খেলাধুলা

দুবাই এক্সপো: এক বৃত্তে পৃথিবী দেখা 

হাঁটছি তো হাঁটছি! হঠাৎ ডান পাশ থেকে নানান রকম পশু-পাখির ডাক কানে এলো। কোনো ডাক আবার ভয় ধরিয়ে দেয় মনের কোণে! এগিয়ে যেতেই একজন প্রতিনিধি পর্তুগিজ ভাষায় বললেন, ‘ব্রাজিলের প্যাভিলিয়নে আপনাকে স্বাগতম।’

যত অতিথিই আসুক না কেন, তিনি ‘স্বাগতম’ জানাতে ভুল করেন না। পাঠকদের মনে হয়তো এখন ঝড় চলছে- কোথায় ব্রাজিলের প্যাভিলিয়ন, কোথায় পশু-পাখির ডাক- এসব কী?

বলছি দুবাই এক্সপো ২০২০-এর কথা। ১ অক্টোবর থেকে এক্সপো শুরু হয়েছে আরব আমিরাতের শহর দুবাইয়ে। পৃথিবীর ১৯২টি দেশ এখানে প্যাভিলিয়ন গড়ে তুলেছে। এ ছাড়া আছে অর্গানাইজেশন প্যাভিলিয়ন, পার্টনার প্যাভিলিয়ন এবং একটি বিশেষ প্যাভিলিয়ন। এক্সপোতে এক সন্ধ্যায় ঘুরতে ঘুরতে ব্রাজিলের প্যাভিলিয়নে যাওয়া এবং মুগ্ধ হওয়া! প্রতিটি দেশই প্যাভিলিয়নে নিজেদের কৃষ্টি-কালচার-ঐতিহ্য তুলে ধরেছে তাঁদের মতো করে। ব্রাজিলও তার ব্যতিক্রম নয়। 

ভেতরের ঢুকতেই পানির ছোঁয়া। বুঝতে সময় লাগে না সমুদ্র সৈকতের আবহ তুলে ধরা হয়েছে। পাশেই চেয়ার। বসে আরাম করছেন অনেকেই। তিন পাশের ভার্চুয়াল পর্দায় ভেসে বেড়াচ্ছে অ্যামাজন বন, নানা পশু-পাখি, সৈকত হতে শুরু করে দেশটির নানা ঐতিহ্যবাহী বিষয়। মিনিট খানেক অপেক্ষা করতে না করতেই নাচতে নাচতে প্যাভিলিয়নে প্রবেশ করলেন সাম্বা নাচের শিল্পীরা। বেশ কিছুক্ষণ তারা উপস্থিত দর্শকদের মাতিয়ে রাখলেন ঐতিহ্যবাহী সাম্বা নৃত্যে। 

এক্সপো মানেই তো শুধু ব্রাজিল নয়। আসলে একটার বিষয়াদি দিয়ে বাকিগুলো বোঝানোর চেষ্টা। প্রতিটি দেশই তাদের প্যাভিলিয়নে ফুটিয়ে তুলেছে তাদের সংস্কৃতগত দিক; উন্নয়নের গল্প। বের হয়ে সামনের দিকে এগোতেই একটি প্যাভিলিয়নের বাইরের পর্দায় উটের বিচরণ দেখতে পেলাম। বুঝতে দেরি হলো না, এটি কোনো আরব দেশ। আসলেও তাই, এটি ছিল কাতারের প্যাভিলিয়ন।

১৯২টি দেশ আছে, এখানে কি বাংলাদেশ নেই? পাঠকদের মনে হয়তো এতক্ষণে উঁকি দিতে শুরু করেছে প্রশ্ন। মন খারাপের কিছু নেই। ১ হাজার ৮০ একর জমির ওপর চলমান এই এক্সপোতে আছে লাল সবুজের বাংলাদেশও। বাইরের দেয়ালজুড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ছবি থাকায় চিহ্নিত করা যায় সহজেই। তবে ব্রাজিলের প্যাভিলিয়নের মতো এখানে স্বাগতম জানানোর মতো কেউ ছিলেন না। 

একপাশে প্রবেশের দরজা, আরেক পাশে বের হওয়ার। ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। এই অংশজুড়ে শুধু বঙ্গবন্ধু। দেয়ালে লাগানো স্ক্রিনে চলমান তাঁর বিখ্যাত ভাষণ। কোনো দর্শনার্থী চাইলেই শুনতে পারবেন এয়ার ফোন লাগিয়ে। আছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিও। মাঝের জায়গা নৌকার আদলে তৈরি। পাটের তৈরি নানা হস্তশিল্প ছাড়াও বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জিনিসে সাজানো পুরোটা। এ ছাড়া চারপাশের দেয়ালের স্ক্রিনে বর্তমান সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্প, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, দেশের দর্শনীয় স্থান হতে শুরু করে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাফল্যের গল্পের বর্ণনা। দর্শনার্থীরা চাইলেই এসব অডিও ভিজুয়াল এয়ার ফোন লাগিয়ে শুনতে পারবেন। 

২২ কোটি টাকায় এই প্যাভিলিয়ন তৈরি করা হয়েছে। নিজেদের দেশ তুলে ধরা ছাড়াও সেমিনার-সভার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা হবে। সর্বমোট ২০টি সেমিনার হওয়ার কথা রয়েছে। শনিবার (৬ নভেম্বর) বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. আবু জাফর উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘দ্বিতীয়বারের মতো এক্সপোতে আমরা অংশ নিচ্ছি । গত ১২ বছরে বাংলাদেশ যে উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে- আমরা সেটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের যেসব সংস্কৃতি আছে তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বিভিন্ন বিষয়গুলো এখানে অডিও ভিজুয়্যালের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।’

এক্সপোর জন্য দুবাই শহরে সাজসাজ রব। শহরজুড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে ফ্রি বাসের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া মেট্রোর মাধ্যমে যাওয়া যায় সহজেই। ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সী যে কারো এখানে প্রবেশ করতে ৯৫ দিরহাম খরচ হবে। বাংলা টাকায় যা ২ হাজার ৩০০ টাকার মতো। এ ছাড়া একসঙ্গে পুরো মৌসুমের টিকিট পাওয়া যাবে ৪৯৫ দিরহামে। শিশু ও ৫৯ বছরের বেশি যে কোনো দেশের নাগরিকদের জন্য প্রবেশমূল্য নেই। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এক্সপো। করোনার ভ্যাকসিন সনদ অথবা ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করা করোনা নেগেটিভ সনদ দেখাতে হবে প্রবেশের আগে। 

১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এক্সপো শেষ হবে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ। এটি হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে, করোনার কারণে হচ্ছে এ বছর। এর আগেরবার ২০১৫ সালে এক্সপো হয়েছে ইতালির মিলান শহরে, আগামীবার ২০২৫ সালে হবে জাপানের ওসাকায়। 

দিনের আলো শেষে রাতের আঁধার নামতেই এক্সপোতে দেখা নানা রঙের আলোর ঝলকানি। কৃত্রিম আলোর বাহারের সঙ্গে ১৯২টি দেশের ভিন্নরকম প্রদর্শনী হয়ে ওঠে চোখ ধাঁধানো। আছে নানা রকম বিনোদনের ব্যবস্থা, কনসার্ট আর নাচ। সবকিছু মিলেয়ে এক বৃত্তে যেন ১৯২ দেশের বাস। এক্সপো থেকে বেরিয়ে যখন মেট্রোর পথে পা বাড়ালাম তখনও মনের কোণে একটা কথাই ভেসে এলো- এক বৃত্তে পৃথিবী দেখে ফেললাম!