শিল্প ও সাহিত্য

হাসান আজিজুল হকের ভূমি ও ভূমিকা

ছোটগল্প লেখক হাসান আজিজুল হকের একেবারে সমান্তরালের একটি দিক হলো তিনি এদেশে সবচেয়ে বিশিষ্ট গদ্য-লেখকদেরও একজন, ‘প্রধানতম’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা তাঁকে লিখতে দেখি। যদিও গল্পের বাইরে এই গদ্য লেখার ঝোঁক আসলে তাঁর লেখালেখির দ্বিতীয় পর্যায়। প্রথম পর্যায়ে তাঁর প্রবন্ধগুলো লেখালেখির ইতিবৃত্ত এবং তাঁর কলাপরিণতির নানান দিকে নজর ফেলানো। সেসব লেখা থেকে আমরা দেখি তাঁর গল্প লেখার অন্যতম বিবেচনা হলো- বাস্তবতা নির্মাণ করা। এই বাস্তবতাটি কী ধরনের তা হাসানের পাঠক মাত্রই জানেন।

কায়েস আহমেদ তাঁকে বলেছিলেন, ‘ক্ষমাহীন বিশ্বের স্থপতি’। তাঁকে কেন এই অভিধা দেওয়া হলো সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট করে ওই লেখাটিতে তেমন কিছু বলা নেই, কারণ কায়েস ধরেই নেন, যারা হাসানের ‘শকুন’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘মারী’ প্রভৃতি গল্প পড়েছেন তাদের কাছে এটি ব্যাখ্যার দরকার পড়ে না। হাসানের গল্পে পশ্চিমবঙ্গের রুক্ষ রাঢ় ও বাংলাদেশের শ্যামল-পলির মিশেলে আলাদা গড়ন পাওয়া যায়। তাঁর আখ্যানমূলক গদ্যের বই ‘চালচিত্রের খুঁটিনাটি’ তাঁর মানুষ ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের এক অনবদ্য অভিজ্ঞান।

তাঁর গল্পে এবং এ-ধরনের গদ্যের বইয়ের সর্বত্রই নিসর্গ, আবহাওয়া, ঋতু বৈচিত্র্যর ভেতরে পটভূমি চরিত্রের আশপাশে অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। কেবল দেখাই দেয় না, তিনি প্রবল গরম যখন বর্ণনা করেন, তখন পাঠকের স্নায়ুর ভেতরে সেই গরমের অনুভূতি ঢুকিয়ে দিতে চান, তাঁর লেখা শীতকালের বর্ণনা পড়ে গরমকালেও পাঠক টের পান সেই শীতের ধরন। তাঁর গল্পে কেঁপে ওঠা গাছের পাতারা আলোতে কি অন্ধকারে কী রকম দোলা খায় বা আলোর প্রতিফলন ঘটায় চলচ্ছবির মতো দেখা যায়। এর প্রতিটি দিক তিনি নিয়ে আসতে চান অভিজ্ঞতার আলো ফেলে। নিজস্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া তিনি কোনো গল্প লেখন না-  বরাবরই এ কথা বলেছেন, কিন্তু হাসানের এই অভিজ্ঞতার ধরন সাধারণ মানুষের ‘অভিজ্ঞতা’ নয়। লেখকের অভিজ্ঞতা- যে অভিজ্ঞতা অনুভব ও মননের রসায়নে তৈরি। দেশভাগ থেকে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পালাবদল তাঁর লেখায় আঙুলের ছাপের মতো মিশে থাকে। এরই ফলে হয়ত, হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্পে সমাজবাস্তবতা-রাজনীতি আর সমকালের দাগ ও ক্ষতগুলো কেউ কেউ একটু বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এর আড়ালে গল্প নির্মাণে তাঁর কুশলতা, গদ্যে তাঁর কাঠোর নিয়ন্ত্রণ, সব মিলিয়ে যে জীবনবোধ ও সাহিত্যবোধের দেখা মেলে সেটি যেন কিছুটা হলেও আড়ালে পড়ে থাকে। 

এমনিতে আমাদের একটা বাতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরা যারা সাহিত্য পড়ি এবং পড়ে এর সমালোচনা করি, তাতে গল্পের; গল্পটার পরিপ্রেক্ষিত এবং তাতে থাকা নানান চরিত্রের কর্মকাণ্ড ধরে গল্পটির বিচার-বিবেচনা করি। তিনি কেন এই ধরনের একটি গল্প লিখলেন? কোথা থেকে এর বীজ এলো- এ দিকে আমাদের আগ্রহ যতটা, এর পরাগায়ণের দিকে ততটা নজর পড়ে না।

গল্পের শুরুরও একটা শুরু থাকে। সেই শুরুতে আমরা জানি প্রায় ক্ষেত্রে হাসান আজিজুল হক গল্পটির অনেকটাই তাঁর মস্তিষ্কে লিখে ফেলেন। লিখে ফেলেন একেবারে দাঁড়ি-কমাসহ। ফলে গল্প যখন লিখতে বসেন তখন গল্পটি তাঁর একেবারে জানা।

মনে পড়ে প্রায় বছর দশেক আগে, প্রেসক্লাবে তাঁকে দেওয়া এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে হাসান আজিজুল হক বলেছিলেন, দু’ধরনের লেখক আছেন; এক হলেন, ‘হেমিংওয়ে জাতে’র আর হলো ‘তলস্তয় জাতে’র। হেমিংওয়ে-জাতের লেখকরা যে-গল্পটা লিখবেন সেটি না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম এর পিছু ছাড়বেন না। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলে দেবেন, দিনের পর দিন ব্যয় করবেন; গল্পটি অন্যদিকে মোড় নিলেও সেদিকে যেতে দেবেন না। কারণ তিনি যেদিকে নিয়ে যেতে চান সেই পথেই গল্পটির গন্তব্যে পৌঁছুতে হবে, অন্যথা নয়। 

অন্যদিকে, তলস্তয়-জাতের লেখকরা যেটি লিখবেন বলে ঠিক করেন, লিখতে গিয়ে দেখেন, লেখা আরেক দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, লিখতে লিখতে যা লেখা হয়ে উঠল তা তার ভেবে রাখা গল্পটি নয়। বদলে গিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা মাত্রা পেয়ে গেছে। ফলে একটা গড়তে গিয়ে যেটি গড়লেন সেটি তার ভেবে রাখা বা ঠিক করে রাখা বা লিখতে চাওয়া লেখাটির চেয়ে অনেকটাই ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে নিয়েছে।

দেবেশ রায়ও অনেকটা এমনই লিখেছেন ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: নিরন্তর মানুষ’ প্রবন্ধগ্রন্থের একস্থানে: ‘‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গল্প বা উপন্যাস লেখার আগেই পড়তে পারতেন। আমার পড়াশুনোর মধ্যে প্রুস্ত ও দস্তেভ্স্কি তেমন পারতেন, কিন্তু বালজাক, তলস্তয়, ডিকেন্স, রবীন্দ্রনাথ, টমাস মান, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ লিখতে লিখতে পড়তে পারতেন।”

ফলে দেখা গেল দেবেশের সঙ্গে হাসানের এই বক্তব্য থেকে যে কোনো সচেতন পাঠক মিলটা ধরতে পারবেন যে, লেখার আগে ও পরের ফলাফল নিয়ে লেখকদের আসলে দুটো জাতে ফেলা হচ্ছে- এক যিনি গল্পটি জানেন, জানা গল্পটা তিনি স্রেফ কাগজে তুলে দেন, অন্যজন গল্পটি নির্মাণ করেন। পরের জনের কাছে একেবারে আগাগোড়ায় ধরতে পারা কোনো গল্প নেই, এবং তিনি তার লেখাটাকে গল্প করে তোলেন। শোনা যায়, সৈয়দ শামসুল হকও তাঁর করোটির ভেতরে পুরো গল্পটি সাজিয়ে তারপর লিখতে বসতেন। ফলে প্রথম খসড়ায় গল্পটা তৈরি হয়ে যেত।

গল্প তৈরির এমন নানান প্রক্রিয়ার কথা যদি ‘প্যারিস রিভিয়্যু’র সাক্ষাৎকারগুলোতে পড়ি; দেখি বেশির ভাগ গল্প লেখকই গল্প লিখতে বসে প্রথমে যে লেখাটা তৈরি করেন সেটি একটা জঙ্গুলে অবস্থা থাকে, তারপর কয়েকবার পুনর্লিখনের ভেতর দিয়ে সেটি গল্প হয়ে ওঠে। ফ্লবেয়ারের ‘তিনটি গল্প’ নামের বইটির প্রথম গল্পের প্রথম পৃষ্ঠাটি তিনি আঠারো বার খসড়া করেছিলেন। হাসান আজিজুল হকের বেলায় এই খসড়ার অংশ আদতে তাঁর মস্তিষ্কেই ঘটে বলে আমরা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে জেনেছি। ফলে প্রবল একটা স্নায়ুবিক চাপের ভেতর থেকে তাঁর গল্প তৈরি হয়। প্রতিটি বাক্য ছায়া থেকে কায়ায় আসতে যে-রাসায়নিক বিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে আসে, সেখানেই থাকে গল্প লেখকের লেখার আসল রহস্য। কিন্তু রহস্যের চেয়ে তিনি সেটি পরিষ্কার করে বলে দেন তার লেখার প্রক্রিয়াটি। তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধের ভেতরে, তাঁর প্রদত্ত বিপুল পরিমাণ সাক্ষাৎকারের নানান জায়গায় এর সমর্থনও আছে।

প্রশ্ন জাগতে পারে- বাংলা ছোটগল্পে হাসানের ভূমিকা কী? এই প্রশ্নের উত্তরেই বোধ করি হাসানের দিকে যাওয়ার কৌশলটি আমরা বের করতে পারি। এবং দেখি তাঁর ছোটগল্পগুলোর বেশ কিছু গল্প আকারে নভেলা বা ছোটখাটো উপন্যাসের সমান। শব্দ সংখ্যার পরিমাণেই নয়, ঘননিবদ্ধ বুনন এবং এর বিস্তার ও সূক্ষ্মতার দিকগুলো দেখে মনেই হয়- এ হলো আসলে ঔপন্যাসিকের ছোটগল্প লেখা। এবং বহু আগেই হাসান নিজের মুখে তা-ই স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কায়েস বলেছিলেন, হাসান গল্প লিখলেও তাঁর দৃষ্টি ঔপন্যাসিকের। হাসানও মেনে নেন, ‘‘আসলে আমি চেয়েছিলাম ঔপন্যাসিক হতে, হয়ে গেলাম গল্পকার। আমার প্রথম রচনা কিন্তু গল্প নয়, একটি উপন্যাস। ম্যাট্রিক পাস করার পরই লেখা, মাটি ও মানুষ, অপুর মতো একটি চরিত্র এতে প্রধান, ‘পথের পাঁচালী’র প্রভাব অত্যন্ত প্রকট ছিল তাতে।’’

এ তো গেল তাঁর ধাঁতের একটি দিক, অন্যদিকে হাসান হলেন বিভূতির নিসর্গ, মানিকের ক্রুর দৃষ্টি আর তারাশঙ্করের ইতিহাস-দেশ পটভূমির নানান বীক্ষায় সমৃদ্ধ একজন লেখক। আদতে তিনি তো এঁদেরই এক উত্তরসূরি, কিন্তু এর সঙ্গে যোগ করতে হয়, তিনি দর্শনের অধ্যাপনার সূত্রে এবং মার্ক্সবাদী বিশ্ববীক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনে দেখা কোনো ছকে বাঁধা পথের পথিক নন। তিনি ‘মন তার শঙ্খিনী’ যেমন লেখেন, তেমনি লেখেন ‘সারাদুপুর’র মতো গল্প বা লেখেন ‘খনন’ বা ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’র মতো গল্প। আবার ‘আমৃত্যু আজীবন’ বা ‘জীবন ঘষে আগুন’-এ যে হাসান তার চেহারা প্রায় অন্য। কিন্তু সর্বত্রই একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, হাসানের গল্পে জীবনের নেতিবাচকতাই প্রধান। নির্মমতার নৈর্ব্যক্তিক চোখ নিয়ে তিনি চরিত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। জীবনের নিশ্চয়ই আরো অনেক দিক আছে কিন্তু তিনি তাঁর আতস কাচটি ধরেন সমাজে থাকা ব্যক্তি ও তাদের নানান অসঙ্গতি ও বৈপরীত্যের ওপর।

হাসি-ঠাট্টার গল্প, আমোদে ভরা প্রেমের গল্প বা রহস্যে ঠাসা ঠাসবুনোট গল্প যারা লেখেন বা পড়তে চান তাদের হাসানের কাছ থেকে ব্যর্থমনোরথে ফিরে যেতে হবে। আর তাঁর দিকে যারা যেতে চান তাদের পার হয়ে আসতে হবে বাংলা ছোটগল্পের মূল পরম্পরা, যার শুরু রবীন্দ্রনাথে এবং পরবর্তীকালে বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক-জগদীশ গুপ্ত প্রমুখের হাতে ঘটেছে এর নানা বর্ণিল হীরকদ্যুতিময় বিচ্ছুরণ। হাসানের গল্প সেই হীরকের আলো ও বিচ্ছুরণের সঙ্গে তার ধার নিয়ে একইমাত্রায় উপস্থিত।

গল্প লিখতে হলে কী করে প্রতিটি শব্দের ওপর নিয়ন্ত্রণ, প্রতিটি যতি চিহ্নর সচেতন ব্যবহার এবং সর্বোপরি পরিস্থিতি অনুযায়ী ভাষা বিন্যাসের দিকগুলোতে যারা নজর দিতে পারেন, তারা হাসানের গল্পের দিকে গেলে তাদের পাঠ নামের ভ্রমণটি তারা ‘রোমাঞ্চকর অভিযান’ হিসেবে দেখতে পাবেন। সেই পাঠক প্রতিপদে এক তীক্ষ্ম-তীব্র-কঠোরতার তলে হাসানের মমতাময় দৃষ্টি চিনতে ভুল করবেন না। তারাই আসলে হাসানের পাঠক। এর বাইরে যারা- তাদের বোধকরি হাসানের দিকে না যাওয়াই উত্তম।