ভ্রমণ

মাকে নিয়ে এক বিকেলে বেড়ানোর গল্প

মায়ের মুখে কখনো শুনিনি তিনি কোথাও ঘুরতে যাবেন। বাবা কখনো মাকে নিয়ে কোথাও বেড়ানোর উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন কিনা আমি জানি না। মায়ের মুখেও কখনো শুনিনি ঘুরতে যাওয়ার গল্প।

বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা পরিবারের মেরুদণ্ড হয়ে আমাদের সামলে রাখছেন নিখুঁত দক্ষতায়। ঘর এবং জমি চাষবাস একসঙ্গে সামাল দিচ্ছেন নিরলসভাবে। অলসতা মাকে থামাতে পারেনি এক মুহূর্তের জন্যও। কাজের ফাঁকে কখনো তার কোথাও বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করে কিনা আমাদের বুঝতে দেননি। এই যে সারা বছর দেশে ও দেশের বাইরে ঘুরে বেড়াই কিন্তু মাকে নিয়ে কখনো কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। করোনা মহামারির সময় দীর্ঘদিন বাড়িতে মায়ের সঙ্গে কাটিয়েছি। তেমন কোথাও ঘুরতে যেতে পারিনি। তাই একদিন সকালে মাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যদিও তিনি কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে বেরুতে চাননি। বলা চলে একপ্রকার জোর করেই তাকে নিয়ে বের হলাম।

ঢাকার অদূরেই কালিয়াকৈর উপজেলা। আমার বাড়িও এই উপজেলাতেই। তাই মাকে নিয়ে নিজ উপজেলাতেই ঘুরতে বেরিয়েছি। প্রথমেই চলে এলাম কালিয়াকৈরের শ্রীফলতলী জমিদার বাড়ি। কালিয়াকৈরের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। বেশিরভাগ জমিদার বাড়ির মতোই এখানেও জমিদারির দুই তরফ দেখা যায়। ছোট তরফ আর বড় তরফ। বড় তরফের বাড়িতে কাঠামোগত কিছু সামান্য সংস্কার চোখে পড়ে। তবে ছোট তরফ যে অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে তার প্রমাণ স্পষ্ট।  শ্রীফল অর্থ বেল। শ্রীফল থেকেই বর্তমানের শ্রীফলতলীর নামকরণ। এখানকার জমিদাররা তালেব গাজীর বংশধর ছিলেন। তালেব গাজীর নামেই এই পরগণার নাম তালেবাবাদ রাখা হয়। পরগণার নয় আনা অংশ নিয়ে শ্রীফলতলী এস্টেট। তারা তুরস্কের অধিবাসী ছিলেন। ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য ভারতবর্ষে আসেন।  প্রথমে তারা চান্দরার মনাই বিবির দিঘীর পাড়ে বসতি স্থাপন করেন। দিঘীর পাড়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটি ‘ভাঙা মসজিদ’ নামে সবার কাছে পরিচিত। দিঘীর পাড়ের পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর মনে হওয়ায় তারা শ্রীফলতলীতে চলে আসেন। এবং নতুন করে বসতি স্থাপন করেন।

১২২৪ হিজরীর ১ মুহাররম জমিদার আলী নেওয়াজের স্ত্রী রমজানুন নেছা শ্রীফলতলীতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে তার বংশধর রহিম নেওয়াজ খান এই এস্টেটের জমিদার হন। তিনি জনহিতকর কাজের মাধ্যমে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। তার শাসনামলে এই পরগণার জনসাধারণ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতেন। সমাজ ও দেশের সেবায় তার অবদান ছিল অনেক। পরগণার জনগণের প্রশাসনিক কজের সুবিধার্থে সাভার থানাকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে তিনি নিজস্ব জমিতে কালিয়াকৈর থানা গঠন করেন। রহিম নেওয়াজ খান মারা যাওয়ার ১০০ বছর পর তার বংশধর সৈয়দ আফজাল হোসেন চৌধুরী আপেল শ্রীফলতলী জমিদারবাড়ি পুনরায় সংস্কার করেন। 

মাকে নিয়ে জমিদারবাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখালাম। মা যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন, সেহেতু এই বাড়ি সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। আমি মাকে এই বাড়ির ইতিহাস জানালাম। এই জমিদারবাড়িতে একটি ছোট যাদুঘর আছে। কিন্তু করোনার কারণে যাদুঘরটি বন্ধ।  

জমিদারবাড়ি দেখা শেষ করে মাকে নিয়ে চলে এলাম কালিয়াকৈরের আরেকটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র মকশবিল। কালিয়াকৈর উপজেলার যে কোনো স্থান থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক কিংবা প্রাইভেট কারে সহজেই মকশবিলে আসা যায়। এখানে আসার পথে চোখে পড়বে অপরূপ গ্রামীণ সৌন্দর্য, তাতে চোখ আটকে যাবে যে কারও। সরু আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু আর পরিচ্ছন্ন পিচঢালা পথ ধরে যেতে যেতে যেন হারিয়ে যাবে সবুজে যে কেউ। শাল-গজারি, আম কাঠাল কিংবা আকাশমনির বাগান পেরিয়ে মকশবিল এলাকায় পা রাখলে চোখ আটকে যায় বেড়িবাঁধের দু’পাশের সারি সারি চরক জালে।

বড়ইবাড়ির এ স্থানটির একপাশে মকশবিল, অন্য পাশে বংশী নদী। দুইয়ে মিলে প্রকৃতির এক অপূর্ব মিশেল। সে কারণেই রোদের তেজ পড়তে শুরু করলেই আশপাশের এলাকার মানুষের পদচারণায় জায়গাটি মুখর হয়ে ওঠে। বিকাল হলেই বিলের মাঝখান দিয়ে বেড়িবাঁধের কয়েক কিলোমিটার এলাকায় দেখা যায় বিপুলসংখ্যক দর্শনার্থী। তারা মূলত আশপাশের এলাকার বাসিন্দা। বিকালের অবসরে প্রকৃতির কোলে কিছু সময় কাটাতেই তারা ছুটে আসেন। সৌন্দর্যে গাজীপুরের পুরো এলাকা অতুলনীয় হলেও এই বিলের সৌন্দর্যের মাত্রাটা একটু ভিন্ন। তাই দর্শনার্থীদেরও এই বিলের প্রতি আকর্ষণ একটু বেশিই।

আমরা যেহেতু দুপুরের আগেই চলে এসেছি তাই পুরো এলাকা প্রায় জনশূন্য। যে কারণে মাকে নিয়ে এক কোলাহল মুক্ত প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছি। বিলের জলে ভাসছে সবুজ কচুরিপানা। কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে দলবেঁধে ভাসছে পাতি-সরালি। বেশ কিছু পানকৌড়ি, বক এখানে-ওখানে বসে আছে। গাছের ছায়া ধরে মাকে নিয়ে হাঁটছি। মাকে জিজ্ঞেস করলাম- মা তুমি কি এখানে কিছু সময় বসতে চাও। মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। কালো পিচ ঢালা পথের পাশে গাছের ছায়ায় সবুজ শীতল ঘাসে মা বসলেন। আমিও মায়ের পাশে বসলাম।

সামনে খোলা জলরাশি ছুঁয়ে শীতল বাতাস আমাদের শান্ত করে পেছনে ছুটে যাচ্ছে। একটি রঙিন মাছরাঙা উড়ে এসে আমাদের সামনে চরকজালের বাঁশের খুঁটিতে বসলো। মাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মা জানো এই মাছরাঙাটির নাম কি? মা আমাকে উল্টো প্রশ্ন করলো- মাছরাঙা তো মাছরাঙাই, তার আবার আলাদা নাম আছে নাকি? আমি বললাম, মাছরাঙার অনেক প্রজাতি আছে। আর প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা নাম জানি। এই মাছরাটির নাম হলো ধলাগলা-মাছরাঙা। মাকে আরো বললাম, মা জানো- আগে বলা হতো এই মকশবিলে সারা বাংলাদেশের সব মানুষের একদিনের খাবার আহরণ করা যেত। আর এখন শিল্পকারখানার বর্জ্যের কারণে কোনো ফসলই নাকি হয় না।

মা কোনো কথা বললেন না। জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত চোখ দুটো মেলে দূরে স্থির তাকিয়ে রইলেন। মনে হলো তিনি কোনো এক স্মৃতিতে হারিয়ে গেছেন। কী ভাবছেন তিনি? আনন্দে বা কোনো কষ্টে মনটা কি হু হু করে কাঁদছে? নাকি জীবনের ক্লান্তি কিছুটা কমেছে? অনেক প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, এরকম একটি দিন তিনিও মনে মনে চেয়েছেন।