শিল্প ও সাহিত্য

হ‌ুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয়তা ও সাহিত্যের রাজনীতি

জনরুচির প্রতি বোদ্ধা সমাজের একটা অনীহা থাকেই। ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমা হিসেবে কেমন এ নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা হয় না। এটা জনপ্রিয় সিনেমা, বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় সিনেমা-  এটুকু বলেই আমরা দায় সেরে নিতে পারি। ‘হিট সিনেমা’ নিয়ে আমরা আর বিশ্লেষণে যাই না। ধারণা করে নেই, এটি যেহেতু লক্ষ লক্ষ লোক দেখেছে সেহেতু এটি আমজনতার সিনেমা, জন সাধারণের সিনেমা। আর শিক্ষিত সমাজ, বোদ্ধা আলোচক যেহেতু নিজেকে সাধারণ ভাবেন না, ভাবতে চান না, সেহেতু ‘হিট সিনেমা’ নিয়ে কথা বলেন না।

‘পল্লীকবি’ জসীমউদ্দীন টাইটেল লাগিয়ে তাকে আমরা এক অর্থে একপেশে করে ফেলি, জসীমউদ্দীন যে একজন আধুনিক কবি ছিলেন সে আলাপ উহ্য থাকে। আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’ কিংবা সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরাণের গহীন ভিতর’ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে গ্রামীণ ও লোকজ অনুষঙ্গে যে ধারা পাই তার সঙ্গে আমরা আর জসীমউদ্দীনকে যুক্ত করি না। ফলে জসীমউদ্দীন অনেকটা প্রক্ষিপ্ত আলোচনার অংশ হয়ে যান।

একইভাবে ‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলাম বলেও আমরা নজরুলের বিচিত্র কর্ম বৈচিত্রকে নজর এড়িয়ে যাই। ‘পল্লীকবি’, ‘বিদ্রোহী কবি’ ‘বিশ্বকবি’ ইত্যাদি মুখস্থ শিরোনামের মতোই ‘জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক’ তকমায় আমরা একজন লেখককে ঠিকভাবে মূল্যায়ন করি না। 

হ‌ুমায়ূন আহমেদের ৭৩তম জন্মদিনের ক্ষণে এই কথাগুলো মনে পড়লো আমার। নিশ্চয়ই বেঁচে থাকলে ইতোমধ্যে তিনি আমাদের আরো অনেকগুলো বই দিতেন- মিসির আলি, হিমু, শুভ্রদের যাত্রা থেমে থাকতো না। হয়তো আরো কিছু মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, শিশুতোষ উপন্যাস, অসাধারণ কিছু ছোটগল্প, আধিভৌতিক কিংবা অতিপ্রাকৃতিক গল্প-উপন্যাস, আত্মজৈবনিক লেখা কিংবা ভ্রমণ কাহিনী পেয়ে যেতাম। তার লেখার ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা বাতুলতা মাত্র।  অথচ লক্ষ্য করি, ‘হিট সিনেমা’র মতো তাকে নিয়েও আলোচনা কম, বড়ই কম। বিশেষ করে মূলধারার কবি ও সাহিত্যিকরা তাকে অনেকটাই এড়িয়ে চলেন। একদল কোনোরকম আলোচনা ছাড়াই একেবারে খারিজ করে দেন হ‌ুমায়ূনের তাবৎ সাহিত্যকর্ম। অন্যদল একদম মুখে (লেখায়) কুলুপ এঁটে থাকেন। হ‌ুমায়ূনের বিপুল সাহিত্যকর্মের মধ্য থেকে লেখক, সমালোচকরা খুব কম রচনা ধরেই কথা বলেন।

এটা ঠিক যে, জনপ্রিয়তার ঝামেলা আছে। সেই ঝামেলা হ‌ুমায়ূন আহমেদকে কম ভোগায়নি। তবে সবচেয়ে বেশি ভুগেছে সাহিত্য সমাজ। হ‌ুমায়ূন আহমেদের তীব্র জনপ্রিয়তার ভিড়ে হারিয়ে গেছে তার অসাধারণ কিছু রচনা। আপ্তবাক্যের মতোই অন্ধ সমালোচক মুখস্থ বলে গেছেন, ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খচিল কারাগার’ ইত্যকার সূচনালগ্নের দুয়েকটি বইতেই হ‌ুমায়ূন আহমেদের মুন্সিয়ানা লক্ষ্য করা যায়। অথচ হ‌ুমায়ূন আহমেদ তার দীর্ঘ লেখালেখির জীবনে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা সৃষ্টি করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তিনিও প্রচুর লিখেছেন। এবং বলে রাখা দরকার রবীন্দ্রনাথ কিংবা তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সব লেখাই সাবলিমিটিতে (চূড়ান্ত শৈল্পিক উৎকর্ষে) পৌঁছায়নি। কখনোই একটি মানুষের সকল কাজ চূড়ান্ত উচ্চতায় যেতে পারে না। বড় লেখক, স্বভাবতই একটা নিজস্ব মানদণ্ড তৈরি করেই লেখেন। নইলে ইতিহাস তাকে বড় লেখকের জায়গাটি দেয় না।

প্রত্যেক কালজয়ী লেখকই নিজের মুন্সিয়ানার পরিচয় রেখে যান তার রচনার নানা বাঁকে। সমালোচকের কাজ, সেই বাঁকগুলো খুঁজে নেওয়া এবং অন্যদের ধরিয়ে দেওয়া।  ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খচিল কারাগার’, ‘অচিনপুর’, ‘নির্বাসন’ সূচনাকালের এই চারটি উপন্যাসই গভীর পাঠের দাবি রাখে এবং সমালোচকরা এই উপন্যাস চারটির প্রশংসাই করবেন। কিন্তু ব্যাপারটা কি এমন যে শুরুতেই যে মুন্সিয়ানা তিনি দেখিয়েছেন পরে তিনি তা হারিয়ে ফেললেন! খ্যাতির ডামাডোলে তিনি তার দক্ষতা ব্যবহারে শ্লথ হয়ে গেলেন! আসলে লেখক কি এক সময় তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন! 

ইংরেজিতে একটা কথা আছে স্টেরিওটাইপ। এই কথাটা বাংলায় বলতে পারি ‘আবদ্ধ পূর্বধারণা’। মানে আগে থেকে একটা ধারণা করে বসে থাকা। ভুলে গেলে চলবে না হ‌ুমায়ূন আহমেদ জীবিত থাকতেই হ‌ুমায়ূন-বিরোধীতার একটা ফ্যাশান তৈরি হয়েছিল। প্রবল জনপ্রিয়তার ঈর্ষা কিংবা সাহিত্যিক গোষ্ঠিবদ্ধতার বাইরে থাকা কিংবা দাম্পত্য ও ব্যক্তিজীবনের বিতর্কের কারণেই হ‌ুমায়ূনকে অনেকে বিবেচনা করেছেন আবেগের বশেই। ফলে তীব্র হ‌ুমায়ূন- বিরোধীরাও কখনো যুক্তি দিয়ে, তারচেয়েও বড় কথা, তার সাহিত্য দিয়ে তাকে বিচার করেনি। 

আমি বহু কথিত হ‌ুমায়ূন-বিরোধী দেখেছি, যারা গড়গড় করে বলে গেছেন, হ‌ুমায়ূন আহমেদের লেখার কোনো মান নেই, তিনি একই জিনিস লিখেছেন জীবনভর, পূনরাবৃত্তি আর পাগলামীতে ভরপুর তার লেখা। কিন্তু এসবই মৌখিক কিংবা অনানুষ্ঠানিক বয়ান। লিখিতভাবে কেউ হ‌ুমায়ূনের এইসব ‘পুনরাবৃত্তি, পাগলামী, ছ্যাবলামী’র উদাহরণ দিতে পারেননি। তারা হয় ঘরোয়া আড্ডায় কিংবা সামাজিক যোগাযোগে চটুল কিছু মন্তব্যের মধ্যেই হ‌ুমায়ূন-বিরোধীতাকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। হ‌ুমায়ূনের লেখালেখি ত্রুটি মুক্ত নয়, কোনো লেখকেরই নয়। লেখকরা পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ লেখেন না। কিন্তু সেটাই কি স্বাস্থ্যকর নয় যে, একজন লেখকের দুর্বলতাগুলো তথ্যসহ তুলে ধরা, অন্তত যদি তার বিরুদ্ধ সমালোচনা করতে চাই।

একজন লেখককে যাচাই-বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তার টেক্সট সবচেয়ে বড় সূত্র হতে পারে। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, হ‌ুমায়ূন আহমেদের টেক্সট নিয়ে এক ধরনের সচেতন নীরবতা লক্ষ্য করা যায়। সচেতন বলছি এ কারণেই যে হ‌ুমায়ূন সমকালের অন্য অনেক জনপ্রিয় লেখকের সঙ্গে পানাহার করতেন, দেশে-বিদেশে যেতেন, অনেক সম্পাদক ও সমালোচকের সঙ্গেই তার যোগাযোগ ছিল। কিন্তু এরা কেউই কখনো হ‌ুমায়ূন আহমেদের টেক্সট নিয়ে সিরিয়াসলি লেখেননি। 

এমনকি হ‌ুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরও দেখা গেছে তাকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার তাড়না নিয়েই তারা ব্যস্ত ছিলেন। ভঙ্গিটা এমন যে, হ‌ুমায়ূন আহমেদ আদতে লেখক ছিলেন না, ছিলেন এক সেলিব্রিটি, সিনেমার নায়ক। অবশ্যই হ‌ুমায়ূন আহমেদ সেলিব্রেটি কিন্তু তার সকল খ্যাতি-বিত্তের সূতিকাগার কিন্তু লেখালেখি। অথচ হ‌ুমায়ূন বিষয়ক অধিকাংশ সংকলনে দেখা যায়, হ‌ুমায়ূনের সাহিত্য নিয়ে চর্চার চেয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণাই গুরুত্ব পেয়েছে। একজন লেখকের ব্যক্তি জীবনও তার সাহিত্যকর্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে কাজে দেয়। কিন্তু সাহিত্যকর্মকে আড়ালে রেখে কে কবে তার সঙ্গে সিঙ্গারা খেয়েছেন, মদিরা পান করেছেন, কোথায় বেড়াতে গিয়েছেন এইসব লেখালেখিকে আমি খুব সদর্থে দেখি না।  

আরো লক্ষ্যনীয়, এ দেশের প্রকাশক-সম্পাদকরা লেখক তৈরি করেন না, লেখক হয়ে ওঠার পরই তার পেছনে বিনিয়োগ করেন। হ‌ুমায়ূন আহমেদ নিজ যোগ্যতাতেই লেখক হয়েছিলেন। লেখক হয়ে ওঠার পর তাকে নিয়ে হইচই শুরু হয়। বাজারে সেই দ্রব্য নিয়েই হইচই হয় যার চাহিদা আছে। হ‌ুমায়ূনের সেই চাহিদা তার মৃত্যুর পরও রয়ে গেছে। কিন্তু এই চাহিদার ভিড়ে আজও কথাসাহিত্যিক হ‌ুমায়ূন দূর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বলেই আমার বিশ্বাস। যতো সম্পাদক, লেখক, কবিদের সঙ্গে হ‌ুমায়ূনের সখ্য ছিল, এ দেশে যে পরিমাণে হ‌ুমায়ূন পঠিত হয়েছে, হয়, সেই তুলনায় তার সাহিত্য নিয়ে আলোচনা কড় গুণে বলা যায়। এই অঙ্গুলিমেয় রচনা আর বিরাট নীরবতার মধ্যবর্তী ফারাকটি আমাদের সাহিত্য জগতের ঔদাসীন্য নাকি রাজনীতি সেটা ভাবার সময় এসেছে।