শিল্প ও সাহিত্য

দাদুভাই : যাঁর ছন্দে জাগে রুপালি ঢেউ

জীবন যে স্বর্গময় হয়ে উঠতে পারে তা দাদুভাইকে দেখলে অনুভব করতাম।  কেমন টানটান গতি নিয়ে ছিল তাঁর হাঁটা-চলা। কোনো কিছুতেই কাবু হতে দেখিনি। এটিই আমাদের দাদুভাইয়ের পরিপূর্ণ সত্তা। ছড়া তাঁর জীবনের সঙ্গে এবং সমকালীন সংগ্রাম-ভাবনার সঙ্গে একাত্ম।

তাই তো দাদুভাই ছড়া লেখেন না, ঐশ্বরিকভাবে ছড়া বানান। যেমন শব্দের ব্যবহার করেন, তেমনি ছন্দের ব্যবহারও। তাঁর ছড়ার আঙ্গিক বিন্যাস আরও ভিন্নতর। সব কিছু মিলিয়েই দাদুভাইয়ের ছড়া বাংলার ছড়া হয়ে ওঠে।

আশির দশকের শুরুর দিকে তাঁর মুখোমুখি হই প্রথম। অমলিন আনন্দময় মানুষ। কিন্তু প্রথম পরিচয়ের সেই দিনগুলোতে তাঁর অবয়বে রাশভারী চেহারা লক্ষ করেছি। ব্যক্তিগত অনুভূতি দিয়ে যদি এই কথাটার ব্যাখ্যা দেই তা হলে যা বলতে হয় তা হচ্ছে- কখনো কখনো দাদুভাইকে মনে হতো গম্ভীর, দাদুভাই কথা বলেন কম। আর এ কারণেই তাঁর সম্পাদিত ‘কিশোর বাংলা’ অফিসে ছড়া নিয়ে যতবার মুখোমুখি হয়েছি ততবার একটা জড়তা প্রকাশ পেয়েছে আমার মধ্যে। আর সেই সুযোগ নিয়ে দাদুভাই কঠিন অভিব্যক্তি ছড়িয়ে বলতেন, ‘কি ছড়া এনেছ দেখি’।

দাদুভাইকে বলতে পারিনি যে, ভোরের একতা এক্সপ্রেস ধরে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা এসেছি একটা ছড়া দেব বলে। আমার কাছে যেটা অসম্ভব মায়াবী এক ছড়া দাদুভাইয়ের কাছে সেটা ততটাই বিপরীতমুখী একটা ছড়া। তাই তো অবলীলায় ছড়াটা ফেরত দিয়ে বলতেন, ‘এটা হবে না আরেকটা ছড়া দিও।’

এ রকম দোলাচলে ঘুরতে ঘুরতে দাদুভাইয়ের হাত দিয়ে ছাপা হয়ে যেত ছড়া। নিশ্চয়ই ভালো ছড়াটাই ছাপা হতো। সেই আমলের ‘কিশোর বাংলা’য় ছাপানো ছড়া মানে যোগ্য সম্পাদকের স্বীকৃতি। দাদুভাই তেমনি ‘কিশোর বাংলা’র সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে শিশুসাহিত্যে আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। যে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে শিশুসাহিত্যে তাঁর উত্তরসূরিরা এগিয়ে চলছে।

আজ দাদুভাই নেই। ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে গেছেন। দীর্ঘ ৮৪ বছরের জীবনের মধ্য দিয়ে শেষ করলেন তাঁর অমর সৃষ্টির অধ্যায়গুলো। তাঁর সৃষ্টি আমাদের সব সময় পথ দেখাবে। আমাদের মনে করিয়ে দেবে- পড় দাদুভাইয়ের বই। ‘বর্গি এল দেশে’, ‘পান্তা ভাতে ঘি’, ‘নেবুর পাতা করমচা’, ‘আম পাতা জোড়া জোড়া’, ‘ঢামেরিক’। তিনি ছোটদের জন্য নাটকও লিখেছেন ‘বই বই হই চই’। ‘একাত্তরের বিচ্ছু বশির’ নামে শিশু-কিশোরদের জন্য লিখেছেন উপন্যাস। প্রাচীন বাংলার রূপকথা তুলে এনেছেন শিশু-কিশোর পাঠকদের জন্য। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ছোটদের জন্য ‘অঙ্কুর’ নামে দীর্ঘদিন অনুষ্ঠানের পাণ্ডুলিপি রচনা করেছেন। গান লিখেছেন। তাঁর লেখা গান ‘নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, কোন দূরে যাও চইলা’- আজও গানপ্রিয় শ্রোতাদের মনে অনুরণন তোলে। বাংলা একাডেমি পুরস্কার, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কার, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি-অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কারসহ নানান পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন আমাদের দাদুভাই।

যতই তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি ততই আশির দশকের সেই দিনগুলোর দাদুভাইয়ের কথা মনে পড়েছে। চাঁদের হাট বসিয়েছিলেন তিনি। সেই হাটের একটা নয় দুটো নয় অনেক-অনেক চাঁদ আমাদের শিশুসাহিত্যকে বর্ণাঢ্য করে তুলছে।

দাদুভাইয়ের নামের আড়ালে ‘রফিকুল হক’ নামটি আলাদা এক ঐশ্বর্য নিয়ে এসেছে। তাই তো রফিকুল হক মানেই দাদুভাই। দাদুভাই মানেই রফিকুল হক। ছড়াকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। দেখতে পেরেছেন বলেই তাঁর ছড়ায় উদ্ভট শব্দ এসে ভিড় করে সহজতালে গতিময় ছন্দে। দাদুভাই একে নাম দিয়েছেন জংলীর গান:

হুয়াং কোয়াং চিক্ হামবু। ভাগ দূরে হনুমান জাম্বু। জংলী জংলী হাম জংলী। নামটা নামটা চিং কংলী তিলিয়া থিলিয়া মিম রাহুবা পালোয়ান হাম্ হায় বাহুবা।

শিশুরা তো বটেই বড়রাও মজা পান এমন শব্দাবলিতে। শুধু বইয়ের পাতায় নয়, তিনি যখন মঞ্চে দাঁড়ান ছড়া পাঠের জন্য, সেখানেও পাঠের জাদুগিরি দেখাতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। যেন ছড়া পাঠ করছেন না, অভিনয় করছেন। উপস্থিত দর্শকরা খুব সহজেই আবিষ্ট হয়ে পড়তেন। ট্রেনের হুঁইসেল বাজিয়ে দাদুভাই পড়তে থাকেন:

পুঁ ঝিক্ ঝিক্ পুঁ ঝিক্ ঝিক্ দেশ ঘুরবি চল নির্ভীক। থাক ধিং ধিং ময়মনসিং থাম গল্প আর অল্প...

কিংবা যখন আবেগের পূর্ণমাত্রায় তিনি মঞ্চে নিবেদন করেন:

গ্রামের নাম হিজুলী ঝড়ের রাতে বিজুলী রাত থমথম সরোবর সুখ-দুঃখের কুঁড়েঘর। বলতো ওমা হিজুলী, আমার জন্যে কী থুলি?

সত্যিই, দাদুভাইয়ের ছড়া পড়ার উপস্থাপনা এক অদ্ভুত নান্দনিকতায় ডুবিয়ে দিতো পুরো পরিবেশ। দাদুভাই পড়তে থাকেন:

ঘুড়ি বলল, উড়ি  সুতো বলল, ওড়ো,  হাওয়ায় ভেসে মনের সুখে ঘোরো।

শিশু উপযোগী সহজ শব্দ-বাক্যে যে ছন্দের দোলা তাঁর ছড়ায় খুঁজে পাই তা নদীর রুপালি ঢেউয়ের মতোই। যা উৎসারিত হয় আমাদের লোকজ উপাদান থেকে। এই লোকজ উপাদানই তাঁর ছড়ার মূল কেন্দ্রবিন্দু বলে মনে করি। যেটাকে ঘিরে একটা জ্যামিতিক বৃত্ত আঁকা হয়ে যায়। সেই বৃত্তে আছে বাংলার শিশুরা, আছে প্রকৃতি, আছে নদীমাতৃক বাংলাদেশ।

ছেলে ঘুমালো বুড়ো ঘুমালো ভোলা দ্বীপের চরে, জেগে থাকা মানুষগুলো মাতম শুধু করে। ঘুমো বাছা ঘুমোরে সাগর দিলো চুমোরে। খিদে ফুরালো, জ্বালা জুড়ালো, কান্না কেন ছি! বাংলাদেশের মানুষ বুকে পাষাণ বেঁধেছি।

দীর্ঘ জীবন পেরিয়ে দাদুভাই ছড়ার যে বহর সাজিয়েছেন সেই বহরের আমিও একজন সমঝদার। অন্তরজুড়ে অনেক স্মৃতিকথা জমে আছে। সামনা-সামনি দাদুভাইয়ের কাছে প্রকাশ করা হয়নি। তাঁর সঙ্গে সফরে গিয়েছি। কলকাতা, মুর্শিদাবাদ বহুবার। একই ট্রেনে গল্প-গুজবে মেতে উঠেছি চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ, রংপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট যেতে যেতে। ছড়া পাঠের জন্য এক মঞ্চে উঠেছি বহুবার। কিশোরগঞ্জে ছড়া উৎসবের তুমুল আড্ডায় কতবার মেতে উঠেছি- তবুও তাঁকে বলা হয়নি হৃদয়ে জমে থাকা আরও কত কথা। হয়তো এমনিই হয়। সব কথা বলা হয়ে ওঠে না।

সারা জীবন রফিকুল হক দাদুভাই সাংবাদিকতা করেছেন। জীবনে বহু পথ হেঁটেছেন তিনি। ছড়ার ছন্দে-গন্ধে তিনি থাকবেন আমাদের সঙ্গে। বাংলার প্রকৃতি ঘেরা এই জনজীবনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাদুভাই যে আলো ছড়িয়েছেন সেই আলোয় জেগে থাকবে তাঁর ছড়া, আমাদের ছড়া, বাংলার ছড়া।