রাইজিংবিডি স্পেশাল

বনদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথে প্রধান বাধা মামলা

সুন্দরবনকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল বিশাল অপরাধী চক্র। জলদস্যু-বনদস্যুরা বনের ভেতর অপরাধের স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ডাকাতি, অপহরণ, হত্যা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সম্প্রতি অনেক জলদস্যু ও বনদস্যু র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তবে, দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার ক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন মামলা।

বাগেরহাটের রামপালে সরেজমিনে ঘুরে কয়েকজন সাবেক বনদস্যুর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। দস্যুতা ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টায় থাকা এক ব্যক্তি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘মামলায় জীবন খায়ে ফেলছে, স্যার।’

সুন্দরবনের বহুল আলোচিত বড় ভাই বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘আত্মসমর্পণের আগে ২৫ বছর ধরে আমি সুন্দরবনের গহীনে ছিলাম। কখনো ডাঙায় আসতে পারতাম না। চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব ব্যবসায়ী আসতো, তাদের আমরা জিম্মি করতাম। জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করতাম। আমার বিরুদ্ধে ১০টি মামলা ছিল। আশা করেছিলাম, আত্মসমর্পণের পর সে মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু, একটি মামলাও প্রত্যাহার করা হয়নি। উল্টো নতুন করে আমার বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলা হয়েছে। মামলা চালাতে সব সম্পদ বিক্রি করেছি। এখন ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে। সরকারের কাছে আমার দাবি একটাই—মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হোক। কারণ, মামলা প্রত্যাহার করার শর্তে আমরা আত্মসমর্পণ করেছিলাম।’

তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে আত্মসমর্পণের পর আমাদের জেলে পাঠানো হয়েছিল। ২১ দিন কারাভোগের পর জামিন পাই। পরে আরেকটি মামলায় আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের করা ওই মামলায় ছয় মাসের বেশি জেল খাটি।’

রাইজিংবিডির প্রশ্নের জবাবে বড় ভাই বাহিনীর প্রধান বলেন, ‘যখন দস্যু বাহিনীর নেতৃত্ব দিতাম, তখন ছেলে-মেয়ে, মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারতাম না, কথা বলতে পারতাম না। তবে, আমার বাহিনীর সদস্যদের কাউকে কাউকে মাঝেমধ্যে বাড়িতে পাঠাতাম। এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। যাদের মাধ্যমে দস্যুতায় জড়িয়েছি, তাদের নাম বললে ডাঙায় থাকতে পারব না। কারণ, তারা প্রভাবশালী।’

তিনটি দস্যুদলের সদস্য ছিলেন মাহমুদ হাসান। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমার বাড়ি মংলার আন্দারিয়া গ্রামে। মাস্টার বাহিনী, সাগর বাহিনী এবং বড় ভাই বাহিনীর অধীনে দস্যুপনা করেছি। ২০১৪ সালে যোগ দিই মাস্টার বাহিনীতে। প্রথমদিকে ভয় লাগলেও পরে ভয় কেটে যায়। আমি যে দস্যুদলে যোগ দিয়েছি, তা বাড়ির কেউ জানত না। ওই জীবন খুব কষ্টের ছিল। যখন বুঝতে পারি স্বাভাবিক জীবনে ফেরা প্রয়োজন, তখন (২০১৭ সালে) বড় ভাইয়ের নেতৃত্বে তার বাহিনীর সবাই মিলে র‌্যাবের কাছে আত্মসমর্পণ করি।’

মাহমুদ হাসান জানান, সুন্দরবন এলাকার একেকটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করত একেকটি বাহিনী। আমরা জেলে, বাওয়ালি- মাওয়ালিদের বছরে দুইবার কার্ড দিতাম। তারা আমাদের মাসোহারা দিতো। যাদের কাছে কার্ড থাকত না, তাদের আমরা অপহরণ করতাম। কেড়ে নিতাম সর্বস্ব। এভাবে মাসে ৩০-৪০ হাজার টাকা আয় হতো। কিন্তু মনে কোনো শান্তি পেতাম না। এখন রেন্ট-এ-কার চালাই। পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো আছি। আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে আছি। আত্মসমর্পণ করার পর আমাদের জেলে পাঠানো হয়। যেদিন জেল থেকে ছাড়া পাই, সেদিনই বিয়ে করি।’

রামপালের মোহাম্মদ মিকাইলও তিনটি দস্যু বাহিনীর সঙ্গে ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার বাহিনীর লিডার ছিলেন মেজবাহউদ্দিন মুক্তি। আমাদের সঙ্গে যারা আত্মসমর্পণ করেছেন, তাদের কেউ কেউ ইতোমধ্যে গোপনে পুরনো পেশায় ফেরার চেষ্টা করছেন। মুক্তি একটি রাজনৈতিক দলের ইউনিয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক। মুক্তি কখনো সুন্দরবনের গহীনে যান না। টাঙ্গাইল থেকে তিনি অস্ত্র ও গোলাবারুদের যোগান দিতেন আমাদের। চাল-ডালও পাঠাতেন। বিনিময়ে আমাদের আয়ের বেশিরভাগই দিতে হতো তাকে।’

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ থানার কাঠালিয়া গ্রামের ইউনুস আলী বলেন, ‘একসময় নিজের নৌকায় করে মাছ ধরতাম। এরইমধ্যে এলাকার এক প্রভাবশালীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয়। ওই ব্যক্তি পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে আমার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করে। প্রাণের ভয়ে পালিয়ে ২০০৭ সালে সুন্দরবনের গহীনে যেতে বাধ্য হই। শুরু হয় দস্যুপনা। ওই প্রভাবশালীর নাম বলা যাবে না। তাহলে তারা শুধু আমাকে নয়, পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ক্ষতি করতে পারে।’

অন্য জলদস্যুদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রভাবশালীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তখন তারা গ্রেপ্তার এড়াতে গহীন জঙ্গলে চলে যান। কিন্তু সেখানে থেকেও রক্ষা পাওয়া যায় না। দস্যুতার মাধ্যমে অর্জিত অর্থের একটি অংশ বাহিনীর গডফাদারদের দিতে হতো। এসব গডফাদারই দস্যুদের কাছে অনেক বেশি দামে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রি করত। এভাবে অনেকেই দস্যুদের ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে, তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে ভয় পান দস্যুরা।

আত্মসমর্পণকারী দস্যুরা বলছেন, সরকার মামলা প্রত্যাহারের শর্তে আত্মসমর্পণের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু, এখনও মামলাগুলো চলছে। ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে। কারো কারো বিরুদ্ধে ১০-২০ বা এর চেয়েও বেশি মামলা আছে। সরকারের অনুদানের টাকা দিয়েও মামলা চালানোর ব্যয় মেটানো যাচ্ছে না। এতে তারা বিপাকে পড়ছেন।

এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘ধর্ষণ ও হত্যার মামলা ছাড়া বাকি মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করতে আমরা জোর তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি।’

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘মামলা দ্রুত প্রত্যাহার না হলে আত্মসমর্পণ করা দস্যুরা আবার পুরনো পেশায় ফিরতে পারে। সুন্দরবনকে স্থায়ীভাবে দস্যুমুক্ত রাখতে মামলাগুলো প্রত্যাহার করা উচিত।’