শিল্প ও সাহিত্য

শেষ দৃশ্য নামার আগে

শীতের এক সকালে, ঘড়ির কাঁটা দশের ঘর পেরিয়েছে কিন্তু সূর্যের দেখা নেই; চোখের সামনে ঘষা কাঁচ ঝুলছে- এমনই কুয়াশা চারদিকে, চাদর গায়ে বারান্দায় বসে সে খবরের কাগজে চোখ রেখেছে, পাশেই চায়ের কাপ; চায়ে চুমুক দিতে দিতে তার মনে হয়, পারুলের সঙ্গে সম্পর্কটা বেশিদিন টিকবে না।

সংসারে বিচ্ছেদের করুণ সুর বেজে উঠেছে আর তাতে দুজনই সুর মিলিয়েছে, ব্যাপারটা এমন নয়। কিন্তু কোথাও একটা ভাঙন শুরু হয়েছে, সে বুঝতে পারে। যে কোনো মুহূর্তে সম্পর্কের সুতো ছিড়ে আলগা হয়ে যাবে। কখন ঘটবে এবং কীভাবে, কেবল সেটাই জানা নেই।    শেষবার তারা যখন বাড়ি বদলায়, তিনমাস আগে, বিয়ের পর এ নিয়ে কয়েকবার; তখনই একরকম বুঝে গিয়েছিল রাসেল- আজ হোক কাল হোক, সম্পর্কটা খসে যাবে।  

সকালবেলা। ঘুমের মধ্যেই রাসেল টের পায়, একটা খুশবু ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে। এরপর খুট করে কোনো কিছুর পতনের শব্দ হয়। ঘুমটা আলগা হয়ে আসে। সে চোখ খোলে না। ঘুমের রেশটুকু ধরে রেখে পাশ ফিরে শোবার ছলে একবার চোখ মেলে তাকায়। দেখে, পারুল ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে আছে। স্নান সেরে তৈরি হচ্ছে। তার মানে সকাল হয়ে গেছে। রাসেল বেশি রাত করে ঘুমিয়েছে বলে সকাল হওয়াটা টের পায়নি। কোলবালিশটা বুকে চেপে সে আবার ঘুমের আয়োজন করে। পারুল অফিসে বেরুনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় কাজের বুয়া ঘরে আসে- ‘আপা, এই যে আপনার দুধ চা, চিনি ছাড়া।’ বুয়াটার বয়স কম। বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু কোনো অদৃশ্য কারণে সংসার টেকেনি। বয়স্ক কাজের মহিলা না রেখে কেন কমবয়সী একটা মেয়েকে পারুল ধরে এনেছে, কে জানে?

সুযোগ পেলেই রাসেল ফোনে কার সঙ্গে কথা বলে, পারুল আড়ি পেতে শোনে। ফেসবুকেও তীক্ষ্ম নজর রাখে; কোন মেয়ে রাসেলের পোস্ট ফলো করে, নিয়মিত লাইক ও কমেন্ট দেয়; ইনবক্সে তাদের কাউকে নক করে শুধায় পর্যন্ত- ‘রাসেল চৌধুরীর সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক? কতদিন?’ ইত্যাদি। পারুল সরাসরি রাসেলকে সন্দেহ করে না ঠিক, আবার করেও। আর চোখে চোখে রাখে। সুযোগ পেলে রাসেলও খোঁচা দিতে ছাড়ে না। একসঙ্গে খেতে বসেছে, খাওয়ার টেবিলে লেবু নেই; সে বউকে বলে, ‘তোমার কচি বুয়াকে বলো না, একটু লেবু কেটে দিতে।’ পারুল রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলে। এখন আর শুয়ে থাকা সমীচীন হবে না। পারুল কথা শোনাবে। সে চায়ে চুমুক দিয়ে একবার রাসেলের দিকে তাকায়। কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রাসেল বলে, ‘বেরুচ্ছ নাকি?’ ‘হুম।’ ‘পাঁচশ টাকা রেখে যেও।’ পারুল না তাকিয়েই বলে, ‘কী করবে?’ ‘দুপুরের লাঞ্চে টাকাটা তেলে ভেজে খাব।’ পারুল আবার চায়ে চুমুক দেয়। সে হাসে না। তাকায়ও না। পেছন ফিরে থাকায় ওর মুখের অভিব্যক্তি কেমন হলো রাসেল দেখতে পায় না। হাতঘড়িটা পরে পারুল হ্যান্ডব্যাগ কাঁধে রাখতে রাখতে বলে, ‘মরার মতো সকালবেলায় পড়ে পড়ে ঘুমাও কেন, বলো তো? সাড়ে নটা বাজে।’ তখনই রাসেলের মনে পড়ে, কোথায় যেন শুনেছিল সে কথাটা; স্বামীকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য স্ত্রী এমনই একটা কথা বলে। আর তখন স্বামী বেচারা ঘুমের মধ্যেই পাশ ফিরে সঙ্গে সঙ্গে বলে- ‘আমি কি রাস্তায় জল দেব যে সকাল সকাল উঠতে হবে?’

প্যান্ডামিকের কারণে রাসেল একরকম চাকরি হারিয়েছে। ছয়মাস ধরে বেকার। হাতে কোনো পয়সা নেই। সকাল সকাল পারুলকে রাগিয়ে দেওয়া উচিৎ নয়। সে গলার স্বর নরম করে বলে, ‘কী করব, বলো? চাকরি নেই। সময়টাও মন্দ।’  পারুল প্রায় তেড়ে আসে- ‘তাই বলে অলসের ঢেকি হয়ে শুয়ে থাকাটা কি ভালো?’ রাসেল আত্মপক্ষ সমর্থন করে- ‘যত দোষ এই সময়টার, বুঝলে তো। কী এক করোনা এলো পৃথিবীতে, জীবনের সব হিসেব রাতারাতি পাল্টে দিল। মানুষ বাইরে থেকে ঘরে ফিরলো ঠিকই, কিন্তু অনিশ্চয়তা সারাক্ষণ পাশে পাশে হাঁটছে। কে কখন চলে যায়, ঠিক নেই।’ পারুল কিছু বলে না। শুধু কপাল কুঞ্চিত করে একবার তাকায়।  রাসেল কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলে, ‘করোনা না এলে কি আমি চাকরিহীন হয়ে পড়তাম, বলো? সকালে অফিসে না বেরিয়ে শুয়ে থাকতাম?’  পারুলের দেরি হয়ে যাচ্ছিল। সে বলে, ‘হয়েছে বাবা। এবার ওঠো। নাসতা করে ফুলের গাছগুলোতে পানি দেবে। লণ্ড্রি থেকে কাপড় এনে রেখো। আর সম্ভব হলে কিছু কাঁচাবাজার করে এনো। স্লিপ ও টাকা টেবিলে রাখা আছে। আমি বেরোলাম। আর এই যে তোমার পাঁচশ টাকা- বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

পারুল বেরিয়ে যেতেই ঘরের দখল নেয় একরাশ নিস্তব্ধতা। রাসেল আবারও ঘুমানোর আশায় আরাম করে বিছানায় হাত-পা ছেড়ে দেয়। ঘুম আর আসে না। শুয়ে শুয়েই নানা কথা মনে আসে। সে একটা সিগারেট খাওয়ার কথা ভাবে। ঘরে সিগারেট খাওয়াটা পারুল পছন্দ করে না। পারুল তো সন্ধ্যা ছটার আগে বাসায় ফিরছে না। গুলি মারো পারুলকে। সারাটা দিন কেবল আমার। এখন আমি যা খুশি করতে পারি। ভাবে সে। হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট পেলেও দেশলাইটা সে খুঁজে পায় না। বুয়া ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়-‘মামা, আপনার কিছু লাগবে?’ মুহূর্তেই মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে যায় রাসেলের। কাজের বুয়াটা পারুলকে ডাকে আপা আর রাসেলকে মামা। কী এর রহস্য, কে শুধাবে? বিছানা ছেড়ে রাসেল আড়মোড়া ভাঙে। একটা হাই তোলে। ‘মামা, আমি তাইলে যাই?’ রাসেল মুখটা কঠিন করে বলে, ‘আমার কিছু লাগবে না আপা। আপনি যেতে পারেন। আপনি যান। এখনই যান। বিদেয় হন।’ বুয়া মুখে হাসি চেপে চলে যায়|

রাসেল আবার নিজের মধ্যে ফিরে আসে। হাতে একদমই কাজ নেই। কী করা যায়? সত্যিকার অর্থেই একটা খারাপ সময় যাচ্ছে। কোথাও বেরিয়ে শান্তি নেই। বাইরে না বেরুলে চলবে না- এমন মানুষ ছাড়া আর-সব মানুষ এখন নিজের ডেরা ও গুহায় লুকিয়ে থাকে। কোথাও মন খুলে আড্ডাও দেওয়া যায় না।  এসব ভাবতে ভাবতে সে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। বাথরুম এক রহস্যময় জায়গা। অনেক সূত্র ও ভাবনার জট খুলে যায় বাথরুমে এসে। ঠিক তখনই কথাটা মাথায় আসে রাসেলের- ‘আমার আসলে মুক্তি দরকার।’ মুক্তি পারুলও চায়। এটা সে নানা কথা ও আচরণে বুঝিয়েও দিয়েছে। রাসেলের গত জন্মদিনের কথাই ধরা যাক। জন্মদিন নিয়ে তার কোনো আলাদা বিবেচনা নেই। বরং নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকতেই ভালোলাগে। জন্মদিনে রাসেল ও পারুল বাসাতেই ছিল। পারুল বলল, ‘জন্মদিনে কী গিফট নেবে?’  ‘কিছু নেব না।’  ‘তাই বললে হয়? বলো, কী নেবে?’ ‘তাহলে একটু পায়েস রান্না করো। পোলাও মাংশ করতে পারো। না, থাক। পোলাও খেলে গ্যাস হয়।’ ‘তাহলে?’ ‘সাদা ভাত ও মুরগির রোস্ট করো।’ পারুল হাসিমুখে পায়েস ও মুরগি রান্না করতে চলে যায়। সকালে একবার পারুলকে জানিয়েছিল রাসেল, দুপুরে আবার বলল, ‘দেখো, আমার একটা নিমন্ত্রণ আছে। দুপুরে একজন আমাকে খাওয়াতে চায়।’  ‘সারাদিন যদি বাইরেই কাটিয়ে দাও, পায়েস করে কী হবে?’ ‘না না, দেরি করব না। দুপুরে খেয়েই বাসায় চলে আসব।’ ‘আচ্ছা।’ পারুল হাসিমুখেই সম্মতি দেয়। রাসেল পাঞ্জাবি ও মুখে মাস্ক পরে বেরিয়ে পড়ে। শাহবাগে একটা শপিংমলে যায়। জন্মদিন উপলক্ষে বন্ধুটি কেক এনেছে; কয়েকটি গোলাপ ও অঞ্জন দত্তের আত্মকথনের বই ‘অঞ্জনযাত্রা’।  উপহার পেয়ে রাসেলের খুব ভালোলাগে। এরমধ্যে অন্য একজন বন্ধু ইনবক্সে জানায়, জন্মদিনে সে দেখা করতে চায়। সাধারণত দেখা হয় না। ফেসবুকেই কুশল বিনিময় চলে। রাসেল না করতে পারে না।  কেক কাটার সময় কিছু ছবি তোলা হয়। পরে তারা খেতে যায় এলিফ্যান্ট রোডের স্টার হোটেলে। কীভাবে যেন একটা ছবি ফেসবুকের ‘ইওর স্টোরি’তে চলে যায়। রাসেল জানতেও পারে না।  বাসা থেকে পারুল টেক্সট পাঠায়: ‘রাতের খাবারটাও খেয়ে এসো।’  পারুল কেন এমন কথা লিখল? রাসেল কিছুই বুঝতে পারে না।

বিকেলে রাসেল যখন বাসায় ফিরে এলো, পারুলের শীতল ব্যবহার তাকে অবাক ও বিব্রত করে। সে খুব একটা কথা বলে না। চোখের পলকে পারুল জামাকাপড় ও ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। সে বাপের বাড়ি চলে যাবে জানায়। রাসেলের খাওয়াটা বেশি হয়ে গিয়েছিল। অস্বস্তি লাগছে। সে পারুলকে জোর করার স্পৃহা পায় না। কিছুক্ষণ পর, দড়াম শব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে পারুল শুধু বলে, ‘তোমার সঙ্গে অনেক মেয়ের সম্পর্ক আছে। আজ সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। তুমি তাদের নিয়েই থাকো। আমার সঙ্গে কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না।’ রাসেল কোনো কিছু বলার সুযোগ পায় না। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে পারুল সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত পায়ে নেমে যায়।  নগরজীবনের এই এক সুবিধা, হয়ত অসুবিধাও। ওপরতলা-নিচতলা, এমনকি পাশের ফ্ল্যাটের মানুষও জানতে পারে না, দরজার ওপাশের মানুষ কেমন আছে, কী হচ্ছে ওদের সংসারে? দূরাগত ধ্বনির মতো প্রেম নাকি খুনের শব্দ ভেসে এলো, বোঝা যায় না। মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতি নিয়ে রাগে-দুঃখে খুব কাতর লাগে রাসেলের। সে হতভম্ব হয়ে খানিক দাঁড়িয়ে থাকে। আরও কিছুক্ষণ পর হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সেই পারুল, পরে ক্ষমা চেয়ে, ভুল ও বিভ্রম স্বীকার করে রাসেল তাকে বাসায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

দীর্ঘ সময় কাটিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে রাসেল একবার ছেলেকে ডাকে-‘রিফাত!’ কেউ সাড়া দেয় না।  রাসেলের কথা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। আর তখনই তার মনে পড়ে, ছেলে তো বাসায় নেই।  ছেলেটা থাকে রাসেলের মায়ের কাছে। এতটুকু বাচ্চা নিজের মায়ের কাছে না থেকে কেন সে দাদির কাছে থাকে, সেও এক রহস্য।  সারাবছর শহরেই থাকে রাসেল। গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হয় কালেভদ্রে। শেষবার যখন গ্রামে যায়, ফেরার সময় বাচ্চাটা গোঁ ধরে, সে ফিরবে না। দাদির সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে থাকবে। দাদিও খুব স্নেহ করে নাতিকে। সে দাদির সঙ্গে খায়, রাতে একসঙ্গে ঘুমায়। নাতি তো নিজের ছেলেরই রক্ত, তাই মায়া এড়ানো যায় না।  পারুল এত করে বোঝালো, আদর করে ছেলেকে কোলে নিয়ে খাওয়ালো, জামা-কাপড় পরিয়ে দিল; তবু কাজ হলো না। রিফাতকে কিছুতেই সঙ্গে করে আনা গেল না। এখন ছেলের স্কুল বন্ধ, পড়াশোনার চাপ নেই। সে জন্য পারুল বা রাসেল কেউই আর আপত্তি করেনি।  পিতৃস্নেহ ও মায়া জিনিসটা পাশে সরিয়ে রাখলে এতে অবশ্য একরকম সুবিধাই হয়েছে। পারুলও ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে। তার হয়ত কিছুটা আরামও হয়েছে। রোজই তো ফোনে কথা হচ্ছে। ভিডিও কলে মা-ছেলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকছে। এসব দৃশ্য দেখে রাসেলের ভালোই লাগে। পারুল মেয়েটা অন্যরকম। শান্ত ও জেদি। আবার হঠাৎই অচেনা। তাকে দেখে অবশ্য চট করে আন্দাজ করা যায় না, তার একটি সন্তান আছে। শরীরের বাঁক ও চোখের তারা দেখে পারুল বিবাহিত কিনা সেটাও অনুমান করা শক্ত। এমনকি মাঝে মাঝে রাসেলের বিভ্রম হয়, পারুল যেন অন্য জগতের কেউ। এত কাছের, তবুও সে যেন দূরের কোনো মানুষ। তার নিজের জীবন, এমনকি সংসারের প্রতি যতটা মনোযোগ তারচেয়ে বেশি চোখ থাকে রাসেল কী করে ও করে না, সেদিকে।

দুজনের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার সম্ভাব্য একটা কারণ হতে পারে, ব্যক্তিত্বের সংঘাত। পারুল সবকিছুতে মতামত দেয়, যেন সে সবকিছু জানে এবং কখনো সবচেয়ে বেশি জানে। এতে তার ভুল হয়, সে খেয়াল করে না। রাসেল শুধরে দেয়, কখনো ভুলও ধরে। পারুল শোধরায় না। সে ভুল ধরাও পছন্দ করে না এবং বিরক্ত হয়। চাকরিজীবি মেয়েদের একধরনের ভাব ও ভনিতা থাকে, তারা প্রবল আত্মবিশ্বাস সঙ্গে করে চলে। সামান্য অবহেলা ও সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। বউ হিসেবে মেয়েটা এমনিতে ভালো, বন্ধু মনোভাবাপন্ন এবং খোলা মনের। রাসেলকে সে নানাভাবে সুখ দেয়, সেবা করে এবং মায়ায় ভরিয়ে রাখে। কখনো অভুক্ত রাখে না। বুয়া দিনের পর দিন কামাই করলেও সে ঠিকই রান্না করে, ঘরদোর ও জামাকাপড় পরিষ্কার করে। চাকরিজীবি মেয়ে, তারও কষ্ট হয়, রাসেল বুঝতে পারে। কিন্তু রাগ করে সে ধর্মঘট ডাকে না, মুখ ভারি করেও রাখে না। 

কিন্তু সামান্যতর কোনো কথা ও ইশারায় তার ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগলে, সহ্য করে না। কোনো মেয়ের প্রতি সজ্ঞানে এমনকি ঘুমের মধ্যেও যদি রাসেলের নরম চোখ দেখতে পায়, সে রেগে আগুন হয়ে যায়। তখন পারুলকে কিছুতেই চেনা যায় না, থামানোও যায় না। বিয়ের আগে সম্ভাব্য দম্পতির চোখে ও মনে তুমুল প্রেম আর মায়া থাকে। বিয়ের পর সেই প্রেম-মায়া বদলে যায়, কমেও যায়। একসময় প্রেম ও মায়া ফুরিয়ে আসে। প্রেমটা হয়ত সংসারের জিনিসপত্রের ভেতরে ঢুকে পড়ে। হৃদয়ের গভীর সংবেদন দিয়ে দুজন দুজনকে অনুভব করার মন কমই টিকে থাকে। রাসেল ও পারুলের বেলায় কথাগুলো সত্যিকারভাবে খাটে।

কিছুদিন আগে, রাতে ওরা একসঙ্গে খেতে বসেছে। তাদের পাশে একমাত্র সন্তান রিফাত। খেতে বসে আচমকা পারুল বলল, ‘তুমি আবার অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছ, না?’ পারুলের এই এক স্বভাব। গায়েবি হামলা ও মামলার মতো ফস করে অভিযোগ করে বসে। কিন্তু কেন সে কথাটা বলল, কী তার সূত্র, তা খোলাসা করে না। কখনো হঠাৎ সে কথা বন্ধ করে দেয়। নাকের ডগায় ও চোখের সামনে একটা জ্যান্ত মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, তবু কথা বলছে না; ভারি অস্বস্তি হয় রাসেলের।  রাসেল কিছুই বলে না। সে খাওয়া থামিয়ে মূর্তির মতো বসে থাকে। পারুল চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘এভাবে কোনো সম্পর্ক টিকতে পারে না। আমি ডিভোর্স চাই।’  ছেলেটা পাশে বসে খাচ্ছিল। সে এখন ক্লাস টুয়ে পড়ে। অনেক কিছুই বোঝে না, কিন্তু কৌতূহল আছে তার। সে বলল, ‘ডিভোর্স হলে কী হয়, মা?’ রাসেল বিব্রত ভঙ্গিতে হাসে। ছেলের মাথায় হাত রেখে বলে, ‘ও কিছু নয়, বাবা। তুমি খাও।’  পারুল মুখ শক্ত করে বলে, ‘তুমি একটা কুত্তা।’ রাসেল বিস্মিত-‘কী বললে তুমি?’ ‘বলেছি, তুমি একটা কুত্তা। শুধু শুঁকে বেড়াও।’ ‘আমি তো মদ খাই না, মাতালও নই। কেন শুঁকে বেড়াব?’ ‘মদ খাসনি কোনোদিন, না? বেশ, তাহলে আজ থেকেই শুরু কর।’ ‘তুই তোকারি করছ কেন? ভাষা ঠিক করো।’ ‘তুই তোর স্বভাব আগে ঠিক কর।’ ‘তোমাকে একটা কথা বলি পারুল, যে কোনো সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পেছনে তোমরা মেয়েরাই দায়ী।’ পারুল চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে ওঠে-‘কী বললে তুমি?’  ‘সম্পর্ক ও সংসার ভেঙে যাওয়ার পেছনে মেয়েদের সন্দেহবাতিক মন আর ঘ্যানঘ্যানই দায়ী। আর দিনের পর দিন তুমি তাই করে চলেছ। এসব ঠিক নয়।’   পারুল আর চেয়ারে বসে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে থাকে।  রিফাত হি হি করে হেসে ওঠে। ‘মা, বাবাকে তুমি কুত্তা বললে কেন? বাবার তো লেজ নেই।’  পারুল কী ভেবে এবং কেন কথাগুলো বলল, রাসেল কিছুই বুঝতে পারে না। খাওয়াটা সে কেবল শুরু করেছে, তখনই এই ঝড়। সে হাতধুয়ে উঠে পড়ে। পারুল ফিরেও দেখে না।

পারুল মেয়েটা এমন। অন্য মেয়েদের মতো সে বলে না ‘তোমার সংসারে এসে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল’ বা ‘আমি বলেই তোমার সংসার করে গেলাম, অন্য কোনো মেয়ে হলে কবেই উড়ে যেত।’ কিন্তু সে ফস করে এমন কথা বলে, যা এর থেকেও শক্ত।  রাতে ওভাবেই ঘুমিয়ে যায় রাসেল। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙার পর, পারুল একদম স্বাভাবিক। সে এমন ব্যবহার করতে লাগলো যেন রাতে কিছুই ঘটেনি।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে তোয়ালেতে হাতমুখ মুছে রাসেল খাওয়ার টেবিলে আসে। একা একা নাস্তার টেবিলে বসে মনে পড়ে, পারুলের অন্য একটি নাম আছে, রেখা। এখন আর ওই নামে সে ডাকে না। কিন্তু বিয়ের আগে যখন সম্পর্কটা কেবল গভীর হতে শুরু করেছে, পারুলের সঙ্গে দেখা হলেই সে কয়েকটি শব্দ মেলাতো: ‘রেখা ও রেখা, জবসে তুম দেখা।’ এটুকু শুনেই পারুল উচ্ছ্বসিত হয়ে মিষ্টি করে হাসতো। সেসব রঙিন দিন কবেই হারিয়ে গেছে।  শুকনো রুটি ও ডিমের ওমলেটে কামড় দিয়ে রাসেলের মনে হয়, একটা রসগোল্লা খেতে পারলে ভালো হতো। ফ্রিজ খুলে দেখলো, একটাও মিষ্টি নেই। রসমালাইয়ের বাটি দেখে তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু বাটি খুলেই সে হতাশ হয়। ওটা রসমালাই নয়, টকদই। সে খাবার টেবিলে ফিরে আসে। রুটি ও ডিমভাজি খেতে খেতে এখন সেই কথাগুলোই উল্টো করে বলতে ইচ্ছে করে:  ‘খারে ও খারে, যা রে তুই যা রে।’ সংসারে ‘যাহ’ বললেই কেউ কেউ যায়, সবাই যায় না। যেতে বলায় কেউ ঘাড় বাঁকিয়ে বলে ওঠে, ‘তুই যা।’ রাসেল যখন বাসায় থাকে না, রাগ ও ঝাল মেটাতে রাসেলের শার্ট-প্যান্ট বারান্দার দড়িতে ঝুলিয়ে কাঁচা কঞ্চি দিয়ে পারুল পেটায় কিনা কে জানে। কী সব কথা ভাবছি; বলে আপন মনেই সে হেসে ওঠে।

নাস্তা শেষ করে রাসেল বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সিগারেট ধরায়। এমন সময় বাঁশির সুর কানে আসে। কাছাকাছি কোথাও বাঁশি বাজাচ্ছে কেউ। সুরটা বেশ মায়াবী। বাসার খানিক দূরেই ট্রেনলাইন। অসময়ে একটা ট্রেন হুইসেল বাজিয়ে দানবীয় শব্দ করে যেতে থাকে। বাঁশির সুরের মাধুরী ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে রাসেল একবার বাইরে বেরোনোর কথা ভাবে। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়?

দুপুরের পর বাসা থেকে বেরিয়ে রমনা পার্কে এসে ঢোকে রাসেল। অনেকদিন পরে সে এখানে এলো। সবুজ ও স্নিগ্ধ প্রকৃতির ভেতর দিয়ে হাঁটতে তার ভালোলাগে। কিছুক্ষণ হেঁটে ‘অস্তাচল’ গেট দিয়ে বেরিয়ে শাহবাগে চলে আসে। শাহবাগে এখন প্রাণ নেই। পরিচিত কোনো মুখও দেখতে পায় না। একসময় এখানে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মানুষ আড্ডা দিতো। চা-সিগারেট-ফুসকা-দই-মিষ্টির দোকান এবং অবসর খোঁজা মানুষে মুখর থাকতো জাদুঘরের সামনের অংশ। এখন কেমন ম্রিয়মান মাঠের মতো পড়ে থাকে, অনাথ।

শাহবাগ থেকে হেঁটে রাসেল আজিজ সুপার মার্কেটে চলে আসে। পথের পাশে ‘ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ দেখে ঢুকে পড়ে। দুটো মিষ্টির অর্ডার দেয়। গপগপ করে মিষ্টি খেতে খেতে ভাবে, আহা, কতদিন পর মিষ্টি খেলাম। মিষ্টান্ন খেতে সে খুব পছন্দ করে। কয়েকদিন না খেতে পেলে মনে হয়, কতদিন খাওয়া হয়নি। মিষ্টির বিল মিটিয়ে রাসেল তক্ষশিলায় ঢোকে। এটা একটা বইয়ের দোকান। খুব ছোট, কিন্তু এদের সংগ্রহ ভালো। দোকানভর্তি কলকাতার বই। এরা বাংলাদেশের বই খুব একটা রাখে না। আগে সে নিয়মিত আসতো। এখন আসা হয় না।   একসময় কবিতা লেখার বাতিক ছিল রাসেলের। পত্রিকায় তার কবিতা প্রায়ই ছাপা হতো, একুশে বইমেলায় গোটা তিনেক বইও বেরিয়েছে। এখন উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। তবু চোরাগোপ্তাভাবে একটা টান রয়ে গেছে। মাসে দুএকদিন বইয়ের দোকানে ঢু না দিলে আর দুএকটা বই না কিনলে বুকের কোথাও খালি খালি লাগে।  জয় গোস্বামীর ‘পাগলী তোমার সঙ্গে’ বইটা কিনে হাঁটতে হাঁটতে রাসেল টিএসসিতে চলে আসে। গুড়ের চা খেতে খেতে একটা সিগারেট ধরায়।  দ্বিতীয় সিগারেটটা ধরিয়ে টিএসসি লাগোয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে পড়ে। না, এখানেও ভালোলাগে না। পরিচিত কোনো মুখ দেখতে পায় না। চারপাশটা কেমন নিষ্প্র্রভ মনে হয়। কী সব উন্নয়নের কাজ চলছে। উদ্যানের চারপাশ ঘেরা। সে ছবিরহাটের গেট দিয়ে বেরিয়ে আবারও শাহবাগ মোড়ে চলে আসে। 

শীতকালের বেলা সস্তা মোমবাতির মতোন ফুরিয়ে আসে। শাহবাগ থেকে রিকশায় চেপে রাসেল কারওয়ান বাজারে চলে আসে। প্রথম আলোর নিচেই অরুণাভের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। অরুণাভ কথা ও সময় বেশি খরচ করে না। পকেট থেকে টাকাটা বের করে রাসেলের হাতে দেয়। পঞ্চাশ হাজার টাকা। কী একটা কাজে নিয়েছিল, সময়মতো শোধ দিতে পারেনি। আজ দিয়ে দিল।  রাসেল আর দাঁড়ায় না। সোজা বাসার দিকে হাঁটতে থাকে।

লণ্ড্রি থেকে কাপড় নিয়ে, কাঁচাবাজার করে রাসেল বাসায় ফেরে। হাতমুখ ধুয়ে এককাপ চা খায়। শরীরে আলস্য ভর করে। সে আরাম করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মাথায় কত যে ভাবনা এসে জড়ো হয়। এভাবে কতক্ষণ কেটেছে সে জানে না। খানিক তন্দ্রার মতো এসেছিল। সন্ধ্যার মুখে বাসায় ফেরে পারুল। অসময়ে রাসেলকে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। আর্তচোখে নরম করে স্বামীর কপালে হাত রাখে-‘কী হয়েছে তোমার?’ রাসেল আড়মোড়া ভেঙে বিছানায় বসে-‘কিছু হয়নি।’ ‘অন্ধকারে শুয়ে ছিলে কেন? রাসেল নিঃশব্দে বসে থাকে। কোনো কথা বলে না। ‘সে কী, তুমি সারাদিন বাসাতেই ছিলে?’ ‘হুম।’ ‘বাইরে বেরোওনি?’ ‘না।’ হাতঘড়ি ও চশমা খুলতে খুলতে পারুলের চোখ পড়ে টেবিলে রাখা কাপড়গুলোর দিকে-‘এগুলো তো লণ্ড্রিতে ছিল, কে নিয়ে এলো?’ সে রান্নাঘরে যায়, দেখে ব্যাগভর্তি কাঁচাবাজার। পারুল ঘরে ফিরে আসে-‘তুমি সত্যি বের হওনি? তাহলে এগুলো কে নিয়ে এলো?’ ‘জানি না তো।’ ‘তুমি একটা ইয়ে, বুঝলে’; বলেই হাসতে হাসতে পারুল অন্যঘরে চলে যায়।

আর একদিন। পারুল বলল, ‘তোমার হাতে একটু সময় হবে?’ রাসেল হাতের তালুতে ভালো করে তাকিয়ে বলল, ‘হাতে তো কোনো সময় নেই।’  ‘ঠাট্টা করো না। তুমি আমার সঙ্গে যাবে কিনা বলো।’ ‘কোথায়?’ ‘একটু নিউমার্কেটে যেতে চাই। আমার কিছু আন্ডার গার্মেন্টস কেনা লাগবে। তুমি সঙ্গে গেলে ভালো হয়।’  ‘আমি বেকার মানুষ। হাতে তেমন কাজও নেই, যেতে পারি। ‘তাহলে চলো।’ পারুলকে সঙ্গে নিয়ে রাসেল নিউমার্কেটে যায়। কেনাকাটা শেষ হলে পারুল বলে, ‘দই ফুসকা খাব।’  পরে ওরা একটা ফাস্টফুডের দোকানে ঢোকে। রাসেল ফুসকা খায় না, সে ফ্রেঞ্চফ্রাই অর্ডার করে।  এমন সময় পারুলের মুঠোফোন বেজে ওঠে। আর ঠিক তখনই মেয়েটিকে দেখে রাসেল। কিছুটা পাশফিরে দেখা। খুব চেনা চেনা লাগে এবং মেয়েটির চোখ ও নাকের অবয়ব দেখে মনে হয় বহুদিনের পরিচিত। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারে না, কোথায় তাকে দেখেছে। মেয়েটা আচমকা রাসেলের টেবিলঘেঁষে দাঁড়ায়, ‘রাসেল দা, আপনি এখানে? কেমন আছেন?’ রাসেল থতমত খায়, তোতলাতে থাকে। মেয়েটি নিজে থেকেই পরিচয় দেয়, ‘দাদা, আমি নবনী। বিকাশের বোন।’ মুহূর্তেই মেয়েটিকে চিনতে পারে রাসেল। তার কলেজজীবনের বন্ধু বিকাশচন্দ্র প্রামাণিক। খুব ভালো সম্পর্ক ছিল দুজনের। প্রায়ই ওদের বাড়িতে যেতো। তখনই নবনীকে দেখে রাসেল। নবনী তখন হাইস্কুলে পড়ে। খুব ভালো গান করতো। মনে পড়ে, কোনো কোনোদিন কেবল নবনীর গান শোনার জন্যই ছুটে যেতো ওদের বাড়িতে। কিন্নর কণ্ঠ সম্পর্কে রাসেলের পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। সেটা যদি মিষ্টি সুরেলা হয়, নবনীর কণ্ঠ ছিল ঠিক তাই।

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর, বিকাশের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় চলে আসার পর একদিন খবর পায়, কী একটা অসুখে বিকাশ মারা গেছে। বিকাশের বাড়িতে আর কখনো যাওয়া হয়নি। এসব বহুদিন আগের কথা। নবনী খুশির গলায় বলে, ‘কতদিন পর আপনাকে দেখলাম!’ রাসেল আড়চোখে একবার পারুলকে দেখে। সে চোখ সরু করে তাকিয়ে আছে। নবনী বলে, ‘দাদা, আমি এখন ঢাকায় থাকি। লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অনার্স ফাইনালে পড়ছি।’ সঙ্গের মেয়েটার সঙ্গেও নবনী পরিচয় করিয়ে দেয়। নীতু। ওরা একসঙ্গে পড়ে। ‘বাহ, বেশ ভালো।’ রাসেল হাসিমুখে বলে। ‘দাদা, আপনি কোথায় থাকেন?’ রাসেল সে-কথার উত্তর না দিয়ে বলে, ‘তুমি এখন আর গান করো না?’ গানের প্রসঙ্গ তোলায় নবনীর হাসিমুখ দপ করে নিভে যায়। কিন্তু মুহূর্তেই তার মুখ আলোময় হয়ে ওঠে- ‘আমি ছোটমাসির বাসায় থাকি। আপনি একদিন বেড়াতে আসেন। খুব খুশি হব।’ ‘চেষ্টা করব। নবনী, পরিচয় করিয়ে দেই- ওর নাম পারুল। তোমার বৌদি।’ নবনী হাত তুলে মাথা নিচু করে নমস্কার জানায়।

বাসায় ফিরে বিছানায় কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকে পারুল। এরপর আচমকা চিংড়ি মাছের মতো লাফিয়ে উঠে রাসেলের উপর একরকম চড়াও হয়- ‘সত্যি করে বলো, ওই মেয়ের সঙ্গে তোমার কতদিনের সম্পর্ক?’ রাসেল আকাশ থেকে পড়ে- ‘কোন মেয়ে?’ ‘তুমি কচি খোকা নও যে তোমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে!’ ‘তুমি নবনীর কথা বলছ?’ ‘হ্যাঁ।’ পারুলের নারী-বিষয়ে সন্দেহের ব্যাপারটা যে আন্দাজি অনুমান ও সন্দেহ, সেটা রাসেলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।  পারুল খোঁচাতেই থাকে। রাসেল বিস্মিত চোখে পারুলকে দেখতে থাকে। কোনো কথা বলতে পারে না। একসময় দরজা খুলে বাসা থেকে হনহন করে বেরিয়ে যায়। 

আরো পরে, যখন সবকিছু থেমে আসে আর শান্ত হয়ে যায়, এক ছুটিরদিনে দুজনে সিদ্ধান্ত নেয়, এভাবে আর নয়-আমরা আলাদা হয়ে যাব। জোরজবস্তি ও কোনো চাপ প্রয়োগ করে নয়। দুজনের ভালো থাকার জন্য আলাদা হয়ে যাওয়াটাই ভালো। তারা দুজন দুজনকে জানিয়ে দেয়। এতেই বরং মুক্তি মিলবে। রাসেল মুক্তি চায়। মুক্তি পারুলও চায়। তাই সে আপত্তি জানায় না। বরং আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে পারুল জানিয়ে দেয়, সেও এমনটাই ভাবছে। 

পারুল কখন ঘুম থেকে উঠেছে, রাসেল টের পায়নি। বেসিনের জলের শব্দে তার ঘুমটা ভেঙে গেল।  পারুল ভোরের প্রথম ট্রেন ধরবে। তাকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে হবে কিনা, সে কিছু বলেনি। রাতেই জামাকাপড় ও অন্যান্য জিনিস গোছানো হয়ে গেছে। এখন সে নিজে তৈরি হচ্ছে। এতদিনের সম্পর্ক, সেদিক থেকে ভাবলে পারুলের সঙ্গে তার যাওয়া উচিৎ।  কিন্তু পারুল তো অমতও করতে পারে; একবার ভাবে রাসেল।  অনেকদিন আগে, পারুল যখন রাগ করে বাসা ছেড়ে চলে গিয়েছিল, রাসেল তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য বেরুচ্ছে, পারুল প্রায় হুংকার দিয়ে বলেছিল, ‘খবরদার, আমার পেছনে আসবে না।’ 

গত তিনদিন ধরে দুজনের কথা বন্ধ রয়েছে। ইশারায়, কখনো চিরকুট লিখে ভাব বিনিময় হয়েছে। বাসায় দুজন মাত্র মানুষ, কথা না বলে কাটানো মুশকিল।  আড়মোড়া ভেঙে রাসেল বিছানায় উঠে বসে। নিয়ম ও শর্ত ভঙ্গ করে সে কথা বলে ওঠে, ‘বেরুচ্ছ?’ পারুল একবার তাকায়। কোনো কথা বলে না। 

দরজা খুলে রাসেল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। পারুল কিছুক্ষণ পরেই বেরুবে। দুজনের বহুদিনের সম্পর্ক চুকেবুকে যাবে। তারচেয়েও বড় কথা, দুজনেই কাক্সিক্ষত মুক্তি পাবে; এতদিন ধরে দুজনে সেটাই চেয়েছিল। সম্ভাব্য মুক্তির কথা ভেবে সে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে। দরজা খুলে বের হওয়ার পর দেখে, পারুল সাইডব্যাগ কাঁধে ফেলে দুটো লাগেজ টেনে বাইরে এনে রেখেছে। দরজা খুলেই বেরিয়ে পড়বে। অপেক্ষা করছে; হয়ত ‘যাই, ভালো থেকো’ কথাটুকু বলার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। হয়ত এসবের কিছুই সে ভাবছে না। 

রাসেল নিঃশব্দে বাথরুমে ঢোকে। প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশি সময় কাটায়। বাথরুমে থেকে বের হওয়ার পর দেখে, দরজা হাট করে খোলা। তার ভাবনার সঙ্গে কোনো কিছুই মেলে না।  রাসেল দরজা বন্ধ করে। একটু মন খারাপ আর বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে সে ঘরে যায়। বারান্দায় যায়। বারান্দার ইজিচেয়ারে আরাম করে বসে। শহুরে সকাল এখনো শুরু হয়নি। সে একটা সিগারেট ধরায়। কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়ে। ধোঁয়ার রিঙ বানায়। রিঙ উপরে উঠতে উঠতে ভেঙে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে যায়।  রাসেল একটা পা গ্রিলের রেলিংয়ে তুলে দেয়। দূরের রাস্তায় চোখ রাখে। একটা দুটো রিকশা ও প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া কোথাও কেউ নেই। এত সকালে কোথাও বেরিয়ে কাজ নেই, আর একবার আরাম করে ঘুম দেব; ভেবে সিগারেট ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও সে বারান্দায় বসে থাকে। বুক ভরে একবার শ্বাস নেয়, ছেড়েও দেয়। সম্পর্কটা তাহলে শেষ হয়ে গেল; ভেবে স্বস্তি ও মৃদু পুলক অনুভব করে। কিছুক্ষণ পর, আচমকা রাসেলের ভেতরে  কিছু একটা হয়; কী যে হয়, তার হার্টবিট বেড়ে যায়। মুখ শুকিয়ে আসে। তৃষ্ণা পায়। বুকের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে। বারান্দা থেকে বিদ্যুতের বেগে ঘরে আসে রাসেল। চটজলদি শার্ট-প্যান্ট পরে সে বেরিয়ে যায়। সিএনজি ড্রাইভারকে কেবল বলতে পারে, কমলাপুর রেলস্টেশন।

এতক্ষণে ট্রেন কি স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে? একবার ঘড়ি দেখতে গিয়েও দেখে না। স্টেশনে ঢুকে একটা প্লাটফরম থেকে আরেকটা প্লাটফরমে কাঙ্ক্ষিত মুখটা সে খুঁজে ফেরে। ভেঁপু বাজিয়ে একটা ট্রেন ছেড়ে যায়। শেষ দেখাটুকু কি আর হবে না? ভেবে গলাটা শুকিয়ে আসে রাসেলের।  এমন সময় পাশ ফিরে তাকাতেই পারুলকে দেখে। বিকেলের কোমল আলোর মতোন চোখদুটো নরম হয়ে আসে রাসেলের। তার আগমন পারুলও টের পায়। সে চোরাচোখে তাকায়, কিছু বলে না। পারুল খুশি না অখুশি, রাসেল বুঝতে পারে না।  নীরবে কিছু সময় কেটে যায়। রাসেল পারুলের কাছে সরে আসে-‘যাচ্ছ?’ পারুল মাথা দোলায়। রাসেল তবু দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখে কথা সরে না।   মাইকে কিছু একটা ঘোষণা করে। ট্রেনে ওঠার জন্য পা বাড়ায় পারুল। ট্রলিব্যাগে হাত রাখে। খুট করে শব্দ হয়।  রাসেল কাতর গলায় ডাকে ‘পারুল!’ রাসেলের মুখ দিয়ে স্পষ্ট স্বর বেরোয় না। পারুল তবু পাশ ফিরে তাকায়।  রাসেল কিছু বলছে না দেখে পারুল ব্যাগ নিয়ে আবারও পা বাড়ায়। রাসেল কাতর গলায় বলে, ‘পারুল, পরশু পূর্ণিমা।’ পারুল না শোনার ভান করে অন্যদিকে তাকায়।  ‘কয়েকজন বন্ধু মিলে আমরা আগামীকাল কক্সবাজার যাচ্ছি, দুপুরের ট্রেনে। তুমি যাবে?’  ট্রলিব্যাগ থেকে পারুল হাত সরিয়ে নেয়। ওর হাত কাঁপে। ঝড়ের বেগে সে রাসেলের চোখে তাকায়।  রাসেল মুখ নিচু করে বলে, ‘তুমি ছাড়া আমি সত্যি খুব একা হয়ে যাব।’ পারুলের চোখ পিটপিট করে। সে প্রায় ছুটে এসে জাপটে ধরে রাসেলকে। রাসেলও তুমুল আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরে পারুলকে। রাসেলের হাতের খোঁচা লেগে পারুলের মাথার খোঁপার কাঁটা ছুটে যায়; জলপ্রপাতের মতো তার লম্বা কালো চুল ভেঙে পড়ে পিঠে ও রাসেলের মুখে। স্টেশনের মানুষ সাতসকালে এমন দৃশ্য দেখে ভড়কে যায়, কেউ হেসে ফেলে। হঠাৎ বাচ্চাদের মতো কঁকিয়ে ওঠে পারুল; ‘কোথাও যাব না আমি, কোথাও না। তোমার বুক থেকে আমি কোথাও যেতে চাই না।’ 

বাইরে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। স্টেশনের প্লাটফরমে অসংখ্য মানুষের ভিড়, সেই ভিড়ের ভেতরে দুজন নারী-পুরুষ ভরা নদীর মতো মিশে থাকে।