সারা বাংলা

মায়ের স্বর্ণ বিক্রি করে যুদ্ধে গিয়েছিলাম

এলাকার দুই বড় ভাইয়ের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে যাওয়ার কথা থাকলেও তারা আমাকে ছেড়েই গভীর রাতে চলে যায়। শেষে মায়ের পাঁচ আনা স্বর্ণালঙ্কার ত্রিশ টাকায় বিক্রি করে নিজেই আরো কয়েকজনকে নিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে যাত্রা করি। 

বলছিলেন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজেদ আলী সরকার। এসএসসি পরীক্ষার্থী হয়েও পরীক্ষা না দিয়ে রণাঙ্গনে যাওয়ার শুরুটা এভাবেই হয়েছিলো তার।

ওয়াজেদ আলী বলেন, ১৯৭০ সালে আমি যখন দশম শ্রেণিতে সে সময়ই পীরগাছা উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। আমি ছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভক্ত। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমার হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। সেই ভাষণ আর বিশেষ করে সন্ধ্যার পর বাঙালিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাক সেনাদের অবর্ণনীয় অত্যাচার দেখে আমি মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।

তিনি বলেন, আমরা ১৭ জন একসঙ্গে কাউনিয়ার তিস্তার দুর্গম চরে পায়ে হেঁটে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাত্রা করি।  পথিমধ্যে তিস্তার একটি বাড়িতে কিছু খেতে চেয়েছিলাম কিন্তু তাদের ঘরেও খাবার ছিলোনা। কাউন ভেজে আমাদেরকে খেতে দেয়, সেগুলো খেয়ে আবার রওয়ানা হই।

এরপর ভারতের শিলিগুড়িতে গিয়ে মোট দেড়মাসের মতো অবস্থান করে টানা ২৮ দিন ভারতীয় আর্মির কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে আমরা একশ জন একত্রে বাংলাদেশি কোম্পানি কমান্ডার মোসলেম উদ্দিনের অধীনে অস্ত্র চালানো শিখি। 

প্রশিক্ষণ শেষে ভারত সরকারের দেওয়া ৮০ টাকা নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে যাই। এরপর বৃহত্তর ৬ নম্বর সেক্টরে কমান্ডার খাদেমুল বাশারের অধীনে প্লাটুনে ভাগ হয়ে লালমনিরহাটের দইখাওয়া, তিস্তা, কাউনিয়ার মধুপুরসহ রংপুরের অনেক স্থানে অবস্থান করে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করি। কখনো বেলায়েত হোসেন আবার কখনো মোসলেম কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছি।

যুদ্ধের লোমহর্ষক স্মৃতিচারণ করে রণাঙ্গনের এই বীর সেনা বলেন, ভারতের মুজিব ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণের পর রংপুরের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেছি। এর মধ্যে সবচেয়ে কষ্ট ও পীড়াদায়ক ঘটনা হলো- ভারত থেকে আসার পথে তিস্তার রাজেন্দ্রপুরে পূর্ণ দফাদারের বাড়িতে রাত্রিযাপন করি। সকাল বেলা যখন আমরা খাওয়া দাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। খাবারও প্রায় প্রস্তুত। শুধু হাত ধুয়ে খেতে বসবো। এমন সময় খান সেনারা যে কোনোভাবে খবর পেয়েছে যে, দফাদারের বাড়িতে মুক্তিরা অবস্থান করছে। তারা আশে পাশের কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে এদিকেই আসছে।  টের পেয়ে দফাদারের বাড়ির পাশের একটি ধান ক্ষেতে আমাদের অস্ত্রগুলো লুকিয়ে রাখি। সকলে খাওয়া বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যাই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই খান সেনারা দফাদারের বাড়িতে হাজির হয় এবং দফাদারের পঞ্চাশোর্ধ স্ত্রী (সম্ভবত ননীবালা নাম হবে) ননিবালার কাছে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চায়। কিন্তু ননিবালা আমাদের খবর জানাননি। পরে তাকে বেধড়ক মারপিট করে এবং পূর্ণ দফাদারের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়। দফাদার সেই সময়ে বেশ ধর্ণাঢ্য ব্যাক্তি ছিলেন‌। একে একে তার ৩২টি টিনের দোচালা ঘর পুড়িয়ে দেয়। ওই ভদ্র মহিলা মার খেয়েছেন তবু আমাদেরকে দেখিয়ে দেননি। ভদ্র মহিলার আত্মত্যাগের সেই ঘটনাটি আজও আমাকে পীড়া দেয়। আমাদের কারণে তাদের এই অবর্ণনীয় নির্যাতন স্মৃতি থেকে ভোলার মতো নয়। 

চোখের সামনে সহযোদ্ধা নিহতের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ৪ অথবা ৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে পীরগাছার ওকরাবাড়ী এলাকায় অবস্থানকালে হাসমত আকন্দ নামের এক ছেলের কাছে আমরা খবর পাই কিছুক্ষণের মধ্যেই পাক সেনার কয়েকজন ওকরাবাড়ী ব্রিজ অতিক্রম করবে। তাদের সংখ্যায় কমের খবর পেয়ে আমরাও ব্রিজের পাশে অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেই। আমরা পরিকল্পনা করলাম অ্যামবুশ পেতে তাদেরকে জ্যান্ত আটক করবো। কিন্তু আমাদের কাছে আসা খবরটি ছিলো ভুল। আমরা ধারণা করেছিলাম তারা ৫ থেকে ৬ জন সংখ্যায় হবে পরবর্তীতে দেখলাম তারা ত্রিশ জনের উপরে। 

আমরা ১৭ জন ছিলাম সেখানে। মোসলেম উদ্দিন, বেলায়েত ও দেলোয়ারসহ তিনজন কমান্ডার ছিলো। আমাদের সঙ্গে এলএমজি, রাইফেল, স্টেনগান ছিলো। এলএমজি ফায়ার করার কথা ছিলো দেলোয়ার কমান্ডারের। তিনি বন্দুক উঁচিয়ে মিস ফায়ার করেন। অমনি পাক সেনারা আমাদের অবস্থান টের পেয়ে সাইডে অবস্থান নেয়। আমাদের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে হিট অ্যান্ড রান যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে অস্ত্রের পাওয়ার কম থাকায় কৌশলে আমরা আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করি। কিন্তু সেখান থেকে নতুন যোগদান করা সহযোদ্ধা মজিদ আকন্দ স্থান‌ত্যাগ করতে না পেরে আটকে যায় এবং পাক সেনারা তার বুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে চলে যায়। তার এই লাশের স্মৃতি আজও আমাকে কাঁদায়।

বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে ও বিজয়ীর বেশে পরিবারের কাছে ফিরে আসার স্মৃতিচারণ করে ওয়াজেদ আলী সরকার বলেন, ১৫ ডিসেম্বর পীরগাছার কৈকুড়ী ইউনিয়নের নজরমামুদ এলাকায় আমরা একটি সেল্টারে সারারাত অতন্ত্র প্রহরীর ন্যায় পাকসেনাদের অবস্থান জেনে ও অ্যামবুশ ফাঁদ পেতে ছিলাম। ক্ষুধা আর ক্লান্ত শরীরে সকাল হলো। সকালে বিজয়ের খবর পেয়ে সকলে আনন্দে কেঁদে ফেললাম। পরে সেখান থেকে সকলে মিলে পীরগাছা উপজেলার ক্যাম্প হেড কোয়াটারের দিকে চলে আসলাম। স্টেশনের নিকট এসে দেখি রেল লাইনের ধারে ধান ক্ষেতে পাক সেনারা তাদের অস্ত্রগুলো ফেলে পালিয়ে গেছে। সেই অস্ত্রগুলো আমি আর হাসমত কুড়িয়ে থানায় জমা দেই।

পরে সকলে কমান্ডারের কাছে বিদায় নিয়ে নিজ বাড়ির দিকে চলে যাই। বাড়িতে গিয়ে বাবা-মা আর ভাই বোনদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তারা আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সেই স্মৃতি বলার মতো না। বোনরা ঘামে ভেজা পোশাক খুলে নিয়ে গোসল করিয়ে দেয়।

প্রসঙ্গত, বীরমিুক্তিযোদ্ধা ওয়াজেদ আলী সরকার পীরগাছা উপজেলার পশ্চিম দেবু এলাকার মৃত আছিম উদ্দিন সরকারের ছেলে। তিন ভাই আর দুই বোনের মধ্যে ওয়াজেদ আলী সবার বড়। কৃষক পরিবারের বড় ছেলে বর্তমানে বিবাহিত জীবনে তার স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে রয়েছে। ওয়াজেদ আলী সরকার যুদ্ধকালীন সময়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এসএসসি, এইচএসসি ও বিএ পাশ করেন। শিক্ষিত হয়েও চাকরি না করে ওয়াজেদ আলী ব্যবসায়ী পেশা ও রাজনীতি ধরে রেখেছিলেন। রংপুর-৪ আসন থেকে এমপি ও উপজেলা নির্বাচনেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের উপজেলা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছেন।