সাতসতেরো

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের কবর ঘিরে গোরখোদকের ভালোবাসা

‘বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এই দ্যাশের জন্যে জীবন দেছে, আমি চেষ্টা করতেছি তাঁর কবরের খেদমত করতে। তাঁর খেদমত করতে করতেই আল্লা যেন আমারেও দুনিয়া থেকে তুইল্যা নেয়।’ কথাগুলো বলছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের কবরের তত্ত্বাবধায়ক ও গোরখোদক মিন্টু মিয়া।

মতিউর রহমানের কবর যারা খুঁড়েছিলেন তিনি তাদের একজন। পরে এই বীরশ্রেষ্ঠ’র কবর দেখাশোনার দায়িত্ব পান মিন্টু মিয়া। নিজেকে এজন্য গর্বিত মনে করেন তিনি। কবরে শুয়ে থাকা মানুষটির প্রতি তার ভালোবাসার কমতি নেই বরং আবেগ আছে, মমতা আছে। 

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ‘২০ আগস্ট ১৯৭১ সকাল ১১.১৫ মিনিটে পাঞ্জাবী পাইলট অফিসার রাশেদ মিনহাজসহ টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান (কল সাইন ব্লু বার্ড-১৬৬) ছিনতাই করে ভারত অভিমূখে উড্ডয়ন করেন। অপর পাইলটের সাথে কন্ট্রোল নিয়ে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সিন্ধুর বেদিনে বিমানটি বিধ্বস্ত হলে উভয়েই শাহাদত বরণ করেন। পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা তার লাশ উদ্ধার করে মশরুর বিমান ঘাটির ৪র্থ শ্রেণীর কবরস্থানে অত্যন্ত অমর্যাদার সাথে দাফন করে।’ মানুষ যাতে বুঝতে পারে, কে শুয়ে আছে কবরে এ জন্য মতিউর রহমানের পরিচয় দেওয়া হয়েছিল এমন ভাষায়: ‘ইধার সো রাহা হ্যায় এক গাদ্দার’, যার বাংলা তর্জমা: এখানে এক বিশ্বাসঘাতক শুয়ে আছে।

দেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হলে ‘এই লেখা’ এই ‘গাদ্দার’ উপমা কোনোদিন হয়তো মুছতো না। বাঙালির স্বাধীন সত্তার পরিচয় লেখা হতো ঠিক ওভাবেই। কিন্তু না, স্বাধীনতা এলো-বাঙালি নিজেদের পরিচয় নিজেদের ভাষায় লেখার অধিকার প্রতিষ্ঠা করলো। তারপরেও মতিউর রহমানের কবর দীর্ঘদিন ‘বিশ্বাসঘাতক’ চিহ্ন বহন করে টিকে ছিল পাকিস্তানের মাটিতে।  

মৃত্যুর ৩৫ বছর পর ২৪ জুন ২০০৬ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান থেকে দেশে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পুনঃসমাহিত করা হয়। বাংলাদেশ তাঁর সূর্যসন্তানের দেহাবশেষ দেশের মাটিতে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাধিস্থ করে। সমাধীফলকে লেখা হয় প্রকৃত অক্ষরমালা। বাংলা মায়ের সন্তানের সমাধিফলকে বাংলা ভাষায় লেখা হয় তাঁর কৃতী।  

‘যখন বুকের রক্তে লিখেছি/ একটি নাম/বাংলাদেশ....মতিউর রহমান/করাচীর খাঁচা ছিঁড়ে ছুটে গেল/ মহাশূন্যে টি-৩৩ বিমানের/দূর্দম পাখায় তার স্বপ্নের/ স্বাধীন স্বদেশ মনে করে/ফেলে তার মাহীন তুহিন মিলি/ সর্বস্ব সম্পদ; পরম আশ্চর্য এক/কবিতার ইন্দ্রজাল স্রষ্টা হ’ল/ তার অধিক কবিতা আর কোন বঙ্গভাষী কবে লিখেছে কোথায়?’  মতিউর রহমানের কবর কোথায় হবে তা নিয়ে দেশের মাটিতেও দ্বিমত তৈরি হয়েছিল। ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে মিলি রহমান (মতিউর রহমানের স্ত্রী) বলেছিলেন, মতিউর রহমানের কবর সেখানে দেওয়া হোক যেখানে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার থাকবে।

অন্যদিকে তৎকালীন সরকারের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী রেজাউল করিম বলেছিলেন, তারা সেনানিবাসের ভেতরে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরকে সমাহিত করতে চান এই যুক্তিতে যে, এতে দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা তার আত্মত্যাগ দেখে অনুপ্রাণিত হবেন।

অবশেষে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার যেখানে আছে সেখানে সমাধিস্থ করা হয় বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে। বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত সমাধিক্ষেত্র তৈরি হলো। এখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসে। সমাধিতে দাঁড়িয়ে স্মরণ করে–এখানে শুয়ে আছে দেশের সেই শ্রেষ্ঠ সন্তান, যে দেশের মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের জন্য একটি বিমানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। যে নিজের জীবন বাজি রেখে, পাকিস্তানের মাটিতে স্ত্রী, সন্তান থাকা সত্ত্বেও জন্মভূমির টানে ছুটে আসতে চেয়েছিলেন। এবং এই কাজ করতে গিয়ে বীরত্বপূর্ণ মৃত্যু আলিঙ্গন করেছেন। 

২০০৬ সালের ৮ এপ্রিল বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা আছে,  বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক ইসলামাবাদ সফরের সময় পাকিস্তান সরকার মতিউর রহমানের দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে রাজী হয়। 

মিলি রহমান এবং তাঁর পরিবারের অন্য সদস্যদের আবেদন মেনে মতিউর রহমানকে সমাধিস্থ করা হয় মীরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। সেই থেকে এই কবরস্থানের সঙ্গে মিলি রহমানের আত্মার যোগ। তিনি যেখানেই থাকুন নিয়মিত খোঁজ রাখেন।  মাঝেমধ্যেই ছুটে আসেন প্রিয় স্মৃতি চিহ্নের কাছে। 

মিন্টু মিয়া বলছিলেন, মতিউর রমহানের স্ত্রী হিসেবে মিলি রহমান সরকার থেকে যে রেশন পান তা তিনি গ্রহণ করেন না। পর্যায়ক্রমে রেশনের সবটা ভাগ করে দেন মতিউর রহমানের কবরের দুজন তত্ত্বাবধায়ক এবং বুদ্ধিজীবী করবস্থানের ইমামের মধ্যে। ইমাম সাহেবের দায়িত্ব ফজরের নামাজ পড়ে মতিউর রহমানের কবরের পাশে বসে কোরআন তেলাওয়াত করা।

কোরআনের সুর মূর্ছনার সঙ্গে এখানে ঝরে পড়ে বকুল, বেলী আরও কত ফুল। সবুজ পাতা জীবনোল্লাসে জেগে থাকে। জনবহুল মীরপুরের আত্মত্যাগ ও অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এই গোরস্তান। এখানকার কবরগুলো এক এক দীর্ঘ গল্পের স্মৃতিচিহ্ন। এসবের মধ্যে মতিউরের গল্প গ্রীক পুরাণের ইকারুসের মতো প্রত্যয় জাগানিয়া। যে সূর্যকে ছুঁতে পারেনি সত্য, সূর্যের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে নিজের ডানা পুরিয়ে মানুষের উড়বার সাধ জাগিয়ে দিয়েছে। আমাদের মতিউর রহমান, আমাদের বীর- যাঁর উড়ে আসার গল্প আমাদের সত্তায়  ফিরে যাবার, আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার গন্তব্য মনে করিয়ে দেবে চিরকাল। এ গল্পের পরিধি বাংলাদেশের সমান।