ভ্রমণ

ভিয়েতনামে অসহায় পর্যটকের রাত্রিযাপন  

(বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ১৪তম পর্ব)

এজেন্সি কার্যালয়ের সামনে যেতেই তাড়াহুড়ো শুরু করে দিলো। পাশে একটা ট্যাক্সিক্যাবে তিনজন আগে থেকেই বসা। আমার জন্য অপেক্ষা করছিল তারা। কোনো কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়ে মূল বিষয়টা সংক্ষেপে বলে প্রায় ঠেলেই আমাকে ক্যাবের ভেতরে ঢুকানো হলো। একজন অপহৃতের ন্যায় শুরু হলো আমার হা লং বে যাত্রা।

ক্যাবের মধ্যে কয়েক মুহূর্ত বিরাজ করল এক চাপা নীরবতা। পরিচয় পর্বের পর সহযাত্রীরা বিষয়টি পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলো- ক্যাবে নির্দিষ্ট দূরত্বে নেওয়ার পর বাসে উঠিয়ে দেওয়া হবে। তার মানে বাকিরাও একই গন্তব্যের পথিক। সামনে বসা তরুণ একজন সুইডিশ পর্যটক আর আমার পাশের দুই তরুণী পোলিশ। প্রতি বছর টানা নির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত কাজ করে যা অর্থ জমে তার একটা বড় অংশ সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া তাদের অভ্যাস। অনেক দিন তারা নিয়ম করে এই কাজটি করে আসছে। পোলিশ তরুণীদ্বয় পরস্পরের বন্ধু এবং সুইডিশ তরুণের আবস্থা আমার মতো- একা পর্যটক।

প্রত্যেকের গন্তব্যস্থল একই হওয়ার সুবাদে কিছুক্ষণের মধ্যে আমার অপহরণ যাত্রা একটা রোমাঞ্চকর যাত্রায় রূপ নিল। পাহাড়-পর্বতের মধ্যে দিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকার পথ। প্রায় ৩০ কিলোমিটার অতিক্রম করার পর ছোট্ট এক শহরের বাস কাউন্টারে নামিয়ে দেওয়া হলো। ২০ মিনিটের মধ্যে চলে এলো কাঙ্ক্ষিত বাস। আবারও স্লিপিং বাস। আমাদের আসন সামনে পিছে এবং পাশাপাশি। আরোহণের পর নাস্তা খেতে খেতে জমে উঠল উচ্ছ্বসিত এবং হাস্যরসাত্মক গল্পের পর্ব। গল্পের মূল বিষয়বস্তু, এজেন্সি কার্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার পর আমাকে নিয়ে অযাচিত তাড়াহুড়ো এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আমার অপ্রস্তুত বা হতবিহ্বল বনে যাওয়া চেহারা। তিনজনের বর্ণনায় পরিস্থিতিটা যেন তিনটি আলাদা রূপে চিত্রিত হলো। নিজ নিজ অভিব্যক্তি প্রকাশ করে হাসিতে একেকজন কুটিকুটি। যে যার ব্যাগ থেকে খাবার বের করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে খেয়ে ডিনার পর্ব সেরে নিলাম। কেউ সরবরাহ করল কেক, কেউ বিস্কুট তো কেউ বনরুটি। আমার ব্যাগে ছিল সেই বিশ হাজারে কেনা কমলালেবু। চমৎকার একটা ডিনারের পর যে যার মতো কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লাম।

রাত ঠিক পোনে তিনটায় বাস গাইডের ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। গন্তব্যে পৌঁছে গেছি, এখনই নামতে হবে। বাস চলে যাবে অন্য কোথাও। নেমে দেখি কোনো বাসস্ট্যান্ড বা টার্মিনাল নয়, একটা ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয়। কার্যালয় ত্যাগ করে যার যার চূড়ান্ত গন্তব্য অনুযায়ী বিদায় হতে হবে এবং তা কয়েক মিনিটের মধ্যে। তার মানে ভেতরে ডরমেটরির মতো দুইতলা বিছানাগুলো আমাদের জন্য নয়।

এই রাতে কোথায় যাই তা নিয়ে চারজনেই চিন্তায় পড়ে গেলাম। বাকি যাত্রীরা ইতিমধ্যেই বিদায় হয়েছে। এজেন্সি থেকে জানানো হলো নৌ-ভ্রমণে তাদের প্যাকেজ অফার আছে। কেউ যদি তা কেনে তাহলে নিয়ম অনুযায়ী ঘুমানোর সুবিধাটা পেয়ে যাবে। পোলিশ যাত্রীদ্বয়ের চূড়ান্ত গন্তব্য ‘ক্যাট বা আইল্যান্ড’। ট্যাক্সিক্যাবে আলাপচারিতার সময় তারা এই জায়গাটার কথা বলেছিল। হা লং বে অত্যাধিক ব্যয়বহুল তাই তাদের আগ্রহের গন্তব্য ক্যাট।

সুইডিশ সহযাত্রী আমার মতোই বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখছে কোন প্যকেজের কী সুবিধা এবং মূল্য কত জানার জন্য। মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে প্রত্যেকেই নিজ নিজ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ ও পদ্ধতি অনুসন্ধানে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সা পা থেকে রোমাঞ্চকর ক্যাব যাত্রা তারপর মজার আড্ডা এবং খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া, সব শেষে আড্ডার রেশ টেনে আরও দু’চারটা কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়া। একটা দুর্যোগের মধ্যে পড়ে সবকিছু যেমন লন্ডভন্ড হয়ে যায় ঠিক তেমনি মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর স্মৃতি মুহূর্তেই লীন হয়ে গেল। পোলিশদ্বয় অনলাইন সেবার মাধ্যমে একটা ট্যাক্সিক্যাব ডেকে বিদায় হলো। সুইডিশ তরুণ বাধ্য হয়ে অতি চড়া মূল্যে একটা একদিনের নৌ-ভ্রমণ প্যাকেজ কিনে নিলো। বাকি রইলাম আমি। এক মিনিটের মধ্যে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্রচণ্ড শব্দে নামিয়ে দেওয়া হলো সাটার।

হা লং বে’র মূল হোটেল এলাকা বেশ দূরে। এদিকে ভোর হতে বড়জোর দুই ঘণ্টা বাকি। ঠিক করলাম ভোর হলেই বরং কোনো একটাতে গিয়ে উঠে পড়বো। অন্ধকার রাত, রাস্তার অপর পাশের একটা খুঁটির ডগায় এক ধরনের ফ্যাকাশে আলো জ্বলছে। আলোর খানিকটা এসে এজেন্সি কার্যালয়ের সিঁড়িতে পড়েছে। আপাতত সিঁড়িতেই আসন পেতে বসে পড়লাম। মনের মাঝে এক ধরনের ভয় ক্রিয়াশীল হয়ে উঠল। কয়েক মিনিট বাদেই তা কেটে গেল। লক্ষ্য করলাম কিছুক্ষণ পরপর নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে দু’একটা স্কুটি চলছে। তার মধ্যে নারী স্কুটি চালকও দেখা গেল। এখানকার আবহাওয়ায় সা পা’র মতো শীতের আবেশ নেই। সিঁড়ির ধারে একটা ফুল গাছের ছায়া ফ্যাকাশে আলো থেকে নিজেকে সামান্য আড়াল হতে সাহায্য করলো। তাতে করে একটু স্বাচ্ছন্দ বোধ করলাম। মুখের সামনে ফাঁকা জায়গা তারপর দূরে একটা বহুতল হোটেল। বেশ কিছু ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে। ঘরের সমস্ত আলো এসে পড়েছে জানালায়। একটু পরপর কোনোটা নিভে যাচ্ছে তো কোনোটা জ্বলে উঠছে। রাস্তার ধারে একাকি কুকুর আড়মোড় ভেঙে ডেকে উঠল। এক মিনিট পর পুনরায় কুঁইকুঁই করতে করতে ঘাড় পেঁচিয়ে মাথাটা কোলের মধ্যে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

শেষ রাতের এই তুচ্ছ ঘটনাগুলোকে একেকটা বিরাট বিষয় বলে মনে হলো। জানালার ওপাড়ে যারা ঘুমায় তারা জানে না এমন একটা একাকি রাতে প্রতিটি সেকেন্ডের ব্যাপ্তি কত বড় আর সুন্দর হতে পারে! কুকুর, সে তো নির্বোধ; জানে শুধু বিতাড়িত হতে। ওর চেয়ে আমার দশা আজ খুব একটা ভালো নয়। আগের রাতে সে হয়তো আমার জায়গাতেই শুয়ে ছিল। সকালে উঠে সে ছুটবে তার খাদ্য আহরণে, আর আমি ছুটবো মনের খাদ্য আহরণের জন্য। পার্থক্য এর চেয়ে বেশি নয়। এক পর্যায়ে নিজেকে সামান্য অসহায় মনে হতে লাগল। পরোক্ষণেই এই অসহায়ত্বকে বেঠিক প্রমাণ করতে শুরু হলো আত্মপক্ষ যুক্তি প্রদর্শন, তপস্যার পরও কি এমন একটা রাত অথবা পরিস্থিতির আয়োজন সম্ভব?

ভোরের আলো ফুটে বেরুবার আগ থেকেই প্রাতঃভ্রমণের জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে বেশ কিছু মানুষ। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে দেখে চমকে উঠল। না, ব্যাপারটা ভালো ঠেকল না, পরিবেশটাকে একটু সহজ করে তোলা দরকার। নিজেও পায়চারি শুরু করে দিলাম। রাস্তায় সূর্যের আলো নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। ঢালু পথে এগিয়েই দূর থেকে দেখা দিলো একটা ট্যাক্সিক্যাব। আমাকে দেখে সেও প্রস্তুত। সে যা বললো তাতেই রাজি হয়ে উঠে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর রাস্তার এক পাশে শুরু হলো সমুদ্র, অপর পাশে শুধু বিলাসবহুল হোটেল ভবন। এক টানে পৌঁছে দিলো হার্বার নামক জায়গায়। মিটারে ভেসে উঠল দুই লাখ চল্লিশ হাজার। মনে মনে ভাবলাম সা পা থেকে এতটা পথ এলাম সাড়ে তিন লাখে। অথচ এই সামান্য দূরত্ব পাড়ি দিতে বেরিয়ে গেল আড়াই লাখ!

ট্যাক্সি থেকে নেমে চারদিকের চাকচিক্য আর আভিজাত্য দেখে ভিমড়ি খাওয়ার উপক্রম। যতদূর দেখা যায় সবগুলোই একেকটা তারকা মানের হোটেলে। সম্বল শেষ করতে এদের যে কোনো একটাতে দুই রাত থাকলেই যথেষ্ট। তারপরও সাহস করে কিছুটা পথ হেঁটে গিয়ে ডানে মোড় ঘুরেছি অমনি পোলিশ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা। একটা হোটেলের লনে বসে কফি পান করছে। আমাকে দেখামাত্র উচ্ছ্বাসে হাত নেড়ে ইশারা দিলো। ভেতর থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে তাদের সঙ্গে বসে পড়লাম। তারা ফেরির জন্য অপেক্ষা করছে। ক্যাট বা আইল্যান্ডে যেতে এখান থেকে ফেরি করে যেতে হবে। 

ক্যাট সম্পর্কে আমি তখনও পুরোপুরি অজ্ঞ। নামটাই জেনেছি তাদের কাছ থেকে। ফোন টিপে ক্যাট বা আইল্যান্ডের উপর একটা ফিচার বের করে আমাকে পড়তে দেয়া হলো। পড়া শেষে কিছু বলার আগেই তাদের প্রস্তাব- চাইলে তুমিও যেতে পারো। এক মুহূর্তে সাধ, সাধ্য আর সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ফেরি ছাড়তে আরও দেড় ঘণ্টা দেরি। ঘাট একটু দূরে। গিয়ে দেখি জনশূন্য পরিবেশটায় মাত্র একজন মানুষ। বেঞ্চের সঙ্গে লম্বা একটা ব্যাগ দাঁড় করিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। আহারে! তার জন্য বড্ড মায়া হলো। কে জানে, রাতটা হয়তো আমার মতো করেই কাটিয়ে দিয়েছে! কানে ইয়ার ফোন, ছোট ব্যাগটা কোলবালিশের মতো করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখা। জুতা জোড়া বেঞ্চের নিচে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা। যেন আপন ঘরেই ঘুমাচ্ছে। দেখেই বোঝা যায় ভদ্রমহিলা পশ্চিমা পর্যটক। 

সামান্য এগিয়ে ছাউনির শেষ প্রান্তে গিয়ে দেখি একটা ফেরি দাঁড়িয়ে আছে। সেখানেও কোনো জনমানুষের চিহ্ন নেই। ফিরে এসে বসে পড়লাম ঘাটের একমাত্র দোকানটায়। দোকান খোলার পর সবে বেচাকেনার প্রস্তুতি চলমান। টিকিট কাউন্টার কখন খুলবে, সে খবর নেওয়ার পর একটা কফি দিতে বললাম। ১০ মিনিট পর কাচের মগে করে পরিবেশিত হলো ব্ল্যাক কফি। মগ থেকে উড়ে আসা ধোঁয়ার পরশেই মন চনমনে হয়ে গেল। কফির দেশ ভিয়েতনাম, উৎপাদনে পৃথিবীর দ্বিতীয়। ভিয়েতনামে পা রাখার পর থেকে অনেক কফিই পান করলাম কিন্তু হার্বার ঘাটের এই দোকনের মতো নয়। (চলবে)  

পড়ুন: ভিয়েতনামের এক কাঁচাবাজারে (১৩তম পর্ব)