অর্থনীতি

যে কারণে কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ: বিশ্লেষকদের মতামত

চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকেই রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমতে শুরু করেছে। সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসেও তা অব্যাহত ছিল। যা গত সতের মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে। করোনায় প্রবাসীদের কাজ সুযোগ কমে যাওয়াসহ বেশ কিছু কারণে রেমিট্যান্স কমেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে, করোনার আগে ও করোনাকালে যেসব প্রবাসীরা দেশে এসেছে তাদের অনেকেই নানা প্রতিবন্ধকতায় পড়ে ফেরত যেতে না পারা, করোনায় কাজের সুযোগ কমে যাওয়া, অনেকের কাজ হারানো, ওভারটাইম করতে না পারা; বিপরীত দিকে প্রবাসীদের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

তবে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশে নতুন নতুন শ্রম বাজার খুঁজে বের করে দক্ষ মানবসম্পদ পাঠাতে পারলে রেমিট্যান্স ভবিষ্যতে রেকর্ড গড়বে বলে মনে করছেন তারা।    

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যমতে, সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১৬৪ কোটি ৬৮ লাখ মার্কিন ডলার। আগের মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৭২ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার। এর আগে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের মে মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫০ কোটি ৪৬ লাখ মার্কিন ডলার। এরপর থেকে এতো কম রেমিট্যান্স আসেনি। সতের মাস পর ফের রেমিট্যান্স এতোটা কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, রেমিট্যান্স কমায় উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। স্বাভাবিকভাবে ঈদের সময় নগদ টাকার চাহিদা মেটাতে প্রবাসীদের দেশে অর্থ পাঠানোর তাগিদ থাকে। আর এ কারণে সারা বছরের মধ্যে ঈদের সময় রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে। করোনাকালেও প্রবাসীরা জমানো অর্থ পরিবার পরিজনের নিকট পাঠিয়েছে। ফলে ওই সময়ও রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। তবে এখন কিছুটা কম থাকলেও ভবিষ্যতে তা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

রেমিট্যান্স পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের চার মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৭০৫ কোটি ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭৬ কোটি ৭ লাখ মার্কিন ডলার বা ১৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ কম। আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে একই সময়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ৮৮১ কোটি ৫২ লাখ মার্কিন ডলার। তবে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৫১ কোটি ৯২ লাখ মার্কিন ডলার।  

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ রাইজিংবিডিকে বলেন, রেমিট্যান্স যে পরিমাণ এসেছে প্রকৃতপক্ষে সেটাই আসার কথা। কিন্তু করোনাকালে লকডাউন থাকায় প্রবাসীদের জীবন যাত্রার ব্যয় কমে গিয়েছিল বিপরীত দিকে লকডাউন থাকায় অবৈধ পথে রেমিট্যান্স আসেনি। ওই সময় প্রবাসীরা তাদের জমানো অর্থ দেশে পাঠানোর কারণেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে গিয়েছিল। করোনা মহামারির কারণে অনেক প্রবাসী কাজ হারিয়েছে, অনেকে দেশে ফেরত এসেছে। তাছাড়া যারা প্রবাসে আছে তাদের খরচ বেড়েছে, ওভারটাইম কমেছে। এসব কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ ফের সঠিক জায়গায় ফিরে আসছে। তবে বিদেশগামীদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে রেমিট্যান্সের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান তিনি।

ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এমরানুল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, করোনাকালে রেমিট্যান্স আসার যে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছিল তার বেশ কিছু কারণ আছে। আমাদের রেমিট্যান্স আসার অন্যতম উৎস মধ্যপ্রাচ্য। করোনায় অনেকের কাজ কমে গেছে, যারা ওভারটাইম করতো তারা তা করতে পারছে না। করোনার আগে যেসব প্রবাসীরা দেশে এসেছিল তারা অনেকেই ফেরত যেতে পারেনি। তাছাড়া করোনার মাঝেও যারা দেশে এসেছে তারা তাদের সমস্ত আয় দেশে ফেরত এনেছে। ফলে করোনাকালে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছিল। তবে এখন যে পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে আসছে তা দুয়েক মাসের মধ্যে আরও বাড়বে।

তিনি বলেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য বৈধ পথে তা পাঠালে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও নতুন নতুন দেশ খুঁজতে হবে যেখানে আমাদের দক্ষ মানবসম্পদ কাজ করতে পারবে। তাতে রেমিট্যান্সের প্রবাহ আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬.১০ শতাংশ বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৪৯ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনায় লকডাউন থাকায় এতদিন হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসেনি। তাছাড়া প্রণোদনার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স এসেছে। এতে রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন হয়েছে, যা বেশি দিন থাকবে না বলে আমি আগেই বলেছিলাম। তবে এখন যেটা এসেছে সেটাই স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনশক্তির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলেই ভবিষ্যতে রেমিট্যান্স বাড়বে বলে আশা করা যায়।