স্বামী শিবের পূজা হয়। সাধারণত দেব-দেবী একত্রে থাকলে দেবতাকেই মূল আরাধ্য করে মন্দিরের নামকরণ হয়। কিন্তু এখানে মীনাক্ষী বা দুর্গা দেবীকে কেন্দ্র করে মন্দিরের নামকরণ করেছিলেন প্রতিষ্ঠাতা রাজা কূলশেখর পানডেয়া ১১৯০ সালে। আর নামকরণ তখন এভাবে করা হয়েছিল ‘মীনাক্ষী সুন্দরেশ্বর মন্দির’। মানে প্রথমে দুর্গা দেবী তারপর শিব ঠাকুর।

দুর্গা বাবার বাড়ি যাচ্ছেন সন্তানদের নিয়ে, শিব তাঁর যাবার পথে চেয়ে আছেন। শরৎ-সকালে এমন দৃশ্য মনে এলে কোথা থেকে যেন একটা মিষ্টি সুবাস বয়ে যায়। মন্দিরের মূল আকর্ষণ চারদিকে প্রাচীর লাগোয়া তোরনের মতো ১৪টি সুউচ্চ গোপুরাম। গোপুরাম হলো তোরণ বা প্রবেশদ্বার। একেকটি তোরণ ৪৫ থেকে ৫২ মিটার অবধি উঁচু। মন্দিরের মূল তোরণ হলো দক্ষিণ তোরণ, যেখান দিয়ে সবাইকে প্রবেশ করতে হয়, এই গোপুরামে ৯টি তলা আছে। মন্দিরে প্রবেশের আগেই গোপুরামের শিল্পের অনবদ্য কারুকাজ দেখে মনে হলো আমি আর এ ধরণীতে নেই, ইন্দ্রপুরী চলে এসেছি।

একুশ কেজি স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে এই পদ্মফুলে

উপরের দিকে পিরামিড আকৃতির একেকটা গোপুরামের গায়ে খোদাই করা মহাভারতের বিভিন্ন ঘটনা। নিচ থেকে দেখলে মনে হবে ছোট ছোট পুতুল সারি সারি আর উপর নিচে থাকে থাকে দাঁড়িয়ে গল্প বলে যাচ্ছে। এই গোপুরাম নাকি প্রায় ৪ হাজার ঘটনা আর গল্পের সুতো বুনে দিয়েছে। রঙিন সব গল্প। কোথাও দুর্গতিনাশিনী রাবণকে বধ করার উদ্দেশ্যে ত্রিশূল তুলেছেন, কোথাও মুনি ঋষি কথা বলছেন জনসাধারণের সঙ্গে, কোথাও বা বিবাহ হচ্ছে শিব আর পার্বতীর, কোথাও গনেশ ঠাকুর শান্ত বসে। সব দেখতে যেন আসল, তাদের গায়ে সেরকম রঙ করা। রঙিন মহাভারতের আশ্চর্য জগৎ। এ এক পরম বিস্ময় আমার মনের আকাশে!

মন বলছে ঝাঁপিয়ে পড়ি এই পুরাণ সমুদ্রে, চলে যাই মহাভারতের রাজ্যে, খুঁজে নেই নিজস্ব কোনো কল্পতরু। যেখানে রাতের সঙ্গে দিন বেঁধে দেয় অচেনা পথ, যেখানে নেই ভেদাভেদ, যেখানে সবাই আপন।

এসব ভাবতে ভাবতে প্রবেশ করলাম মূল মন্দির প্রাঙ্গণে। দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন মন্দিরের সব মহিমা আঁকা আছে এ মন্দিরে। প্রবেশের পর মন্দির প্রাঙ্গণে একটি পুকুর বা পুস্করিণী। পুস্করিণীর ঠিক মাঝখানে বিশাল এক পদ্মফুল ফুটে আছে। না আসল নয়, স্বর্ণের তৈরী। মোট একুশ কেজি স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়েছে এই পদ্মফুলে। সবুজ জলে ছায়া ফেলছে, ছায়া দুলছে আর গাইছে মঙ্গলাম।

মন্দিরের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কৃত্রিম আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে

পুকুরের চারপাশের ঘাট বাঁধাই করা, সিঁড়ি আছে। আর চারদিকেই চওড়া বারান্দা, রোদ পড়লে বারান্দার ছাউনিতে বসা যায়। মূল মন্দিরে প্রবেশের আগে অনেক দেব-দেবীর দর্শন করে তবেই মূল মন্দিরে যাওয়া যায়। মেঝেতে আল্পনা আঁকা। সিলিং-এ উজ্জ্বল রঙে দেবী দুর্গার ছবি আঁকা। দেবীপক্ষ শুরু হলো যে! ভক্তরা এসেছেন সদ্য ভূমিষ্ট সন্তান নিয়ে দেবতার পায়ের ধুলা নিতে, দেবতার পায়ের কাছে পবিত্রতা লাভের আশায়। বিশালকার এই মন্দিরের ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কৃত্রিম আলো জ্বালিয়ে খানিক আলোকময় করা হয়েছে৷ প্যাসেজ পার হয়ে যাবার আগেই প্যাসেজের স্তম্ভজুড়ে খোদাই করা নকশা, কোথাও ফুল পাতা, কোনো স্তম্ভে দেব-দেবী আসন করে নিয়েছেন। মেঝেতে আল্পনা আর সিলিং-এ একেক রকম চিত্রকর্ম। এ মন্দিরের প্রায় সব স্তম্ভ এক প্রস্তরখণ্ডে নির্মিত। অন্ধকারে দেখা না গেলেও হাত দিয়ে ছুঁয়ে ঠিক নকশাগুলো অনুভব করা যায়।

১৪ একর জায়গাজুড়ে এ মন্দিরের অসংখ্যা মণ্ডাপা বা মণ্ডপ বা চওল্ট্রি আছে। আলাদা আলাদা মন্দিরও আছে অসংখ্য। জায়গায় জায়গায় জ্বলছে মঙ্গল প্রদীপ। দক্ষিণ ভারতের এই প্রদীপ জ্বালানো আমায় মুগ্ধ করে! পিতলের একেকটা প্রদীপদান তিন বা চার স্তরে গোলাকার হয়ে অসংখ্য ছোট ছোট প্রদীপে আলোকময় করে দেবতার ঘর। এই মন্দিরের ভেতরেই ৩৩ হাজার দেব-দেবীর মূর্তির বসতবাড়ি  বা খোদাই করা আছে। আরও আছে অসংখ্য লম্বা লম্বা প্যাসেজ। প্যাসেজের মেঝেতে আল্পনা আর সিলিং-এ রঙিন ছবি আঁকা, স্তম্ভে অসাধ্য সাধন করেছে খোদাই করা কারুকাজ।

 

মন্দিরের ভেতরে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি 

চওল্ট্রিগুলো ঘুরে দেখার আগে আমি পেছনের দিকে চলে গেলাম। পাথরে নির্মিত মন্দিরের ভেতরে দাঁড়ালে খেই হারিয়ে ফেলতে হয়। আমি সামনে যে পথ পেলাম তা ধরে হাঁটা দিলাম। যদিও মন্দিরের ভেতরে ছবি তুলতে মানা নেই কিন্তু এই মন্দিরে মানা আছে। পুরো মন্দিরই আমার কাছে গোলকধাঁধা মনে হচ্ছে। যাই হোক, যা আগে সামনে আছে তাই দেখে নেই। লম্বা প্যাসেজ পার হলে চট করেই ছোট একটা ঘরে দেখি মীনাক্ষী দেবী জগৎ আলো করে, ফুলের মালায়, কুমকুমে, গয়নায়, চন্দনে বেশ আপন করে নিচ্ছেন ভক্তদের। আগরবাতির সৌরভে জ্বলে জ্বলে উঠছে যেন খোদ রবি শশী। ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে শত শত  রূপার প্রদীপদানে। পেছনে সারি সারি ফুলের মালা ছাদ থেকে লম্বা করে ঝোলানো, দুই পাশে ফুল,  দুর্গা দেবী যে ফুলের মতোই পবিত্র!

(আগামী পর্বে সমাপ্য)